শরণার্থী শিবিরে জমিয়তুল উলামা : বিশ্ববিবেকের লজ্জা শাহপরীর দ্বীপ

শরণার্থী শিবিরে জমিয়তুল উলামা : বিশ্ববিবেকের লজ্জা শাহপরীর দ্বীপ

শেখ নাঈমুল ইসলাম ● অনেক খোঁজাখুঁজির পর কুতুপালংয়ে মাদরাসায়ে খালিদ বিন ওয়ালিদে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও ইসলাহুল মুসলিমীনের ক্যাম্প অফিস খুঁজে পেলাম। গিয়ে দেখি গাড়ি শাহপরীর দ্বীপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত শুধু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। উঠলাম গাড়িতে। হযরত মাকনুন সাহেব জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের দুই নেতৃবৃন্দ সেক্রেটারি, মাওলানা হাকিমুদ্দিন কাসেমী ও অরগানাইজার মাওলানা আহমাদ আব্দুল্লাহ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এখান থেকে টেকনাফ প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেতে যেতে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের জন্য জায়গায় জায়গায় দীর্ঘ লাইন দেখে ৭১ এ ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ কোটি বাঙালির কথা মনে হলো। এদের মতোই বরং এদের চেয়েও মানবেতর জীবন তারা যাপন করেছিলো। আল্লাহ কী ফয়সালা প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে সেই বাংলাদেশই এখন তাদের বুকে আশ্রয় দিয়েছে তাদেরই মত নির্যাতিত, অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। গাড়িতে যেতে যেতেই চোখে পড়লো বাঁ পাশে নাফ নদীর ওপাড়ে সবুজ পাহাড়ে আগুনের ধোঁয়া। বুঝতে বাকি থাকলো না যে ঐখানে কোন গ্রামে বার্মীজ আর্মিরা আগুন দিয়েছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ মাঝখানে মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। একসময় আমাদের গাড়ি টেকনাফ পৌঁছে এবং সেখানে দেখলাম রোহিঙ্গারা যেখানে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর কাছে নির্যাতনের শিকার সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের পরম আশ্রয়স্থল।

সদ্য আসা রোহিঙ্গাদের এখান থেকেই সেনাবহিনীরা গাড়িতে করে বিভিন্ন ক্যা¤েপ পাঠায়। আমরা সেখানে সদ্য ঢোকা রোহিঙ্গাদের হাতে কিছু নগদ অর্থ বিতরণ করি। তারপর পায়ে হেঁটে পৌঁছাই ট্রলার ঘাটে, এই ট্রলার ঘাট থেকেই এখন ¯পীডবোটে বাঁ ট্রলারে করে শাহপরীর দ্বীপে যেতে হবে। জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম, প্রায় ১৫/২০ মিনিট লাগে পৌঁছতে। ভাবলাম, তাহলেতো প্রায় পদ্মা পাড়ি দেওয়ার মত অবস্থা কারণ পদ্মাও স্পিডবোটে ২০/৩০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছায়। পরে শুনলাম যে ¯িপডবোটে করে গেলে সময় আরও কম লাগে। যাক যখন আমরা ট্রলারে করে যাচ্ছি তখন দেখলাম যে, ওদিক থেকে অনেক রোহিঙ্গারা আসছে। চোখে মুখে বিপন্নতার ছাপ। যেন জীবন্ত লাশ এক একজন। শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে মাদরাসায়ে বাহরুল উলুমে উঠি। আমরা সেখানে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। তারপর মুহতামিম সাহেবের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে পরামর্শ করেন সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। তারপর আমাদের জন্য যেই রুমটি নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে আমরা মেহমানদের নিয়ে গেলাম। আর তারপরই দেখতে লাগলাম পঙ্গপালের মত ছুটে এসে আশ্রয় নিচ্ছে মাদরাসার সামনে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মহিলাদের রাখা হয়েছে মাদরাসার পুরানো কিছু কামরায়।

সেখান থেকে আমরা যাই শাহপরীর দ্বীপের সেই ঘাটে যেখানে এসে থামে বার্মা থেকে ছেড়ে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নৌকা। গিয়ে দেখি সেখানে জমিয়ত কর্মী আব্দুল্লাহ শাকের এই সদ্য বাংলাদেশের সীমানায় পা দেওয়া মানুষগুলোকে পরম মমতায় বরণ করে নিচ্ছেন। জরুরি খাবার, পানি বিতরণ করছেন। এখানে অর্ধেক নদী পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি ব্রিজ তৈরী করা আছে। ব্রিজে বেশিদূর যেতে দেয় না রাতের বেলা তাই কিনারায় দাঁড়িয়েই আহমাদ আব্দুল্লাহ, আমি ও আরও কয়েকজন দেখতে লাগলাম কীভাবে ব্রিজের নিচে নদীর পাড়ে এসে ভিড়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা নৌকা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অজানার উদ্দেশে উত্তাল সাগরে যাত্রা করে একদল মানুষ। গন্তব্য বাংলাদেশ নামে সীমানায় ছোট্ট কিন্তু হৃদয়ে বিশাল একটি দেশ। কিন্তু সবার সেই আশা পূরণ হয় না। মাঝপথে সমুদ্রের ঢেউ প্রতিনিয়ত কেড়ে নেয় অগণিত মানুষের প্রাণ। যারা এই প্রাণে বাঁচার তাগিদেই সাম্পান ভাসিয়েছে নির্মম সাগরে। সেখান থেকে পাশের এক মসজিদে গিয়ে দেখি চল্লিশ জনের একটি তাবলিগ জামাত এখানে অবস্থান করছে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য দেখলাম তারা গরু কাটছে। সকালে এই দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হবে মাদরাসার মাঠে। সেখানে আমরা সব সাথীরা আমীর সাহেবের সাথে বিভিন্ন জরুরি কিছু বিষয়ে পরামর্শ করলাম এবং তিনি আমাদেরকে বেশ কিছু ভালো পরামর্শ দিলেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুক।

এরপর মাদরাসায় গিয়ে দেখলাম, যারাই আসছে তাবলীগের সাথী ভাইরা তাদের নদীর ঘাট থেকে সিএনজিতে করে মাদরাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন। দেখতে দেখতে মাদরাসার মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ ভরে উঠলো। প্রায় দেড় দুই হাজার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু আশ্রয় নিয়েছে। হায়! বিশ্ববিবেককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দারিদ্র্যতায় ভরা একটি দ্বীপ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। জমিয়তের পক্ষ থেকে সবাইকে খাবার ও পানি দেওয়া হলো। মানুষ যে কত অসহায় হতে পারে আর বার্মিজরা যে কত রক্তপিপাসু হতে পাড়ে তা এই মানুষদের না দেখলে বোঝা যাবে না। একটি মেয়েকে দেখলাম বড় ঝুড়িতে বসে আছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, তাঁর পায়ে এমন আঘাত করেছে যে সে আর হাঁটতে পারে না। তখন সেই ১৫/১৬ বছরের কিশোরীটির অশ্রুভেজা চোখ যেন এই মানবসভ্যতাকে উপহাস করছে। আমি আর তাঁর দিকে তাকানোর সাহস পাইনিভ। দ্রুত সরে এসে চোখের পানি মুছি। একজনকে দেখলাম পায়ে বিরাট ক্ষত, জানা গেল এটা ধারালো অস্ত্রের কোপের আঘাত। রাতেই শুনলাম যে, একজন নারী মাদরাসার ভিতরেই বাচ্চা প্রসব করেছে। এও কি দেখার বাকি ছিল? একটি মেয়ে কি অপরাধ করেছে বিশ্ববাসীর কাছে যে আধুনিক বিশ্ব তাঁকে রাস্তায় বাচ্চা প্রসব করতে বাধ্য করছে। এমন শত শত ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে রইলাম। সকালে সেখানে জমিয়তের পক্ষ থেকে প্রায় সবাইকেই নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করা হলো।

তারপর বিষন্ন মনে ফিরতে লাগলাম কক্সবাজারের নির্ধারিত হোটেলে। মনে মনে ভাবলাম হায় বিশ্ববিবেক! রোহিঙ্গাদের কান্না আজ কোন পুঁজিবাদী আর লাল সা¤্রাজ্যবাদীদের কানে পৌঁছে না। মানুষ মানুষের জন্যÑ ও কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে নাÑ এইসব মুখরোচক স্লোগান সমাজবাদীরা দিয়ে বেড়ান। কিন্তু রোহিঙ্গা নিধন যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাজতন্ত্রী এই লাল সা¤্রাজ্যবাদীদেরই স্বার্থে হচ্ছে তা আর কেউ দেখে না।

● অক্টোবর ২০১৭, মাসিক পাথেয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *