শিক্ষকের অপমানের পরিণামে তারুণ্যেই নিভে গেলো একটি প্রদীপ    

শিক্ষকের অপমানের পরিণামে তারুণ্যেই নিভে গেলো একটি প্রদীপ    

  • সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী

১৯৪৩ সালে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় একবার ছাত্রবিক্ষোভ হয়। দুঃখজনক হলেও এর নেতৃত্বে ছিলো আমাদেরই কিছু ঘনিষ্ট ছাত্র। যারা নদওয়ার সেরা ছাত্রদের কাতারে ছিলো। তাদেরকে নিয়ে নদওয়ার শিক্ষকদের অনেক স্বপ্ন ছিল।

তাদের মধ্যে সবচে’ অগ্রগামী ছিল আমার স্নেহভাজন ছাত্র আলী আহমদ কিয়ানী। আমার দশ বছরের শিক্ষকতা জীবন, পরবর্তীতে নদওয়ার উপপ্রধান ও প্রধান হিসেবে  দায়িত্ব পালনের সময়েও এই তরুণ ছেলেটির চেয়ে অধিক মেধাবী, ‘যু ইস্তি’দাদ’ ও প্রতিভাবান কোনো তালিবুল ইলম আমি দেখিনি। সেই দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষে থাকতেই লক্ষ্য করেছি, তার ইবারত পাঠে বা লেখায় নাহু-সরফের কোনো ভুল হওয়া ছিলো  প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমার বেশ কিছু আরবী প্রবন্ধ-নিবন্ধের চমৎকার অনুবাদও সে করেছে। এই বিক্ষোভের পরে সে যখন করাচি গিয়েছিল কমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও সে করাচির ইলমী  অঙ্গনে আল্লামা কিয়ানী নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় এই ছাত্রটিই সেদিন বিশৃঙ্খলাকারীদের নেতা বনে যায় এবং বিক্ষোভের নেতৃত্ব প্রদান করে।

তার সকল উস্তাদের মতো আমার মনেও খুব কষ্ট লেগেছিল যে, সে কেবল এ   বিক্ষোভে অংশগ্রহণই করেনি বরং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। কষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো, এ বিক্ষোভ সরাসরি সায়্যিদ সুলাইমান নদভী সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও  দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো। অথচ তিনি তখন নদওয়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুরুব্বী  ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছিলেন নদওয়াকে নিজের বুকে আগলে রাখা একটি ‘ঢাল’।

এ বিক্ষোভের কারণে সায়্যিদ সাহেব মনে খুব ব্যথা পেলেন। নদওয়ার খেদমত ও তালিবুল ইলমদের তালিম-তারবিয়ত নিয়ে তিনি বেশ গর্বিত ছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের স্বপ্নগুলোকে রক্তাক্ত হতে এবং এতোদিনের মেহনত ও প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ হতে দেখতে পান। ফলে খুবই ব্যথিত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন সেই ছাত্রটি পাগল হয়ে যায়। অবস্থার এতটাই অবনতি  ঘটে যে, পরিবারের লোকজন তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। তার বড়ভাই চিকিৎসার  জন্য আমার ভাইজান ডা. সায়্যিদ আব্দুল আলী সাহেবকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। বিশেষ  সম্পর্কের কারণে আমিও সঙ্গে গেলাম। তাকে শিকলে আবদ্ধ দেখে চোখে পানি  আটকে রাখতে পারলাম না। যে যুবক প্রখর মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ততায় তাঁর সহপাঠীদের কাছেও ঈর্ষার পাত্র ছিল, আজ তার একী দশা! ভাইজান প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে  ফিরে চলে এলেন।

যে আমার কোনো ওলীকে কষ্ট দেয় আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা করি

সায়্যিদ সুলাইমান নদভী সাহেব সেসময় এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে দারুল উলূমে অবস্থান পর্যন্ত করেননি। আমাদের ঘরে থাকছিলেন। আমি একবার সুযোগ বুঝে হযরতের কাছে একাকি আরজ করলাম, আমার মনে হয় আলী আহমদের মুখ থেকে আপনার ব্যাপারে কোনো ‘কটুক্তি’ বেরিয়ে গিয়েছিল। বিক্ষোভের উন্মাদনায় হয়তো আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল এবং কোনো কটুবাক্য উচ্চারণ করে ফেলেছিল। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে আমার কোনো ওলীকে কষ্ট দেয় আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা করি’। আপনি তো তার শুভাকাঙ্খী উস্তায ও মুরুব্বী। সায়্যিদ সাহেব অত্যন্ত বিনীত ভাষায় এর জবাব দিলেন। ‘আমি আর কী?’ আমি দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলাম ও দুআর আবেদন করলাম। সায়্যিদ সাহেব নীরবতা অবলম্বন করলেন। এর দুদিন বা তিন দিন পর বললেন, ‘মৌলভী আলী সাহেব, আমি আপনার নির্দেশ পালন করেছি’।

এখন এটাকে সায়্যিদ সাহেবের ‘কারামত’ মনে করুন বা অন্য কিছু— ছেলেটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল। আমি যতটুকু জানি, এরপর এ রোগ আর তার মাঝে দেখা দেয়নি। তবে দুঃখের কথা হলো, প্রতিভাময় এই প্রদীপটি ১৯৫০ সালে খুব অল্প বয়সেই নিভে যায়।

পুরানে চেরাগ (খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১-৪২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *