শান্তির দেশে শান্তির ফতওয়া

শান্তির দেশে শান্তির ফতওয়া

আলোর মিনার ● ওআইসিতে কুতুবে বাঙাল ● আরীফ উদ্দীন মারুফ

শোকর আল হামদুলিল্লাহ! আল্লাহর ফযল ও করম এবং মেহরবানি। আল্লাহ তাআলা তিনটা আশাই পূরণ করলেন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়াটি তৈরি হওয়ার পর আশা ছিলো, এক কপি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পণ করবো, এক কপি জাতিসংঘে এবং আরেক কপি ওআইসি-এর সদর দপ্তরে হস্তান্তর করবো। আল্লাহর মেহরবানিতে তৃতীয় আশাটিও পূরণ হয়ে গেলো। দয়াময়ের শোকরিয়ায় আপ্লুত গ্র্যান্ড ইমাম ও মুফতি শাইখ ফরীদ উদ্দীন মসঊদ দা.বা. এভাবেই তার হৃদয়োৎসারিত আবেগ প্রকাশ করছিলেন ওআইসি মহাসচিব মহোদয় ড. ইউসুফ আল উথাইমিনের সঙ্গে দীর্ঘ মিটিং শেষ করে। আমরা তখন জেদ্দাস্থ ওআইসি সদর দপ্তর থেকে ফিরছিলাম হোটেল লা-সানির উদ্দেশে।

আরও গোড়া থেকে বলি
গত বছর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে যে বিপুল সাড়া লাভ হয়েছে সত্যিই তা একমাত্র রাব্বুল আলামীনের মেহেরবানি। ও আই সির সাবেক মহাসচিব শাইখ ইয়াদ মাদানি মাত্র তিনদিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এক লক্ষ আলিম, মুফতি ও ইমামের স্বাক্ষরিত ফতওয়াটির কথা শুনে বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন শোলাকিয়ার গ্যান্ড ইমাম ও মুফতির সঙ্গে মিটিং করার জন্য। অধমও হাযির ছিলাম সেই মজলিসে। তখনই তিনি ইমামকে বিশেভাবে দাওয়াত করেছিলেন জেদ্দাস্থ তার সদর দপ্তরে। কিন্তু আল্লাহর মর্জি ও ফয়সালা, কয়েকমাস পরই একান্ত ব্যক্তিগত কারণে তিনি তার পদ থেকে ইস্তফা দেন। দায়িত্বগ্রহণ করেন বর্তমান মহাসচিব ড. উথাইমিন। বাংলাদেশ সরকারের ফরেন মিনিস্ট্রির তরফ থেকে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করে জানান, তিনি কুতুবে বাঙালের সঙ্গে বসতে চান। আঠারো জুলাই ২০১৭ বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করে তার পক্ষ থেকে বিশেষ দাওয়াতনামাও পাঠিয়ে দেন।
শুভ সংবাদটি ইমাম ও গ্র্যান্ড মুফতি নিজেই মোবাইল করে আমাকে জানান। দিনটি ছিলো সোমবার। মে মাসের তেরো তারিখ। বেলা তখন এগারোটার কিছু পর। আমি তখনোও বাসায়। জামিআ ইকরায় রওনা করবো। প্রস্তুুতি গ্রহণ করছি। ইমাম ফরীদ কল করলেন। বললেন, ও আই সি মহাসচিব আঠারই জুলাই দাওয়াত করেছেন। সুখবরটি শুনে আনন্দিত যেমন হই আবার একটু অস্থিরতাও অনুভব করতে থাকি। পেরেশান হওয়ার কারণ ছিলো আমার হজে গমনের ফ্লাইট ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে সাতাইশে জুলাই। বিষয়টি ইমাম ফরীদকে জানালাম। তিনি ডিরেক্ট হুকুম করলেন, হজের ফ্লাইট পিছায়া দিতে বল। আমিও জী আচ্ছা বলে সম্মতি জানিয়ে দেই।


ও আই সি মহাসচিব আঠারই জুলাই দাওয়াত করেছেন। সুখবরটি শুনে আনন্দিত যেমন হই আবার একটু অস্থিরতাও অনুভব করতে থাকি। পেরেশান হওয়ার কারণ ছিলো আমার হজে গমনের ফ্লাইট ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে সাতাইশে জুলাই। বিষয়টি ইমাম ফরীদকে জানালাম। তিনি ডিরেক্ট হুকুম করলেন, হজের ফ্লাইট পিছায়া দিতে বল। আমিও জী আচ্ছা বলে সম্মতি জানিয়ে দেই।


সফর শুরু

সফরের তারিখ ঠিক করা হয় চৌদ্দই জুলাই। আমরা ছিলাম পাঁচজন। ইমাম ফরীদ, সাহেবযাদা মাওলানা মাকনূন, নূরের চালার মৌলভী আবদুল আলীম, ইসলাহুলের সাঈদ ভাই এবং অধম আমি। ফ্লাইটের সময় ছিলো রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ। বি জি ০৩৫। বিকেল পাঁচটার দিকে ইমাম ফরীদের বাসায় হাযির হই। আছরের সালাত সেখানেই আদায় করি। কিছুক্ষণের মধ্যে আবদুল আলীম এবং সাঈদ ভাইও হাযির হয়। আমরা বিকাল ছয়টারও কিছু পর বাসা থেকে বের হই। বিমান বন্দরে পৌঁছে আদায় করি সালাতুল মাগরিব।

ভিআইপি লাউঞ্জে
আমি সাঈদ ভাই এবং ইমাম ফরীদ সোফায় বসে আছি। বাকি দুজন, স্নেহাষ্পদ মাকনুন এবং মাওলানা আবদুল আলীম গেছেন মালামাল বুকিং ও ইমিগ্রেশনসংক্রান্ত ফরমালিটিজ সম্পন্ন করার জন্য। সোফায় গা এলিয়ে বসে আছি। ক্ষণে ক্ষণে ইমাম ফরীদকে দেখছি। গত কয়েক বছর হয় হার্টের রোগী তিনি। সঙ্গে বয়সের ছাপ। তাছাড়া মাত্র দু’দিন হলো সুদূর আইভোরি কোস্ট সফর করে এসেছেন। রাজধানী আবিদজানে ওআইসি-ভুক্ত দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন ছিলো। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে ইমাম ফরীদও ছিলেন সেই সম্মেলনের একজন সম্মানিত অতিথি। সফরেরভারে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো তাকে। শরীরে হালকা সর্দি জ্বরও ছিলো। কিছুক্ষণ পর পর নাক পরিষ্কার করছিলেন। আমি তাকিয়ে দেখি আর দিলভরে দুআ করি। আল্লাহ তাআলা যেন তাকে সুস্থ রাখেন। শাইখুল হিন্দ রহ.- এর শান্তিবাদি আন্দোলনের পতাকা নিয়ে যেভাবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করছেন তা দৃষ্টে হৃদয় আর্শিতে শাইখুল হিন্দের প্রতিচ্ছবিই বিমূর্ত হয়ে উঠে। আল্লাহ তাআলা উম্মতের উপর তার সুশীতল ছায়াকে আরও বিস্তৃত করে দিন। আমীন।

আনমনা হয়ে বসে আছি। এমন সময় শুনতে পেলাম গ্র্যান্ড ইমাম মোবাইলে উর্দূতে কার সঙ্গে কথা বলছেন। কান দুটি সতর্ক হলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না শাইখুল হিন্দের পতাকাবাহী আরেক তরজুমান শায়েখ মাহমুদ মাদানি মোবাইল করেছেন। ইমাম ফরীদের শরীর ও স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছেন। সফরের কথাও ইমাম ফরীদ তাকে বললেন। আমি এবং মাকনুন সফরসঙ্গী হিসেবে আছি তাও জানালেন।

অল্প কিছুক্ষণের মাঝে আবদুল আলীম ও মাকনুন চলে এলেন। ফিসফিস করে জানালেন, ফ্লাইট ঢিলে। আটটা পয়তাল্লিশের বিমান কখন উড়াল দিবে ঠিক পরিষ্কার বুঝলাম না। শেষে আমরা ইশার সালাত আদায় করলাম। একজন ভদ্রলোক এলেন, ইমামের সঙ্গে দেখা করতে। বিমানের সম্ভবত উচ্চ পদস্থ অফিসার হবেন। তার মাধ্যমে জানা গেলা সাড়ে দশটার আগে ফ্লাই করবে না। আমরা সবাই আবার সোফায় গা এলিয়ে দেই। মৌলভী আবদুল আলীমের একটা কৃতিত্ব এখানে না বললে নয়। তা হলো তিনি তার জন্য এবং ইমাম ফরীদের জন্য বিজনেস ক্লাসের সিট ব্যবস্থা করেছেন। ইমাম ফরীদের কথা ভেবে অন্তরটা খুব খুশি হলো। আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম বদলা দান করুন।

বিমানের অফিসার আগের ভদ্রলোক আবার এলেন। তিনি ইমাম ফরীদকে রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য স্কাইহোটেলে নিয়ে যেতে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। শেষে ইমাম ফরীদ সম্মত হলেন। আমরা সকলে উপরের তলায় মুসলিম নামের একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম এবং খুব তাড়াহুড়া করে অল্প কিছু আহার করলাম। কারণ ফ্লাইটের সময় পার হয়ে যাচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলাম ভদ্রলোকের মোবাইলে বারবার তাড়া আসছিলো। শেষে বিমানের কাছে যখন গেলাম দেখি কেবল আমরা পাঁচজনই বাকি আছি। বাকি সবাই বিমানে চড়ে বসেছেন। অফিসার ভদ্রলোক ইমাম ফরীদকে সিটে বসিয়ে তারপর বিদায় নিলেন। আল্লাহ তাকেও উত্তম বদলা দান করুন।

শেষে বিমানের কাছে যখন গেলাম দেখি কেবল আমরা পাঁচজনই বাকি আছি। বাকি সবাই বিমানে চড়ে বসেছেন। অফিসার ভদ্রলোক ইমাম ফরীদকে সিটে বসিয়ে তারপর বিদায় নিলেন। আল্লাহ তাকেও উত্তম বদলা দান করুন।

ঢাকা বিমানবন্দরে এ্যায়ারবাসটি উড়াল দিতে দিতে প্রায় পৌনে এগারোটা বেজে গিয়েছিলো। আমি সাঈদভাই একসঙ্গে বসেছিলাম। বিমানের অনেক সীটই খালি ছিলো। কারণ সাধারণত যা বিমানের দূরাবস্থার কথা শুনি তাতে সহজেই অনুমেয় যে পারতপক্ষে বাংলাদেশ বিমানে কেউ আরোহন করতে চান না। যে বিমান নয়টা পয়তাল্লিশে উড়াল দেওয়ার কথা তা ছাড়তে ছাড়তে প্রায় পৌনে এগারোটা। তাছাড়া ভিতরে যে নড় বড়ে অবস্থা তাও রীতিমতো ঘাবড়ে যাওয়ার মতো। এসি ঠিকমতো কাজ করে না। মনিটরের খবর নেই। আমার সামনে দিয়ে একবার তো তেলাপেকার বাচ্চার নীরব বিচরণ লক্ষ্য করলাম। মাঝে মাঝেই সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বিমান সেবকসেবিকার রুঢ় ও কর্কশ ব্যবহার দেখে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম এ জন্য যে, এতো কিছুর পরও বিমান সংস্থা স্বগৌরবে টিকে আছে, বিলীন হয়ে যায়নি, অবশ্য আমাদের দুজনের সীট সামনের দিকে হওয়ার কারণে যথেষ্ট ফারাগাত ছিলো। পা প্রসারিত করে বসার সুব্যবস্থা। বিমানে পরিবেশিত ডিনার গ্রহণ করে একটু ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করি।

ছয় ঘণ্টা যে কিভাবে চলে গেলা টেরই পেলাম না। ঘোষণা শুনতে পেলাম, আর অল্প কিছুক্ষণের মাঝে আমরা জেদ্দা কিং আবদুল আজীজ এ্যায়াপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। শোকর আল হামদু লিল্লাহ।

বিমান থেকে নেমে বন্দর গেইটে প্রবেশ করতেই দেখা হয় ভাই নজরুলের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ এ্যামবেসির প্রটোকল অফিসার। রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের পক্ষ থেকে আমাদেরকে স্বাগত জানাতে এসেছেন। তিনি থাকাতে আমাদের ইমিগ্রেশন খুব সহজেই হয়ে যায়। তারপরও সৌদীদের কাজে কামে বিরক্তিকর ধীরতা সবার কাছে দৃশ্যমান। হজের মওসুমে তাদের এই অলসভাব হাজীদের মনে বড় বিরক্তি সৃষ্টি করে। আমি নিজে বহুবার দেখেছি, সারা রাত সারা দিন সফরে ক্লান্ত শ্রান্ত বয়োবৃদ্ধ হাজীসাহেবান একদিকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর অন্য দিকে ইমিগ্রেশন বক্সে বসে সৌদি অফিসারগণ গাওয়া পান করছেন কখনোও বা সঙ্গীদের সাথে রসিকতায় মেতে উঠছেন। লাইনে দাঁড়ানো বুড়ো বুড়ো লোকদের প্রতি তাদের যেন কোন খেয়ালই নেই। ওয়া ইলাল্লাহিল মোশতাকা।

তিরিশ খণ্ড ফতওয়ার বই নিয়ে বিপত্তি
যা হোক, ইমিগ্রেশন শেষ করে মালামাল নিয়ে আমরা সম্মুখিন হলাম স্কেন মেশিনে লাগেজ চেক করার স্থানে। তিরিশ খণ্ডেরর ফতওয়া বই নিয়ে আমরা আপত্তির মুখোমুখি হলাম ডিউটিরত ইমিগ্রেশন অফিসারের। প্রথমে তাকে বিস্তারিত বুঝাতে চাইলাম বইগুলো কিসের। কিন্তু হস্তান্তর করতে সম্মত হলেন না। বললেন, তথ্য মন্ত্রলায়ের অনুমতি ছাড়া এগুলো নেওয়া যাবে না। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই নিশুতী রাতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি কেমন করে লাভ করবো। ভদ্রলোক বললেন, আপনাদের একটি পাসপোর্ট দিন। আমার পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। একটা কাগজে তিনি কী যেন লিখলেন। পাশে একটি রুমে তা নিয়ে যেতে বললেন। ইমাম ফরীদকে পাশে বসার ব্যবস্থা করে নজরুল ভাইকে নিয়ে আমি গেলাম। রুমের দরজা লাগানো। নক করতেই দরজা খুলল। ভিতরে যে ভদ্রলোক ছিলেন সম্ভবত ঘুমুচ্ছিলেন। আমাদেরকে দেখে লাইট জ্বালালেন। চোখ কচলাতে কচলাতে কথা বলা শুরু করলেন। পুরো বিষয়টা আমি তাকে সবিস্তার বললাম। ফতওয়ার সার সংক্ষেপ আরবি একটি কপি তার হাতে দিলাম। বাংলা স্বাক্ষর সম্বলিত একটি খণ্ডও তাকে বের করে দেখালাম। তিনি কিছু সময় পাঠমগ্ন হলেন। ভাবলাম, এবার মনে হয় কাজ হবে। সমজদার লোকের কাছেই আছি। আমাদের বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাই আশা করি ছাড়পত্র তিনি দিয়ে দিবেন। কিন্তু আশাহত হলাম। নিরস মুখে তিনি বললেন, কাস্টমসের অফিস সকালে আটটায় খুলবে। সেখান থেকে বই গুলো বুঝে নিতে। হায় আল্লাহ! আমি আবার তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। এটাও বললাম, আগামীকাল ও আই সি মহাসচিবকে এটা অর্পণ করা হবে। তার পক্ষ থেকে প্রেরিত ইংরেজী দাওয়াতনামাও ভদ্রলোকের হাতে দিলাম। কাগজটি তিনি নিলেন ঠিকই। কিন্তু ইংরেজি একটা অক্ষরও তিনি বুঝেন কি না আমার সন্দেহ হলো। আবার কিছু সময় তিনি চিন্তা করলেন। এরপর সেই পুরনো গীতই আবার গাইলেন। বললাম, অন্তত একটা কপি নমুনা হিসাবে আমাদের সাথে নেওয়ার অনুমতি দিন। তিনি সম্মত হলেন না। আমার কেবল মনে পড়ছিলো এ যেন তালগাছ আমার এর চিরাচরিত বাণীর বিমূর্তায়ন। শেষে তিনি আগের লোকটিকে ডেকে একটা অফিসিয়াল লেটার লিখালেন এবং আমার হাতে তা ধরিয়ে দিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।


আবার কিছু সময় তিনি চিন্তা করলেন। এরপর সেই পুরনো গীতই আবার গাইলেন। বললাম, অন্তত একটা কপি নমুনা হিসাবে আমাদের সাথে নেওয়ার অনুমতি দিন। তিনি সম্মত হলেন না। আমার কেবল মনে পড়ছিলো এ যেন তালগাছ আমার এর চিরাচরিত বাণীর বিমূর্তায়ন। শেষে তিনি আগের লোকটিকে ডেকে একটা অফিসিয়াল লেটার লিখালেন এবং আমার হাতে তা ধরিয়ে দিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।


জরুরি পরামর্শ
অফিসারের রুম থেকে বের হয়ে ইমাম ফরীদের কাছে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, এটা তো আমাদের লাগবেই। সুতরাং দুআ করতে থাকো। আল্লাহ তাআলা যেন সহজ করে দেন। তিনি সবার কাছে পরামর্শ চাইলেন এখন আমরা কী করবো। মৌলভী আবদুল আলীম চট করে বলে দিলো, হুযূর! আমার মনে হয় আমরা সকলে মক্কা চলে যাই। আর মারুফ ভাই থাকুক। তিনি এটা পরে নিয়ে আসবেন। তার পরামর্শ শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। একা থেকে কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। শেষে ইমাম ফরীদ বললেন, নাহ, বরং আমরা সকলেই আজ জেদ্দা থকবো। মিটিং শেষ করে তারপর মক্কা শরীফ যাবো। আমি মনে মনে খুবই খুশি হলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকরিয়া আদায় করলাম। নজরুল ভাই বললেন, মক্কায় থাকার ব্যবস্থা বেশি ভালো। এখানে একটা রুম আছে মোটামোটি চলে। তাহলে বাকিরা একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। ইমাম ফরীদ বললেন, কোন অসুবিধা নেই। চলুন। দূতবাসের গাড়ি আমাদের জন্য বাইরে প্রস্তুত ছিলো। সুন্দর বিলাসবহুল গাড়ি। আমাদের সকলে আরোহণ করতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাড়িতে বসে নজরুল ভাই মোবাইলে নির্দেশ দিলেন রুম রেডি করে রাখতে।
জেদ্দা হজ অফিসে
আমরা যখন আবাসস্থলে পৌঁছি তখন ফজর হয় হয়। গেইটের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই ভিতর থেকে দুজন খাদিম তাড়াতাড়ি হাযির হলেন। আমাদের মালসামান নিয়ে এলেন। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম মনোরম কক্ষ। পাশেই থাকার জন্য এটাস্ট বাথসহ চমৎকার একটি রুম। এটাতে ইমাম ফরীদকে থাকতে দেওয়া হলো। নজরুল ভাই বললেন, বাকি চারজন দুতলায় চলে আসুন। ইমাম ফরীদ মাকনুনের দিকে ইশারা করে বললেন, ও আমার ছেলে। সাথে থাকলেই আমার জন্য সুবিধা হবে। জী স্যার বলে নজরুল ভাই আমাদেরকে উপর তলায় নিয়ে গেলেন।

কার্টন উদ্ধার অভিযান
আবাস স্থলে পৌঁছে আমরা অযূ ইস্তিঞ্জা সেরে নেই। নিজেরা জামাত করে সালাতুল ফজর আদায় করি। এরপর কিছু সময় বিশ্রামের নিয়তে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। পেরেশানির কারণে আমার তেমন ঘুম হয়নি। কিছু এপাশ ওপাশ করে আটটার দিকে উঠে পড়ি। নাশতা সেরে ইমাম ফরীদের রুমে যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের অভিযান কখন শুরু হবে। আয় আবদুল আলীম! তুই মারুফের সাথে যা। কিন্তু তুই গেলে তো তোর দোস্ত সাঈদও যেতে হবে। ঠিক আছে। তাহলে তোরা তিনজনই যা।

ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা পার হয়ে গেছে। জনাব নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। তিনি বললেন, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কনস্যুলেট অফিসে চলে আসুন। আমরা তিনজন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সেখানে চলে গেলাম। নজরুল আমাদেরকে আন্তরিক সহযোগিতা করলেন। সেদিন কনস্যুলেট অফিসে অনেক ভিড় ছিলো। নজরুল ভাই আমাদেরকে একটি রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক ভাই তার কম্পিউটারে টিপাটিপি করছিলেন। প্রথমে পরিচিত হলাম। নাম ইমদাদ। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। কনস্যুলেট অফিসে ইন্টারপিটার হিসাবে কাজ করেন। নজরুল ভাই আমাকেও বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গত রাতে আমার কথোপকথন তিনি শুনেছেন। বিশেষভাবে আমার আরবী ভাষায় দক্ষতার কথা তিনি ভাই ইমদাদকেও বললেন। কনস্যুলেট অফিস থেকে চিঠি নিয়ে যাবো। তাহলে কাস্টমসের লোকেরা গুরুত্ব দিবে। ভাই নজরুল আমাকে চিঠির ড্রাফট করে দিতে বললেন। আমি বললাম, ইমদাদ ভাই পারবেন। আমি পাশে বসে সহযোগিতা করছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি কম্পোজ করে নজরুল ভাইসহ আমরা আবার রওনা করলাম এ্যায়াপোর্টের পথে।

এ্যায়ারপোর্টের কাস্টমস অফিসে যখন পৌঁছি তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। যোহরের নামাযের জন্য সকলে প্রস্তুতি করছেন। সৌদি আরবের এটা বড় একটা প্রিয় দৃশ্য। আযান হওয়ার সাথে সাথে সব কিছু বন্ধ। সালাতের জন্য সকলে প্রস্তুত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সোনার বাংলাদেশেও এই পরিবেশ তৈরি করে দিন।

আমরা প্রথমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরের রুমে গেলাম। নাম তার আবদুল খালিক। বড় অমায়িক ও ভদ্র লোক মানুষ। আমাদেরকে যথেষ্ট ইকরাম ও সম্মান করলেন। বিষয়টি বিস্তারিত তিনি আমার কাছে শুনলেন। এরপর অধীনস্থ অন্য একজন অফিসারের কাছে একটি চিঠি লিখে দিলেন। আমাদের অযূ করার প্রয়োজন ছিলো। তিনি নিজে উঠে এসে তার বাথরুমের দরজা খুলে দিলেন। অযূ করে জামাতের সাথে আমরা যোহরের সালাত আদায় করলাম। অফিসের ভিতরে সুন্দর নামাযের জায়গা। ভালো লাগলো।

নামায শেষ করে পত্রটি নিয়ে আমরা অন্য এক অফিসারের রুমে গেলাম। সেখানে তখন আরও কয়েকজন বসা ছিলেন। আমরা যাওয়ার পর ফতওয়ার কার্টনটি তিনি লেবার দিয়ে হাযির করলেন। তিনিও আমার কাছে বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ শুনলেন। কার্টনটি খুলতেই প্রথমে বের হলো রাওয়ায়ে মিন আশআরিছ সাহাবা এবং আলা ইয়া আয়নু ইবকি গ্রন্থদুটি। বললাম, এগুলোর লিখক আমি নিজেই। তিনি কিতাব দুটি হাতে নিলেন। কয়েকটি পৃষ্ঠায় নজর বুলালেন। এরপর আমার প্রতি বিশেষ সম্মানের আচরণ প্রদর্শন করলেন। তার ইশারায় সামনে বসা একজন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ইস্তারিহ ইয়া দুকতূর বলে আমাকে বসার জন্য অনুরোধ করলেন। অফিসার টাইপের লোকটি বললেন, এগুলো তো আরবি। আমি শুনেছিলাম, বাংলা বই। তখন কার্টন থেকে ফতওয়ার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি তার হাতে এগিয়ে দিলাম। মনে হলো ভদ্রলোক খুবই আশ্বস্ত হলেন। সাথে সাথে ছাড়পত্রেও সাইন করে দিলেন। কাগজটির নীচে বুঝিয়া পাইলাম জাতীয় কিছু লিখে আমাকেও সাইন করতে বললেন। আমিও কাগজটি বিনয়ের সাথে তার হাত থেকে নিলাম এবং নীচে একথা লিখলাম, ইস্তালামতু জামিআল কুতুবিল মাহযূবাহ… এরপর লেবারকে তিনি নির্দেশ দিলেন কার্টনগুলো আমাদের গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। সব প্রশংসা ও শোকরিয়া আল্লাহ তাআলার জন্যই। গাড়িতে চড়ে ইমাম ফরীদকে খবরটি জানালাম। তিনিও খুব আশ্বস্ত হলেন। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা আদায় করলেন।

কার্টন নিয়ে ফেরার পথে একটি বাঙালি হোটেল থেকে দেশীয় খাবার কিনলাম। আবাসস্থলে যখন ফিরি তখন প্রায় আড়াইটা। কার্টন অভিযানে সফল হওয়াতে আমাদের সকলের মাঝেই আনন্দ ও খুশি তখন বিরাজ করছে।

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *