লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা বনাম ইসলামে নারী অধিকার।। পর্ব-১

লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা বনাম ইসলামে নারী অধিকার।। পর্ব-১

  • আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব। বিংশ শতাব্দী জুড়ে কিছু তথাকথিত নারীবাদীদের মাধ্যমে পত্র-পত্রিকায় এদের সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আমাদের বঙ্গীয় অঞ্চলে জনৈকা তাসলিমা নাসরিনের অসংলগ্ন প্রলাপ চিৎকার এক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের মাঝে খুব হৈ চৈ তোলে।

সাম্প্রদায়িকতা সে যে সুরতেই হোক, একটা সামাজিক ব্যাধি। লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা সমাজে নারীদেরকে পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানোর অপপ্রয়াসে লিপ্ত। এককালে যেমন উৎপাদনের দুই প্রধান উপাদান পুঁজি লগ্নিকারক ও শ্রম লগ্নিকারক শ্রমিকদেরকে পরষ্পর প্রতিদ্বন্ধী ও জযুজ্যমান করে তুলে ধরে সমাজকে একটা ভয়ংকর উৎপাদন বিরোধী বিশৃঙ্খলা আহবে লিপ্ত করার প্রয়াস পেয়েছিল তৎকালীন বামপন্থী চিন্তাধারা, তেমনি আজ লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকরা পুরুষ ও নারীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জনে জনে ঘরে ঘরে এর চেয়েও এক বিশৃঙ্খল সামাজিক অস্থিরতা নির্মাণে প্রয়াস পেতে দেখা যাচ্ছে। যা সফল হলে অগ্নি লাভার মতই সবকিছু নিঃশেষ করে দিবে এককালে।

অস্বীকার করার উপায় নেই পুরুষতান্ত্রিক পাশবিক মানসিকতার সমাজে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়ে আছে নারীরা দীর্ঘকাল থেকেই। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে পঙ্গুপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জীবন। পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ হয়েছে তাদের সঙ্গে। এমনকি কোন কোন দার্শনিক প্রশ্ন তুলেছেন নারীরা মনুষ্য প্রজাতির কি না? বিভিন্ন প্রাচীন ও বৈদিক ধর্মে নানাভাবে তীব্র বৈষম্যের শিকার হয়েছে তারা। যার প্রতিক্রিয়ায় বর্তমানে নারীবাদীদের মাধ্যমে আরেক প্রান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার জন্ম এই লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা।

অস্বীকার করার উপায় নেই পুরুষতান্ত্রিক পাশবিক মানসিকতার সমাজে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়ে আছে নারীরা দীর্ঘকাল থেকেই

পরষ্পর বিরোধী এই দুই প্রান্তিকতার মাঝে আজ সময় এসেছে ভারসাম্যপূর্ণ সুষম ভাবধারা চিন্তা করার। নারী ও পুরুষ এই যে মনুষ্য প্রজাতির দুটো সমান্তরাল বহমান ধারা, এদের পারষ্পারিক সম্পর্কটা কি দ্বান্দ্বিক না এরা একজন আরেকজনের পরিপূরক, এই বিষয়টি চিহ্নিত করা ও নিরসনের মাঝে রয়েছে মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার মূল সমাধান। নারী-পুরুষের পারষ্পরিক সম্পর্ককে যদি আমরা দ্বান্দ্বিকতার দিকে নিয়ে যাই তবে কী চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত হবে তা ভাবাও যায় না।

আমার মা, যিনি সবধরণের কষ্ট স্বীকার করেছেন আমার জন্য, আমার সঙ্গী তাঁর সম্পর্ক কী করে দ্বান্দ্বিক হবে একজন নারী হিসেবে। আমি আমার মায়ের বা আমার মা কি আমার বিপক্ষে দাঁড়াবেন? কল্পনা করা যায় আমার কণ্যার সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক হবে আমার বা তার আমার সঙ্গে? আমার বোন, আমার ফুফু, আমার খালা, দাদী, নানী? এ ধরণের চিন্তা করলে ভিড়মি খেতে হবে। আমার প্রেমময়ী স্ত্রী আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? এই লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকরা কোথায় নিয়ে যেতে চায় আমাদেরকে? আমাদের পৃথিবীকে? উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন শ্রেণী সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে পৃথিবীকে এগিয়ে নেয়া যায়নি, কোন কল্যাণ হয়নি পৃথিবীর, তেমনি লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতাও কারো কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না, আনতে পারে না।

উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন শ্রেণী সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে পৃথিবীকে এগিয়ে নেয়া যায়নি, কোন কল্যাণ হয়নি পৃথিবীর, তেমনি লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতাও কারো কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না, আনতে পারে না।

ইসলাম আল্লাহ্পাকের রাহনুমায়ী ও হেদায়েতের আলোকে সব ধরণের সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতাবোধ ও প্রান্তিক চরমপন্থা থেকে পৃথক এক অসাম্প্রদায়িক মধ্যপন্থী জীবনাদর্শ। আল্লাহ্পাক মহাবিশ্ব এই প্রকৃতি খোদ এই মনুষ্য জাতিসহ সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি জানেন কার কী চাহিদা, কার কী মেজায, কার কী স্বভাব, কার কী প্রয়োজন, আর কী ক্রমে কিভাবে হবে এর সমাধান। ইসলাম দ্বান্দ্বিকতাকে, জাত্যাভিমানতাকে উৎসাহ দেয় না। প্রকৃতির আপাত দ্বান্দ্বিক ক্ষেত্রসমূহেও সাযুজ্যের সমন্বয়ের এক ফল্গুধারা প্রবাহমান। যা সব দ্বান্দ্বিকতার সুষম সমাধান দেয় এবং প্রকৃতির শান্তিময়তার নিশ্চয়তা বিধান করে।

প্রকৃতির আর সব ক্ষেত্রের মত নারী-পুরুষের সম্পর্ককেও ইসলাম দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে না। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বি নয় বরং পরিপূরক। সৃষ্টি বৈচিত্রের মেলায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ অপূর্ণ, নারীর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এই অপূর্ণতা নিরসনে একজনকে আরেকজনের পরিপূরক করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নানা রঙের ফুলের বাহারে যেমন একটা স্তবক গড়ে ওঠে মনোহারী অবয়বে তেমনি নারী-পুরুষ মিলেই মনুষ্য একক গড়ে উঠে বাহারী মাত্রায়। মা-ছেলে, পিতা-পুত্রী, ভগ্নি-ভ্রাতা, এ সম্পর্ক তো দ্বান্দ্বিকতার কল্পনারও বাইরে। এ ক্ষেত্রে তো মায়ের পায়ের নীচে ছেলের বেহেশত সংস্থাপন করে মায়ের আনুগত্য ছাড়া ছেলে অন্য কিছু চিন্তারও অবকাশ নেই।

হাদীসে পাকে হেদায়াত দেয়া হয়েছে পিতাকে স্পষ্ট ভাষায়, বাইরে গেলে পুত্র-পুত্রীর জন্য কিছু নিয়ে আসবে, আর ঘরে এসে পুত্রীর হাতেই আগে তুলে দিবে সেই উপহার। কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আসমান থেকে প্রেরিত হন এক পবিত্র দূত ফেরেস্তা যিনি এই পরিবারের উপর রহমত ও বরকতের আশীষ নাযিল করেন বিশেষভাবে। পুত্র জন্মানোর ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। শুধু কি তাই! কন্যা সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জামানত দেয়া হয়েছে জান্নাতের। মাকে, কন্যাকে, ভগ্নিকে সামাজিক মর্যাদা দানের যে এই তুঙ্গস্পর্শী আবেদন তা সহজেই অনুমেয়। কারণ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ভিন্ন কোন আইনী প্রক্রিয়া কখনো কোন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হয় না। হতে পারে না। তাই ইসলাম সামাজিক মূল্যবোধের অঙ্গ হিসেবে মাকে, কন্যাকে, ভগ্নিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আগে।

নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রী-স্বামীর ক্ষেত্রে আপাতত দ্বান্দ্বিকতার কল্পনা হয়ত হতে পারে। এ সম্পর্ক মা-পুত্র, পিতা-পুত্রী, ভ্রাতা-ভগ্নীর মত জন্মজ ও স্বভাজ সুসম্পর্ক ভিত্তিতে নয়। এ সম্পর্ক অর্জিত গড়ে তোলা সমঝোতা।

এই ক্ষেত্রেও ইসলাম পরষ্পর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে পরষ্পর অবিচ্ছেদ্য পরিচ্ছেদ হিসেবে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হুন্না লিবাসুন লাকুম ওয়া আনতুম লিবাসুন লাহুন্না।’ তোমরা তাদের পরিচ্ছেদ আর তারা তোমাদের পরিচ্ছেদ। স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে এই সম্পর্কে ভিত্তি হচ্ছে ‘মাওয়াদ্দাত’ ভালবাসা এবং ‘রহমত’ দয়া। ইরশাদ হচ্ছে, ‘ওয়াজাআলা বাইনাকুম মাওয়াদ্দাতুন ওয়া রাহ্মাহ্। -সূরা রূম ২১। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের নিজেদের থেকেই কাপল জোড় বানিয়েছেন যেনো তোমরা চিত্ত প্রশান্তি লাভ কর তার কাছে আর তোমাদের পরস্পরের মাঝে স্থাপন করেছেন মাওয়াদ্দাত ভালবাসা এবং রহমত-দয়া। অর্থাৎ এ সম্পর্কের ভিত্তি টানা হেচড়া, দরকষাকষি ও দ্বান্দ্বিকতা নয়। এ সম্পর্ক হল প্রেমময় ভালবাসার, একজন অন্য জনের প্রতি রেহেম অর্থাৎ নাড়িবন্ধন জনিত দয়ার।

এখানে মাওয়াদ্দাতুন ও রাহমাতুন শব্দ দু’টির প্রয়োগ খুবই লক্ষণীয় আরবী উদ্দুন শব্দ থেকে গঠিত মাওয়াদ্দাতুন অর্থ শুধু ভালবাসা নয়। উদ্দুন বলা হয় অর্ন্তনিহিত ভালবাসা। হৃদয় উৎসারিত ভালবাসা। স্বামী-স্ত্রীর জীবন মেকী ভালবাসায় আবর্তিত নয়, তা হবে অর্ন্তনিহিত হৃদয় স্পন্দিত প্রেমময় ভালবাসায় আবর্তিত। রাহমাতুন শব্দটা রেহেম শব্দ থেকে গঠিত। রেহেম হল মায়ের জঠর। কেবল পরষ্পর দয়ার সম্পর্ক নয়, এমন দয়া যা নাড়ীর টানে সৃষ্ট, জঠরজাত। কী মহান অভিব্যক্তিতে আপ্লুত এই শব্দ। এর মাঝে ঘূর্ণায়মান হবে তোমার পারিবারিক জীবন, স্বামী-স্ত্রীর সংসার। চলতে গেলে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে, কোথায় কোন ত্রুটি হতে পারে। কিন্তু একজন আরেকজনের প্রতি ভালবাসায়, জঠরজাত অনুকম্পায় তা অতিক্রম করে যাবে।

তুমি ভাল না মন্দ, সাধু না অসাধু, তা তোমার বিষয়ে সবচেয়ে কাছে থেকে যার অভিজ্ঞতা সে স্ত্রীর নিকট থেকেই নিতে হবে সাধুতার সনদ।

পরষ্পর হৃদ্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত নয় ইসলাম। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে আরো এগিয়ে দিলেন কয়েক কদম। ঘোষীত হয়েছে নববী যবানে, তোমাদের মধ্যে উত্তম সে, যে তার পরিবারের কাছে, স্ত্রীর কাছে উত্তম। স্বামীকে সাধুবাদ গ্রাহ্যতার জন্য স্ত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত সার্টিফিকেট লাগবে। কেবল অধিকার আদায় যথেষ্ট নয়। আইনি চুক্তিতে তা হওয়ার নয়। তুমি ভাল না মন্দ, সাধু না অসাধু, তা তোমার বিষয়ে সবচেয়ে কাছে থেকে যার অভিজ্ঞতা সে স্ত্রীর নিকট থেকেই নিতে হবে সাধুতার সনদ।

ক্রমশ…

ইসলাম সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা  গ্রন্থ থেকে চিত

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *