শান্তির দেশে শান্তির ফতওয়া [দ্বিতীয় পর্ব]

শান্তির দেশে শান্তির ফতওয়া [দ্বিতীয় পর্ব]

ওআইসিতে কুতুবে বাঙাল

আরীফ উদ্দীন মারুফ  ● ভাই ইলিয়াসের বাসায় : মাওলানা ইলিয়াস খান আমার ছাত্র যামানার একান্ত ঘনিষ্ঠজন ও আন্তরিক বন্ধু। যদিও তিনি আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কিতাবের মোযাকারা ও পাঠ পর্যালোচনার খাতিরে আমার সঙ্গে অকৃত্রিম হৃদ্যতা রাখতেন। দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর যাবত পরিবারসহ জেদ্দা থাকেন। পুরনো বন্ধুত্বের দাবি বলি কিংবা তার পরিবারের হৃদয় নিংড়ানো আতিথেয়তার কথা বলিÑ যে টানেই হোক যখনই হজব্রত পালনের উদ্দেশে মক্কা মোকাররমা গমন করি তখন একদিনের জন্য হলেও তার বাসায় হাযির হই। বরং হাযির হতে বাধ্য হই। রসিকতা করে আমি বলি, তার বাড়ি হলো সৌদি আরবে আমার লজিং বাড়ি। কেবল আমিই নই। তার অকৃত্রিম আতিথেয়তা ও আন্তরিক ভালোবাসা গ্রহণ করেনি ঢাকার বড় আলিমদের খুব কম জনই আছেন। বিশেষ করে হজের মওসুমে তার বাসা আমাদের আসাতিযা ও মাশাইখে কিরামের মেহমানখানায় রূপান্তরিত হয়।

যাই হোক, জেদ্দা গিয়েছি আর ভাই ইলিয়াসের বাসায় যাবো না এটা হতে পারে না। প্রথমে তিনি মোবাইলে আমাদের আগমনের খোঁজখবর নেন। এরপর আসর বাদ সরাসরি আমাদের কিয়ামগাহে হাযির হন। ইমাম ফরীদকে রাতে বাসায় তাশরিফ গ্রহণের আন্তরিক দাওয়াত দেন। এ কথাও জোর দিয়ে বলেন, হুযূর! এখানে না থেকে সকলে আমাদের বাসায় অবস্থান করলেও আমরা নিজেদেরকে ধন্য মনে করবো। ইমাম ফরীদ তার দাওয়াত কবূল করলেন।

ঈশার সালাত নিজেরা জামাত করে আদায় করি। এরই মধ্যে দূতাবাসের গাড়ি চলে আসে। আমরা সবাই মাওলানা ইলিয়াসের বাসার উদ্দেশে রওনা দেই। ড্রাইভার সাহেব বাসার ঠিকানা চিনতে পারছিলেন না। মাওলানা ইলিয়াসের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেই। সিদ্ধান্ত হয় তার বাসার কাছেই বড় একটি শপিং মল আছে। নাম লু লু। সেখানে অপেক্ষা করবো। ইলিয়াস তার গাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসবে। আমাদের গাড়ির রাহবার হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। এতে ড্রাইভারের চিনতে আর কোন পেরেশানি হবে না।


ইমাম ফরীদকে একবার দেখলাম একাকী দাঁড়িয়ে সমুদ্রের তরঙ্গ দেখছেন। পাশে গিয়ে আমিও দাঁড়ালাম। বললেন, সমুদ্র দেখার দ্বারা দৃষ্টি প্রসারিত হয়


 

ইমাম ফরীদকে একবার দেখলাম একাকী দাঁড়িয়ে সমুদ্রের তরঙ্গ দেখছেন। পাশে গিয়ে আমিও দাঁড়ালাম। বললেন, সমুদ্র দেখার দ্বারা দৃষ্টি প্রসারিত হয়উস্তাদ উস্তাদই আর ছাত্র ছাত্রই : ভাই ইলিয়াসের বাসায় পৌঁছে ড্রইং রুমে কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়। তারপর সবাই ভিতরের রুমে যাই। দস্তরখানে খানার আইটেম দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। অল্প সময়ে কিভাবে এতো আইটেম পাক হয়ে গেলো ভেবে সবাই অভিভূত হই। বিভিন্ন ধরনের মাছ থেকে শুরু করে দেশি মোড়গের তরকারি সবই ছিলো, স্বাদেও অপূর্ব। খানা শেষ করার পর ঘরে বানানো দই পরিবেশন করা হলো। আমরা যখন দইয়ের স্বাদ গ্রহণ করছি তখন ভাই ইলিয়াস খ্যাতিমান আদীব মাওলানা আবু তাহের মেছবাহ সাহেব হুযূরের একটি রসেভরা ঘটনা উল্লেখ করলো।

একবার আদীব সাহেব হজের মওসুমে তার বাসায় মেহমান হয়েছেন। সঙ্গে তার মোহতারামা বেগম। খানার সঙ্গে বাসায় বানানো এই দইও পরিবেশন করা হয়েছে। দই খেয়ে আদীব সাহেব বড় অভিভূত হলেন। বললেন, ইলিয়াস, তোমার বেগমকে বল আমার মোহতারামাকে যেন এই দই তৈরির কলাকৌশল শিখিয়ে দেয়। উস্তাদের নির্দেশ পালন করা হলো। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগের তীব্রতার কারণে কেবল মাসে একবার তিনি তা খাওয়ার অনুমতি পেলেন সতর্ক ঘরওয়ালীর পক্ষ থেকে। পরের বছর যখন আবার ইলিয়াসের বাসায় গমন করেন। খানা শেষে পরিবেশিত হয় স্বাদের সেই দই। দস্তরখানে তখন আরো কতিপয় মেহমান। দই খেয়ে আদীব সাহেবকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে একজন মেহমান জিজ্ঞেস করলেন, হুযূর, আপনি নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছেন মনে হয়। মাথা তুললেন আদীব সাহেব। আবারো তার স্বভাবসুলভ ধীরতা ও নিরবতা। এরপর বললেন, না, আমি ভাবছিলাম, উস্তাদ উস্তাদই আর ছাত্র ছাত্রই। ইলিয়াসের বেগম আমার ঘরওয়ালীর দই শিক্ষিকা। কিন্তু আজ দই খেয়ে বুঝলাম উস্তাদই শ্রেষ্ঠ।


হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বাংলাদেশের উপর আমাদের আস্থায় ভাটা পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন দেখলাম যে, যেখানে সব ইসলামিক স্কলার এর বিরুদ্ধে একত্র হয়েছেন সেখানে তারা কখনও সফল হতে পারবে না


খানা শেষে মাওলানা ইলিয়াস আমাদেরকে সমুদ্র সৈকত যিয়ারতের তাশকিল শুরু করে দিলো। তাও ছিলো তার বাসার কাছেই। আমাদের সফর সঙ্গীদের মাঝে আবদুল আলীম ও সাঈদ ভাই খুবই আগ্রহী ছিলেন। ইমাম ফরীদ তেমন কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। শেষে ভাই ইলিয়াস হযরতুল আল্লামা কাযি সাহেব হুযূরের ঘটনা শুনালেন। একবার হজের মুওসুমে ফ্লাইট ঢিলে হওয়ার কারণে এ্যায়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ হোটেলে নিয়ে যায়। প্রায় দেড়দিন সেখানে অবস্থান করতে হয়। তখন ভাই ইলিয়াস কাযি সাহেব হুযূরের খানা নিয়ে যান। হোটেলের বদ্ধ পরিবেশে হুযূর অতীষ্ঠ। ইলিয়াস হুযূরকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যান। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ দেখে কাযি সাহেব হুযূরের সাহিত্য রসবোধ জেগে উঠে। সমুদ্র তটে উত্তাল তরঙ্গের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কাযি হুযূর এতটা আবেগতাড়িত হয়ে যান যে সেখানে বসেই তিনি রবি-নজরুলের বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দেন।

যাই হোক, সবার আগ্রহে মাওলানা ইলিয়াসের বাসায় বসেই সিদ্ধান্ত হয় আওয়াল ওয়াক্তে ফজর আদায় করে আমরা সমুদ্র সৈকত দেখতে যাবো। সে মতে ভাই ইলিয়াস ফজরের আযানের কয়েক মিনিট আগেই গাড়ি নিয়ে আমাদের কিয়ামগাহে হাযির। জামাত করে সালাত আদায় করি। এরপর সমুদ্র সৈকত দেখতে বের হয়ে পড়ি।

জেদ্দা সমুদ্র সৈকতে : ফজরের আযান তখনো শুরু হয়নি। ভাই ইলিয়াস তার গাড়ি নিয়ে হাযির। আমরাও সবাই প্রস্তুত। আমাদের কিয়ামগাহের পাশেই একটি মসজিদ ছিলো। আযান হলে ভালোভাবেই শুনা যেতো। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই মসজিদের আযান ধ্বনি ভেসে এলো। আমরা নিজেরা জামাত করে সালাতুল ফজর আদায় করলাম।

সমুদ্র সৈকতে যখন পৌঁছি তখন পরিবেশ বেশ ফর্সা। বহু লোক পরিবার ও বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সমুদ্র তটে বসে আছে। সমুদ্রতটের নির্মল পরিবেশে কাউকে দেখলাম মর্নিংওয়াকের কাজ সেরে নিতে। ভাই ইলয়াস তার গাড়ি থেকে একটি গালিচা বের করে সমুদ্রতটে তা বিছানোর ব্যবস্থা করলেন। ইমাম ফরীদ এবং আমরা সবাই সেখানে বসে প্রাতরাশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। নাশতা যথেষ্ট পরিমাণে ঘর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। নির্মল উপভোগ্য পরিবেশে বেশ আয়েশ করে আমরা সকালের নাশতা করি। এরপর কিছু সময় সমুদ্রতটে হাঁটাহাঁটি করি। ইমাম ফরীদকে একবার দেখলাম একাকী দাঁড়িয়ে সমুদ্রের তরঙ্গ দেখছেন। পাশে গিয়ে আমিও দাঁড়ালাম। বললেন, সমুদ্র দেখার দ্বারা দৃষ্টি প্রসারিত হয়। আমার তখন মনে পড়তে লাগলো সমুদ্র সৈকত ভিজিট করার বিভিন্ন উপকারিতার কথা।

ওআইসি মহাসচিবের সদর দপ্তরে : সমুদ্র সৈকত থেকে ফিরে এসে আমরা তাড়াহুড়ো করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার চিন্তা করি। কেননা আজ সাড়ে দশটায় আমাদের মূল প্রোগ্রাম। ওআইসি মহাসচিব মহোদয়ের সঙ্গে গ্র্যান্ড মুফতি ও ইমামের সিটিং। দেড় ঘণ্টা বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার জন্য যখন ব্যস্ত তখন ভাই আমান জানালেন। মন্ত্রণালয়ে মহাসচিব মহোদয়ের জরুরি একটা মিটিং পড়ে গেছে। তাই সিটিং টাইম পরিবর্তন করে দুপুর একটায় করা হয়েছে। ঘড়িতে যখন সারে বারোটা তখন আমি ভাই আমানকে মোবাইল করি। রওনা দেবো কিনা জানতে চাইলে তিনি জোরালোভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ এখনিই রওনা দিয়ে দিন।

আমাদের কিয়ামগাহ থেকে ওআইসি সদর দপ্তর তেমন দূরে ছিলো না। দূতাবাসের গাড়ি নিয়ে বেশ অল্প সময়েই সদর দপ্তরে পৌঁছে যাই। গাড়ি থেকে নেমে দেখি কয়েকজন আমাদের স্বাগতম জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। যাদের মধ্যে ভাই আমান, মাননীয় রাষ্ট্রদূত মহোদয়, কনস্যুলার জেনারেল এবং আরো একজন। চেহারা সুরতে বিদেশি। বাংলাদেশি বলে মনে হলো না। অফিসিয়াল কেউ হবেন। গাড়ি থেকে নেমে ইমাম ফরীদ সবার সঙ্গে মোআনাকা ও মোসাফাহা করলেন। প্রাথমিক হাল পুরসি করলেন। রাষ্ট্রদূত জনাব গোলাম মসীহকে দেখলাম ইমাম ফরীদকে খুবই ইকরাম ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করছেন। স্যার সম্বোধন ছাড়া কথা বলছেন না। ভাই আমান লিফট করে আমাদেরকে উপর তলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি বিশাল রুমে বসালেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন ভদ্রলোক হাযির হন। মনে হয় ইমাম ফরীদ পূর্ব থেকে তাকে চিনতেন। তাই রুমে প্রবেশ করতেই ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তার সঙ্গে মোআনাকা করলেন। পরে অবশ্য ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে পেরেছি। নাম ড. বশীর আনসারি। আফগান আমেরিকান। আমেরিকাতেই বড় হয়েছেন এবং পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ওআইসির ডায়ালগ ও আউটরিচ ডিপার্টমেন্টের পরিচালক। ভদ্রলোক শন্তির ফাতওয়া নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। রাষ্ট্রদূত মহোদয় বললেন, বর্তমান প্রেক্ষিতে ইমাম সাহেবের এই পদক্ষেপটির গুরুত্ব অপরিসিম। ড. আনসারি বললেন, নিঃসন্দেহে। কেননা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস সমস্যা বর্তমানে আমেরিকা নন আমেরিকা সকলের চিন্তা ও পেরেশানির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনার এই ফাতওয়া আমরা ওআইসির ওয়েবসাইটে প্রচারের ব্যবস্থা করবো। আরেকটি কাজ করতে পারেন। তা হলো, এই ফাতওয়া থেকে নির্বাচিত অংশ এক দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে দিলে আমরা তাও প্রচারের ব্যবস্থা করবো।

ইমাম ফরীদ বললেন, আল হামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তাআলার মেহরবানি এই ফতওয়ার প্রভাব আমাদের দেশে এতটা হয়েছে যে, সন্ত্রাসীরা ইসলাম কোরআন এবং হাদীসের নামে মানুষকে যে ধোঁকা দিচ্ছিলো তা দূর হয়ে গেছে। আমাদের দেশে এই ফাতওয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মোবাইলে এর একটা এ্যাপসও তৈরি করে দিয়েছি। সেখানে প্রশ্নোত্তরের অপশনও রাখা হয়েছে। বিরোধীরা এখন পর্যন্ত এর কাউন্টার দিতে পারেনি। কিছুদিন আগে আমি জাপান গিয়েছিলাম। সে দেশের ডিপুটি ফরেন মিনিস্টার আমাকে নিজে বলেছেন, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বাংলাদেশের উপর আমাদের আস্থায় ভাটা পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন দেখলাম যে, যেখানে সব ইসলামিক স্কলার এর বিরুদ্ধে একত্র হয়েছেন সেখানে তারা কখনও সফল হতে পারবে না। এই ফাতওয়া প্রকাশের পর আমাদের আস্থা আবার ফিরে এসেছে। ইমাম ফরীদ যখন ড. আনসারীর সঙ্গে এ কথাগুলো বলছিলেন তখন ভাই আমান প্রবেশ করে এবং সবাইকে মহাসচিব মহোদয়ের রুমে হাযির হওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করে।

সবাই উঠে দাঁড়ালাম। মহাসচিব মহোদয়ের রুমে আস্তে আস্তে অগ্রসর হলাম। দেখলাম মহাসচিব মহোদয় তার রুম থেকে বের হয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছেন। ইমাম ফরীদকে দেখা মাত্রই আরবীয় ঐতিহ্যের বিভা ছড়িয়ে আহলান ওয়া সাহলান বলতে বলতে ইমাম ফরীদকে স্বাগতম জানালেন। মোসাফাহা ও আলিঙ্গন করলেন। প্রাথমিক হাল পুরসির পর স্বীয় দপ্তরে অগ্রসর হলেন। ইমাম ফরীদ আরবীতে কথা বলা শুরু করেন। বললেন, হে শাইখ! সুদূর বাংলাদেশ থেকে সফর করে আসার মূল উদ্দেশ্য আমার একটাই। তা হলো আপনার সঙ্গে মোলাকাত ও মিটিং করা। শাইখ বললেন, আল্লাহর মেহেরাবনি যে তিনি আপনাদেরকে বিলাদুল হারামাইনে উপস্থিত করেছেন। ইমাম ফরীদ বললেন, আমরা সৌদি আরবের লোকদের অনেক ভালোবাসি। তিনি আমাদের সবাইকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন।

আমরা এখন মহাসচিব মহোদয়ের রুমে। পাশাপাশি দুটি রাজকীয় চেয়ার। মাঝে একটি ছোট্ট টেবিল। তাতে ওআইসির লগো সম্বলিত একটি শো পিস। ঠিক পিছনে একটি বড় ফ্ল্যাগ। ডান দিকের চেয়ারে শাইখ বসলেন। পাশের চেয়াটিতে অর্থাৎ তার হাতের ডান দিকে ইমাম ফরীদকে বসার অনুরাধ করলেন। সামনে আরো অনেকগুলো চেয়ারের সারি। ডান পাশে সদর দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তগণ বসেছেন। আর বাম পাশের সারিতে আমাদের দূতাবাসের প্রতিনিধিবৃন্দ। ঠিক সামনের কয়েকটি চেয়ারে আমরা ক’জন। ইমাম ফরীদের সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য যারা অর্জন করেছি।

মহাসচিব মহোদয় বললেন, আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশ আমাদের অত্যন্ত প্রিয় একটি দেশ। বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি যে সহানুভূতি সে জন্য গর্ববোধ করি। এরপর তিনি ইমাম ফরীদকে তার আলোচনা পেশ করার জন্য সবিনয় অনুরোধ করেন।

ইমাম ফরীদ প্রথমে অনুমতি প্রার্থনা করেন তার আলোচনা বাংলায় পেশ করার। বললেন, আপনি অনুমতি দিলে ভাই আমান আমার কথা ইংরেজীতে তরজমা করে দিবে। গ্র্যান্ড ইমাম ও মুফতি তার বক্তব্য শুরু করেন এভাবে-

আমি প্রথমে আল্লাহ তাআলার হামদ ও প্রশংসা এবং শোকরিয়া আদায় করছি। তিনি আমাকে মেহরবানি করে আরদে মোবারাকা হারামাইনের পবিত্র দেশে হাযির করে দিয়েছেন। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে আপনার ও আপনার দপ্তরের কৃতজ্ঞতাও আদায় করছি কারণ আগামী বছর ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের মহাসম্মেলন আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত আপনারা গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে আবেগময় অনুভূতি পোষণ করেন। নিজেকে সবসময় তিনি পরিচয় দেন আমি একজন পুরোপুরি সু্িন্ন মুসলমান।

আমি প্রথমে আপনার সঙ্গে যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস গোটা বিশ্বে বর্তমানে এক বড় সমস্যারূপ ধারণ করেছে বিশেষত ইসলামের নাম ব্যবহার করে সে সম্পর্কে আলোচনা করতে চাচ্ছি। আমার মনে পড়ে যখন টুইন টাওয়ারের ঘটনা ঘটে তখন আমি ছিলাম লন্ডনে। সে সময় কোন কোন মুসলমানকে আমি এ ঘটনায় খুব খুশি হতে দেখি। তখন কেন জানি আমার মনে হলো এই ঘটনা মুসলমানদের জন্য সামনে বিপদের কারণ হবে। এরও বেশ কিছুদিন পর আমার সঙ্গে বিবিসির এক সাংবাদিক সাক্ষাত করেন। তিনি কান্নার সুরে আমাকে বলছিলেন যে, সাংবাদিক হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশে সফর করতে হয়। ইমিগ্রেশনে সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে আমাকে রেস্পেক্ট করা হয় কিন্তু যখন নামের শুরুতে মুহাম্মাদ দেখে তখন কেমন যেন তাদের চেহারায় পরবর্তন দেখতে পাই। হুযূর! আমি তো আমার নাম থেকে মুহাম্মাদ শব্দটি কাটতে পারবো না। সুতরাং আপনারা কিছু করেন। আপনারাই পারবেন এ অবস্থার পরিবর্তন সৃষ্টি করতে। আপনারাই পারবেন জনগণকে একথাটা বুঝাতে যে মুহাম্মাদ এবং ইসলামের সঙ্গে এই সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই। তখন এবং এরপরে আরো কিছু ঘটনা ঘটে। যে কারণে আমি এই সম্পর্কে আরো পড়াশোনা শুরু করি এবং উলামায়ে কিরামকে এ বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক করি। আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা যা মূলত অরাজনৈতিক। এই জমিয়তের উদ্যোগে আমরা আলিমগণের একটি সম্মেলন আহ্বান করি। তখন সকল উলামায়ে কিরাম মিলে আমরা চিন্তা করলাম যে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যার একটা কাউন্টার নেরেটিব হওয়া উচিৎ। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা কোরআনের যেসব আয়াত এবং মহানবীর যেসব হাদীসের অপব্যাখ্যা করে পেশ করে, তাদের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করে আমরা তার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে একটি ফাতওয়া প্রকাশ করি। আমার ইচ্ছা এর একটা নমুনা কপি আপনার হাতে অর্পণ করবো। এই ফাতওয়া এক লক্ষ আলিম মুফতি ও ইমামের স্বাক্ষর সম্বলিত। অতিরিক্ত দশ হাজার মহিলা আলেমাদেরও স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। দশটা প্রশ্নের আকারে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।


আমার নাম থেকে মুহাম্মাদ শব্দটি কাটতে পারবো না। সুতরাং আপনারা কিছু করেন। আপনারাই পারবেন এ অবস্থার পরিবর্তন সৃষ্টি করতে। আপনারাই পারবেন জনগণকে একথাটা বুঝাতে যে মুহাম্মাদ এবং ইসলামের সঙ্গে এই সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই

 

আল্লাহ তাআলার মেহরবানি ও ফযল ও করম যে, এই ফাতওয়া প্রকাশের পর এর অসাধারণ প্রভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছিলো তা সত্যিই মর্মান্তিক। এই ঘটনার পর বিদেশিদের অনেকের বাংলাদেশের উপর অনাস্থা ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছিলো। বিশেষ করে জাপান ও ইতালির ব্যবসায়িদের মাঝে। কিন্তু আল হামদুলিল্লাহ! এই ফাতওয়া ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পর তাদের আস্থা ফিরে এসেছে। আমাকে জাপানের পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী বলেছেন, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু যখন দেখলাম, সব আলিম ও ইসলামিক স্কলার যেখানে এক জোট হয়ে এদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন সেখানে টেররিস্টরা কখনোও সফল হতে পারবে না। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র্রমন্ত্রীও আমাকে একই কথা বলেছেন।

আন্তর্জাতিকভাবেও এই ফাতওয়া সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকবৃন্দ আমাকে তাদের উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছেন। ফ্রান্সের এক সাংবাদিক তো তার উচ্ছ্বাসের কথা প্রকাশ করতে যেয়ে একথা বলেছেন যে, শান্তিতে এ পর্যন্ত যারা নোবেল প্রাইজ লাভ করেছেন তারা আপনার চাইতে বেশি কিছু করেননি। সাবেক মহাসচিব মহোদয় জনাব ইয়াদ মাদানি যখন ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন তখন আমার সঙ্গে বসেছেন এবং প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেছেন। বিষয়টাকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। মৌলিকভাবে আমার যে বর্তমানে আসা তিনিই আমাকে দাওয়াত করেছিলেন। বলেছিলেন, আপনি আমাদের সদর দপ্তরে আসেন। আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

যাই হোক, আল্লাহর মেহেরবানি ও ফযল করম, আমাদের এই পদক্ষেপটি মুসলিম অমুসলিম সকলের কাছে গ্রহণীয় হয়েছে। এমনকি পোপও আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কেবল একারণে যে আমি মানুষকে হিংসা ও হানাহানি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। এই ফাতওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দেশ আমি সফর করেছি। তারা আমাকে রিপোর্ট দিয়েছেন যে, ইসলাম সম্পর্কে তাদের যে ভুল বুঝাবুঝি ছিলো তা দূর হয়ে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে ইসলাম কোন বর্বর ধর্ম নয়। বরং শান্তি ও ভালোবাসার ধর্ম। আমি আবারো আপনার শোকরিয়া আদায় করছি আমাকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার জন্য। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো এই তিরিশ খ-ের ফাতওয়াটি আপনার হাতে তুলে দিতে পারলে। সঙ্গে সঙ্গে আরো একটি কথা আপনার সমীপে আরজ করতে চাই। তাহলো- বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা সে দেশের আলিম উলামা ইসলাম ও মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে। ওআইসি এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।

ইমাম ফরীদের বক্তব্য ও আলোচনা শেষ হওয়ার পর মহাসচিব মহোদয় রাষ্ট্রদূত জনাব গোলাম মসীহকে কিছু কথা বলার অনুরোধ করেন। তিনিও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ইংরেজীতে অতি সংক্ষেপে চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশে ইসলাম এবং সরকারের বিভিন্ন ভালো দিক আলোচনা করেন। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ইমাম ফরীদের জ্ঞান এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার কথাও আলোচনা করেন। রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের কথা শেষ হলে শাইখ উসাইমিন তার কথা শুরু করেন।

ওআইসি মহাসচিব মহোদয়ের বক্তব্য : তিনি প্রথমে সবাইকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। বলেন, আমি আপনাদের মতো নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। ওআইসির সদর দপ্তরে আপনাদের সবাইকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন ও সুস্বাগতম। গ্রান্ড ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমি অনেক খুশি হয়েছি এবং আশা করছি সামনে ইনশাআল্লাহ আরো ব্যাপক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হবে। আমি যখন প্রথম আপনার কথা শুনি যে, বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান ইমাম ও মুফতি আমাদের এখানে তাশরিফ আনয়ন করবেন তখন মনে মনে ভেবেছিলাম অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ দুর্বল একজন ব্যক্তি। যাকে ধরে ধরে আনতে হবে। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে আপনি অনেক সুদর্শন স্মার্ট ও শক্তিশালী ব্যক্তি। তাই আমার বলতে ইচ্ছে করছে জানি না আপনার কতজন স্ত্রী আছেন। যদি একজন থাকেন তাহলে আরো একজন স্ত্রী আপনি কোনো দ্বিধা ছাড়া গ্রহণ করতে পারেন। মহাসচিব মহোদয়ের এই রসিকতায় সবাই হেসে উঠেন। পুরো মজলিসটাই প্রাণবন্ত হয়ে যায়।

এরপর শাইখ বলেন, বাংলাদেশ ওআইসির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ওআইসির বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা বাংলাদেশকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করি। সবাই জানে যে বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তর মুসলিম দেশসমূহের অন্যতম। আমরা সবসময় বাংলাদেশের জন্য দুআ করি যাতে শান্তি ও স্থীতিশীলতা বজায় থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসি। সেখানকার নেতা নেত্রীদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণাপোষণ করি। বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখি। বাংলাদেশের মানুষ কত ভালো। আমার অফিসে আমান তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

একটা মডার্ন মুসলিম দেশের মডেল হিসেবে সব জায়গায় আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করি। মুসলিম হোক আর নন মুসলিম সবখানেই আমি একথা বলি যে, ইসলামে নারীর মর্যাদা কত উঁচু তা শেখ হাসিনাকে দেখলেই বুঝা যায়। আমি একথাও বলি, বাংলাদেশের মতো বৃহত্তর একটি মুসলিম দেশের নেতৃত্বে আছেন একজন মহিলা।

● অক্টোবর ২০১৭, মাসিক পাথেয়, আলোর মিনার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *