শরতের আগমনে শুভ্র প্রকৃতি

শরতের আগমনে শুভ্র প্রকৃতি

  • মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া

সৌন্দর্যে, ঐশ্বর্যে ও প্রকৃতির রূপ–লাৃবণ্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। যেন সৃষ্টিকর্তার নিজ হাতে তৈরি একটি নন্দনকানন। যেদিকে চোখ যায় সবুজ মাঠ, ফসল, সোনালি রোদ—পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি নির্দেশন। বাংলাদেশের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলে ছয়টি ঋতু। পৃথক এ ঋতুগুলো যেন এক একটি আসে নতুন আলো, নতুন সূর্য তথাপি নতুন একটি দিগন্ত নিয়ে। প্রতিটি ঋতুর আছে আলাদা তাৎপর্য। প্রতিটি ঋতু বাংলায় আসে আগমনী বার্তা নিয়ে। এমন একটি ঋতু শরৎকাল।

ঋতু পরিক্রমার তৃতীয় ঋতু শরৎকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস শরৎকাল। পঞ্জিকা অনুসারে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর—এসব মিলেই তো শরতের সৃষ্টি। শরৎকালের প্রথম মাস অর্থাৎ ভাদ্রের শুরু থেকেই শরতের আবির্ভাবটা লক্ষণীয়। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে, তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে এবং বুঝতে পারি শরতের আগমন কতটা মধুর।

গ্রীষ্মের অগ্নিস্নান আর বর্ষায় অঝোরধারায় শ্রাবণ ঢলের পর আসে শরতের আলোছায়ার খেলা; এই মেঘ, এই বৃষ্টি, তো কিছুক্ষণ পরই রোদের হাতছানি। তবে নেই বজ্রপাত ও মেঘের গর্জন। ভ্যাপসা গরমের বদলে বইছে মিষ্টি বাতাস। আহ কী অপরূপ! বর্ষা বিদায় নিয়ে শরৎ এসেছে এ বঙ্গে। তারই যেন জানান দিচ্ছে প্রকৃতি।

শরৎকে একটি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন ঋতু হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। কারণ, বর্ষার শীতল বৃষ্টি প্রকৃতিকে করে দিয়েছে পরিষ্কার, গ্রীষ্মের অগ্নিস্নান করা গাছগুলোয় যেন সতেজ প্রাণ ফিরে আসে শরতে। বাংলার ভরপুর হওয়া খাল–বিল কিংবা দিঘিগুলোয় ফোটে জাতীয় ফুল শাপলা। গ্রামের শিশুকিশোরেরা দল বেঁধে শাপলা তুলতে যায়। শরৎকালকে শুভেচ্ছাবাহক ঋতু হিসেবে বিবেচনা করেছেন শিল্পী–সাহিত্যিকেরা। শান্তির সময় আর ফুল-পাখিদের মৌসুম এটি। বাংলার এ অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়া কবি–সাহিত্যিকেরা অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে শরৎকাল প্রথম দেখা হওয়ার সময়, না-ভুলবার সময়, আর বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভের সময়। হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে মনে করার সময় হিসেবেও শরৎকাল গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রামারজ বেঘারির ‘মাই ওটাম গার্ল’ শীর্ষক একটি কবিতা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে: ‘তোমার শরৎ ঠোঁট, শরৎ চুল, শরৎ চোখ, শরৎ হাসি, শরৎ গ্রীবা—আমি শরৎকালে স্রষ্টাকে চুম্বন করি।’ শরৎকালকে নিয়ে কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

‘আহা কি তোমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাতা বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলধার
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাক আর…
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।’

শরতের অন্যতম বড় আকর্ষণ কাশফুল! নদীতীরে বনের প্রান্তে। কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ পাওয়া মেলা ভার। তাই মহাকবি কালিদাস তাঁর ঋতুসংহার কবিতায় বলেছেন, ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’

গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। গাঁয়ের ছেলেরা পাটকাঠি আর নাইলন সুতা দিয়ে বড়শি বানায়। সারি বেঁধে আদুল গায়ে ধানখেতে মাছ ধরে। টেংরা, পুঁটি, কৈ। বর্ষাকে বিদায় জানিয়ে শীতের আগমনী বার্তা শোনা যায় এ ঋতুতে। শরৎকালেও বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। এ বৃষ্টিতে ভিজে নিজের আনন্দকে যেন অনেকখানি বাড়ানো যায়। চারপাশের শুভ্রতার মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন, ‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে/শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।/ তাত না দেখিবোঁ যঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ/ চিনিতে মোর ফুট জায়িবে বুক।’

শরতের এত রূপ, এত ঐশ্বর্য, এত মোহ, এত বৈচিত্র্য, এত রংধনুর রং, এত নীল আকাশের নীলা, এত ছায়াপথের আলোছায়া, এত সূর্যাস্তের রক্তরাগ, এত ভোরের শিশির, এত কাশফুলের হেলাদোলা, ঘোমটা টানা গাঁয়ের বধূ অথবা আধুনিক সাজের শহুরে তরুণী—এত রূপ এত রং এ বাংলার সচরাচর ছাড়া আর কোথায় পাব। চোখ জুড়িয়ে যায়।

প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। হয়তো ইচ্ছা হয় গোধূলির ওপারে হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে। এতসব গুণাবলি শুধু বাংলায় থেকে পাই। তাই তো বলি ‘আমি গর্বিত,আমি গর্বিত আমি বাঙালি।’ স্রষ্টার সৃষ্টির এ আকর্ষণ থেকে কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পর আবার এ বাংলায় ফিরে আসতে চান। তাই তিনি বলেন,

‘আবার আসিব ফিরে, ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়,
তবু আমার আসিব ফিরে।’

  • লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *