মাসউদুল কাদির ● এখন শীত চেপে ধরেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ঠা-ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। যখন শীত পড়েনি, তখনো ঠা-া হিমেল হাওয়া বয়ে যেতো কুতুপালংয়ের পাড়ায় পাড়ায়।
বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন রাজধানীর শুভ্র এক সকালে হাজীপাড়ার মেইন রোড থেকে আমাকে তুলে নিলেন। গাড়িতে উঠেই লক্ষ্য করলাম, মুফতি আখতার, মুফতি যারওয়াতুদ্দীন সামনুন, মুফতি তানজিল আমিরদের উপস্থিতি। গাড়ি চালাচ্ছেন জনাব রাশেদ। তখনো আমি বুঝিনি পুরনো টাউন থেকে আরও কেউ আমাদের সঙ্গ নেবেন। এত সকালে তো আর পরটা ভাজা খাওয়া হয়নি। অভ্যেসও নেই। হোটেল আল রাজ্জাকে গাড়িটা থামতেই পুরনো ঢাকার কামাল আহমেদ খান আমাদের স্বাগত জানালেন। দারুণ এক মিষ্টি হাসির মানুষ। ঠিক পরিচয়ও হয়নি, কিন্তু খাবারের টেবিলটা প্রাণবন্ত করে তুললেন কামাল ভাই। তিনি বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার কক্সাবাজার সফরসঙ্গী। এরপর পুরো পথে কামাল ভাই সবসময় হাসির খোরাক জোগানোর ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন। আমরা তাকে সঙ্গ হিসেবে পেয়েছিলাম মূলত বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান শাইখুল হাদিস আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাত বারাকাহুমের ভক্ত হওয়ার কারণে।
আবার গাড়ি চলছে, পথে পথে কত্ত রকম কথাবার্তা হচ্ছে। একবার তানজিল আমিরের পরামর্শে চা চক্রে অংশ নিলাম ফেনিতে। জুমুআর নামাজও ফেনিতেই পড়লাম। দেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে চট্টগ্রামের রাস্তাটা একটু ভালো। খানিকটা পর সবাইকে ক্ষুধায় চেপে ধরলেও কেউ রা করছিল না। আমার মনে হচ্ছিলো, সব্বাই ক্ষুধা চেপে যাচ্ছিল। কারণ মাকনুন ভাই বলছিলেন, আমরা ফোর সিজনে খেতে চাই। ক্ষুধা যেমনই থাকুক, আমার ইচ্ছে ছিলো ফোর সিজনে যাই, খাই। কারণ সেখানে আমি কোনো দিন যাই নাই।
পথে জামিআ ইসলামিয়া জিরির প্রিন্সিপাল আল্লামা শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব দামাত বারাকাতুহুম-এর সাক্ষাৎ পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরী হলো। মাকনুন ভাই আল্লামা শাহ তৈয়ব তনয় মাওলানা খোবাইবের দাওয়াত রাখলেন তবে কেবল চায়ের জন্য। মাওলানা খোবাইব খুব করে চাচ্ছিলেন দুপুরের খাবারের দায়িত্বটা তিনি নিতে চান। মাকনুন ভাই তো নিজের ভার কাউকে দিতে চান না। সে কারণেই কেবল বলেছিলেন, আমরা চা-পর্যন্ত আপনার এখানে থাকবো। পথে একটু দাঁড়ানোর নানা উদ্দেশ্য থাকে। এরমধ্যে একজন বুজুর্গের সঙ্গে জমিয়তুল উলামার তরুণপ্রজন্মের সবার দেখা হবে সেটা কম কী?
আমার মনে পড়ে, জামিআ ইসলামিয়া জিরির এই প্রতিষ্ঠানের সদসালা-শতবর্ষ উদযাপনের প্রতিচিত্র ধারণ করে আমি যুগান্তরে লিখেছিলাম। শর্তবর্ষ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলাম। সেটা ২০০৬ সালের কথা। একটা প্রতিষ্ঠান যখন শতবর্ষের সাক্ষী হয়- তখন আনন্দটাও সেরকম হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছিল তখন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শতবর্ষের প্রতিষ্ঠান খুব বেশি নেই। মাত্র কয়েকটা। এগুলো আবার চট্টগ্রামে-সিলেটেই বেশি।
জামিআ ইসলামিয়া জিরিতে গাড়ি ঢুকতেই স্বাগত জানালেন মাওলানা খোবাইব। তিনি আমাদের মেহমানখানায় বসালেন। শুধু চায়ের কথা থাকলেও ডাবের পানিসহ নানারকম নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। সবাই খুব আগ্রহভরে খাচ্ছিলো। মাওলানা খোবাইব বার বার জানতে চাইলেন আপনারা কোথায় লাঞ্চ করেছেন। ততক্ষণে আসরের আজান দিয়ে দিচ্ছিলো। সবাই কেবল এই তো, এইতো বলে বেড়াচ্ছিলো। কেউ বলতে চাচ্ছিলো না- আমরা খাইনি। কিন্তু সেই কামাল খান। কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, না, আমরা খাইনিতো। সামনে গিয়ে খাবো।
হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন কামাল ভাই। মাওলানা খোবাইব আর বিলম্ব করলেন না। জায়গামতো নির্দেশ জারি করলেন উপস্থিত যা আছে নিয়ে আসো। সবশেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও লাঞ্চটাও এখানেই করতে হলো। এরিমধ্যে এক ফাঁকে আল্লামা শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়ে গেল। আমরা সব্বাই তার সঙ্গে মোসাফাহা করলাম। কওমি মাদরাসা শিক্ষাসনদ স্বীকৃতি পরিষদের ব্যানারে আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছিলাম। তখন পুরো দেশটাই নড়ে উঠেছিল। এরপর আরও কত দলউপদল সেখানে যাতায়াত করেছে। অথচ এরআগে কখনই তারা এ বিষয়ে সেখানে সফর করেনি। প্রবাদে গরিবের পায়ে ল´ী বলে একটা কথা আছে। মানুষ হাঁটলেই পথ ফুরায়। পথ পেরিয়ে যায়। খুঁজে পায় সাফল্য সাম্পান। যারা শত শত লাশ ফেলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, সেই তারাই স্বীকৃতি আন্দোলনে যোগ দেয়। যুগের সবচেয়ে আধুনিকমনষ্ক অগ্রসর চিন্তা ও মুক্তির দিশারী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের ইশারায় বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে স্বীকৃতি পরিষদ কাক্সিক্ষত সে স্বপ্নপূরণে সাক্ষর রেখেছে। ইতিহাসে কেউ উল্লেখ করুক আর না-ই করুক আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে শান্তির ফাতওয়া তুলে দেয়ার অনুষ্ঠানে কওমিস্বার্থ চিন্তা করে ‘কওমিসনদের স্বীকৃতি’ চেয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব নয়, এমপির টিকেট নয়, দুনিয়ার কোনো মোহতা নয়, এমনকি কওমি স্বীকৃতি বাস্তবায়নের কোনো পদের আশায়ও নয়। সেটা আজকের দিনে এসে এ দেশের কোনো নালায়েক যদি বুঝতে না পারে সে আসলে এই গ্রহেরই নয়। নিজের পদটা অর্জন করার জন্য আজ সমাজে কি ধামাকা চলছে তা নতুন করে বুঝানোর কিছু নেই। যা হোক, আলোচনা স্বীকৃতির নয়। মাওলানা খোবাইবের উপস্থিত আতিথেয়তায় সব্বাই খুশি হলো। আবার গাড়ি, আবার যাত্রাÑ আগ্রহ ছিলো ফোর সিজনে অন্তত একটু চা খাই। হলো না, লোহাগাড়া পার হয়ে অকস্মাৎ গাড়ি থামিয়ে মাকনুন ভাই মিষ্টি কিনে সবাইকে খাওয়ালেন। বুঝলাম না। খেলাম। কখনো বুঝে খাই আবার কখনো না বুঝেও। কোনো একটা কারণ তো থাকবেই।
কক্সবাজারের লাবণি পয়েন্টের খুব কাছে একটা ফ্লাট ভাড়া করা হয়েছে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে পরিাচালিত রোহিঙ্গা শিবিরে কাজে যুক্তদের থাকার জন্য। অল্প টাকায় বেশ কয়েকটা কক্ষ আছে এতে। আমরা সেখানেই উঠলাম।
রাতটা কুতুপালং ভেবে ভেবে কাটালাম মনে হচ্ছিলো। কারণ এর আগে আমি যাইনি রোহিঙ্গা শিবিরে। ভিডিও ফুটেজে পত্রপত্রিকায় সবখানে বিপদগ্রস্ত মুসলমানদের চিত্র দেখে হৃদয়ে একটা আশা ছিলো, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বললেন, প্রয়োজনে আমরা একবেলা খাবো তবু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবো। খেতে দেবো।
মনে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মানুষের বক্তব্য দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইন্দিরাগান্ধি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া মুক্তিপাগল মানুষদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। আশ্রয় ও খাবার দেয়ার জন্য সীমান্তে ছুটে এসেছিলেন বিশ্বের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক রাহবার, জমিয়তে উলামা হিন্দের তৎকালীন সভাপতি, ফিদায়ে মিল্লাত, আওলাদে রাসূল সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রহ.। তিনি বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
সে ধারারই একটি অসহায় ক্যাম্প কুতুপালং। পুরো কক্সবাজারের সাধারণ মানুষদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল অসহায় এই মানুষেরা। প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুগোযোগী সিদ্ধান্ত নেন সেনাবাহিনীকে সেখানে দায়িত্ব দিয়ে। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদও উড়ে গিয়েছেন। উড়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক সব নেতারাও। আমাদের সেতুমন্ত্রী ওবাইদুল কাদের তো কদিন পর পরই যাচ্ছেন রোহিঙ্গা শিবিরে। তুরস্কের ফার্স্ট লেডিসহ বিশ্বের মানবতাবাদি মানুষেরা ছুটে এসেছেন এখানে।
বিপন্ন এই মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে এসেছেন জমিয়তে উলামা হিন্দের বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল সাইয়্যিদ মাহমুদ মাদানী, আওলাদে রাসূল সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানীসহ বিশ্বের অসংখ্য উলামায়ে কেরাম। মানুষ ও মানবতার পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এবারও আলাদা একটি দৃষ্টান্ত রাখতে সমর্থ হয়েছেন এ দেশের আলেমউলামাগণ। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা এর জ্বলন্ত সাক্ষী।
অসুস্থ হয়ে বেড রেস্টে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার কা-ারী আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তার পরামর্শেই কাজ শুরু হয় কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। বহির্বিশ্বের বশেই দেশিবিদেশি সব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন তিনি। সে কাজেরই ফিরিস্ত জেনে অবাক হলাম। রোহিঙ্গাশিবিরে দানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ-ইউনিসেফের পরই বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার অবস্থান। সব সংগঠনই সাধ্যানুযায়ী কাজ করেছে। আলেমদের এই মেহনত এ দেশের সাধারণ মানুষদের হৃদয়ে রেখাপাতও করেছেন। একটা দাগ, দুটি দাগ করে আলেমদের অবস্থান পরিষ্কার করারও একটা সুযোগ ছিল এটি।
ভোর হলো। গাড়িতে করে যাত্রা শুরু করলাম কুতুপালং শিবিরের উদ্দেশে। এতদিনে রোহিঙ্গা ভাইবোনদের অন্তত মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে হওয়া কাজগুলো দেখাচ্ছিলেন আমাদের শোআইব ভাই। পাহাড়ি উঁচুনিচু টিলা অতিক্রম করে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাও কঠিন ছিলো। কারও কারও কাজ দেখে মনে হয়েছে তারা একটা কিছু দাঁড় করাবার জন্যই এসেছিল। এখন সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যেমন টয়লেটে দরজা নেই। ঘরের একপাশ নুয়ে পড়েছে। নলকূপÑ পানি ওঠে না। ঘরে ঘরে মানুষ কিন্তু সময় মতো খাবার নেই। অনেকেই খ-কালীন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে আর কুতুপালংয়ের খবরই নিতে পারেননি। ধারাবাহিক কর্মসূচি যারা পরিচালনা করেননি তাদের কাজগুলোর অবস্থা এমনই। এরকম কাজের প্রতিচিহ্ন পড়ে আছে রোহিঙ্গা শিবিরের সবখানে। সরেজমিন কুতুপালংয়ের অবস্থা দেখে তাই মনে হয়েছে।
কুতুপালংয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহ. নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামারই সবচেয়ে বেশি অনুদান এতে রয়েছে। মসজিদটি এমন একটি জায়গায় রোহিঙ্গা শিবির উঠে গেলেও মসজিদ মজুদ থাকবে। মধুছড়া ক্যাম্প ঘুরে এসে মসজিদে হাবিবে এলাম। দারুণ বড় একটি মসজিদ এখানে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা। এখানে দেখলাম মিয়ানমারের অনেক আলেম। তাদের সঙ্গে কথা হলো। ঢাকার সাধারণ মানুষদের তারা একটু ভিন্নতর চাটগাঁ ভাষায় কথা বুঝাতে কষ্ট হয়। তাই তারা আলেম দেখলেই উর্দু ভাষায় কথা বলে। এতে করে ভাষা আদানপ্রদানে সহজ হয়। লক্ষ্য করলাম, বাইরের কাউকে দেখলেই তাদের চোখে মুখে একটা প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মাওলানা শুয়াইব প্রতিটি ক্যাম্পে গিয়েই খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন ‘মাঝি’কে খুঁজে খুঁজে। আমি অবাক হয়েছিলাম। দেখলাম, কিছু কিছু জায়গায় আলেমদেরকেও মাঝি বলা হচ্ছে। ধারণা করেছিলাম, নদীমাতৃক এলাকায় বসবাস করে, সে হিসেবে তাদের মাঝি হওয়াটা স্বাভাবিক। পরে জানলাম আরেক কাহিনী। যারা পাড়ার মাতবর, সর্দার তারাই মাঝি। মিয়ানমারে মহল্লার সর্দারকেই তারা মাঝি বলে সম্বোধন করে। মসজিদে হাবিব এলাকায় মাঝি সৈয়দুর রহমানের সঙ্গে কথা বল্লাম। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আর থাকা। বেঁচে আছি সেটাই কম কী? এতদূর এসেও কি আপনারা পরস্পরের প্রতি কেমন আচরণ করছেন? তিনি বলেন, পারস্পরিক হৃদ্যতা ভালো। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এখানে কিছু উশৃঙ্খল মানুষও আছে। এরা মসজিদের বাঁশ শুদ্ধ চুরি করে ফেলে।
মিয়ানমার আপনাদের বসবাসের জন্য কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর মেহেরবানীতে অনেক ভালো। শুধু আমাদেরকে মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সুবিধা দিলেই আর কিচ্ছু লাগবে না। আমাদের অর্থ সম্পদও অত্যাচারের বড় কারণ।
মিয়ানমারে ফিরতে এখনও প্রস্তুত বলে জানায় মুহাম্মদ শহীদ নামের এক রোহিঙ্গা। আট ছেলে মেয়ে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন বাংলাদেশে। তার কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের আশ্রয় দিলো, বিষয়টা আপনার কাছে কেমন লাগলো। তখন তার চোখ ভিজে এলো। তিনি বললেন, আমরা কোথায় যেতাম। বাংলাদেশের মানুষকে আমার কাছে ফেরেশতাতুল্য মনে হয়েছে।
মিয়ানমারের নিজামপুরের জামিআ দারুল উলূম থেকে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেছিলেন মাওলানা ইউসুফ। এখন তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে বসবাস করছেন মধুছড়াক্যাম্পে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা ছুটে এসেছিলাম বটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নিজের ভাইবোন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। নিজে না খেয়ে হলেও আমাদের খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ নিজের দেশে আমরা নিজেদের আয়রোজগারও খেতে পারিনি। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসতে হয়েছে।
মাওলানা ইউসুফ দুঃখ করে বলেন, মিয়ানমারে সবার আগে ধর্মীয় স্বাধীনতা দরকার। যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা প্রয়োজন। মিয়ানমারে ফিরতে চাইÑ কিন্তু ধর্ম পরিপালনের অবস্থা কী হবে? তা নিয়ে বরাবরই শঙ্কিত।
মধুছড়ায় পেলাম আরেক মাওলানাকে। তার নাম সিদ্দিকুর রহমান। তিনিও বড় একটি পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশোনা করেছেন। আশ্চর্য হলাম, অনেক কিছু হারিয়েছেন তিনি। তবে দারুল উলূম দেওবন্দের ভর্তি আইডিকার্ডটি এখনও সযতনে রেখেছেন তিনি। বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। সেদিন অং সান সু চী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন মিডিয়ায়। আমি তাকে সু চীর বক্তব্যটা শোনালাম। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ইয়ে ইয়াকিন কে সাত কেহতা নিহি।
আমি বললাম, আদতে তো আপনাদের বাড়িঘর মিয়ানমার। সেখানেই আপনাদের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি বললেন, আমরা ফিরতে চাই। শান্তি চাই। সু চী মিথ্যাচার করে ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের আবার জবাই দিতে চায়।
মাওলানার কাছে আমি জানতে চাইলাম, সু চী বা জান্তারা কেন এত বেশি অগ্নিশর্মা? তারা জবাই করতে চায় কেন? তিনি অর্থনৈতিক কারণসহ অনেক তথ্য দিলেন। তিনি মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একটা দলের তথ্যও দিলেন। তারা লড়াই করছে খুব দুর্বলভাবে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার পুরো রাখাইন রাজ্যে তা-ব চালিয়েছে।
তাহলে কি আপনারা ফিরবেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা সিদ্দিক বলেন, মিয়ানমারে ১৩৫ শ্রেণি, জাতির বসবাস। সরকারিভাবে ১৩৬ জাত হিসেবে রাখাইন অধিবাসী- রোহিঙ্গাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব দিতে হবে। সমগ্র মিয়ানমারে আমাদের অবাধে চলাফেরা করার সুযোগ দিতে হবে।
মাওলানা সিদ্দিকের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলাম আল্লামা কাজী মুতাসিমবিল্লাহ রহ. মসজিদের হুজরাখানায়। কুতুপালংয়ের ভেতরে এটাই জমিয়তুল উলামার অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাওলানা সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বললেন, আমরা এই মুজিবকন্যাকে কখনো ভুলতে পারবো না। তিনি তার নেক হায়াতের জন্যও দুআ করেন।
মধুছড়ার আরেকটু ভেতরে মসজিদে হাবিব নামে দ্বিতীয় আরেকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে। পাহাড় কাটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে পা ফেলতেই শুনতে পেলাম আলিফ, বা, তা সা এবং মহাগ্রন্থ কুরআনের সুর। তিলাওয়াতের আওয়াজ। বুকটা হঠাৎই আনন্দে যেনো নেচে উঠলো। উপরে উঠে দেখলাম, কী দরুণ মসজিদ। ভেতরে চোখ পড়তেই মনে হলোÑ জান্নাতি ফুলপাখিরা এখানে ছড়িয়ে আছে। শিশুরা পড়ছে কুরআনের পঙক্তিমালা। এটা বুঝারই উপায় নেই যে আমরা এখন কুতুপালংয়ে আছি। কুরআনের সুর, লাহজা, পদ্ধতি সবখানে একইরকম। নামাজে দাঁড়ালে কাউকে লাইনে যেমন আলাদা করা যায় না। তেমনি তিলাওয়াতেও। কুরআনের সুরে সুরে মসজিদে হাবিবিতে একটা তন্ময়তা বিরাজমান। কথা বল্লাম, শিক্ষক ও ইমামদের সঙ্গে। মিয়ানমারের টমবাজার দারুল উলূম মাদরাসা থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেছেন মাওলানা মুহাম্মদ সালিম। তার চোখে মুখে এখনও প্রজ্বলিত মিয়ানমারের চিত্র ভেসে বেড়ায়। কুতুপালংয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে বললেন, এখানে মিয়ানমারের চেয়েও ভালো আছি। এখানকার সবাই আমাদের কেবলই ভালোবাসছে। অথচ নিজের দেশে আমরা নির্যাতনের স্বীকার।
বিশ্বনেতৃত্বকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা উচিত বলেও তিনি দাবি করেন। মাওলানা সলিম কুতুপালংয়ে যেসব আলেমগণ শিক্ষকতা করছেন তাদেরকে একটা ভাতা নির্ধারণের আহ্বান জানান।
হাফেজ মুহাম্মদ রফিক আজাদির সঙ্গে কথা হলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান জানিয়ে বলেন, পরাধীনতা ভাললাগে না। আজাদি পেলে, স্বাধীনতা পেলে মিয়ানমারই হবে আমাদের প্রিয় স্থান। হাফেজ ইসমাঈলও একই কথা পুনরাবৃত্তি করলেন।
পড়ন্ত বিকালে আমরা কম্বল বিতরণ করলাম। সাংবাদিক তানজিল আমিরের তত্ত্বাবধানে সংগৃহিত কম্বল বিতরণের তথ্য দিলে একজন রোহিঙ্গা চিৎকার করে বললেন, আরার গরত ছুইল নো আছে আর অনেরা কম্বল দিতে লাগগইন।
এনজিও কর্মীদেরও কী করার আছে। যখন যেটা সেকশন হয় সেটাই তো তারা দিতে পারে। কাজ করছে সেনা বাহিনী, ইউনিসেফ। তাদের কাজের সৌন্দর্য আছে। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামাও আকাবিরের পথ ধরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাওলানা মাকনুনের নেতৃত্বে কুতুপালংয়ে কাজ করেছে। চোখে দেখা একটা বিপ্লবই বলা চলে। ত্রাণবিতরণে সেনাবাহিনীর হিসাব অনুযায়ি জাতিসংঘের পরে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামাই সবার উপরে। এটা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাত বারাকাহুমের দুআরও একটি ফসল।
এখন ঠা-া বেড়েছে। শীতে কাঁপছে মানুষ। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার টিটু চন্দ্র শীল বলেন, শীতকালে পাহাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধ, নারী-শিশুরা ঠা-াজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ইনফেকশন, রক্ত ঝরা ও চোখের এলার্জিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তও হচ্ছে। তবে সকলে যাতে চিকিৎসা সেবা পায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তবে শীতকাল আসার পর থেকে রোগীর সংখ্যাটা বেড়েছে।
টেকনাফের মৌচনি নিবন্ধিত শিবিরের প্রধান সড়কের সামনে গড়ে উঠেছে নতুন করে শতাধিক রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। সেখানে অনেকের ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে কাদা মাঠিতে বসবাস করছে। এমন এক রোহিঙ্গা নারী তসলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি মিয়ানমার কিলাডং গ্রামে। তিনি জানান, শীত শুরুতে তেমন বেশি শীত লাগেনি। কিন্তু গত দুইদিন ধরে ঠা-ায় খুব কষ্টে হচ্ছে। কথা বলার সময় কোলে ছিল ৫ মাস বয়সের শিশু মিনারা বেগম। তার সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে। পাশে থাকা অপর দুই সন্তান মামুন ও শফিকার গায়েও গরম কাপড়চোপড় নেই। হাত পা গুটিয়ে মায়ের পাশে বসে আছে।
বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার আরেকটি কাজের ক্ষেত্র পড়ে আছে টেকনাফের নোয়াপাড়ায়। সেখানে মাওলানা আবদুল্লাহ শাকিরও প্রচুর কাজ করেছেন। এখন সমস্যা শীত। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার তত্ত্বাবধানে লাখ লাখ কম্বল বিতরণ ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। তবে টেকনাফ মৌচনি প্রধান সড়কের সামনে ঝুপড়ি ঘরে বসবাসরত রোহিঙ্গা তসলিমা আক্তার বলেন, এক কাপড়ে তাঁরা মিয়ানমার ছেড়েছেন। গরম কাপড় তো দূরে কথা, প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। এখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে সন্তানেরা। মিনারা বেগম অসুস্থ হলেও তাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। টেকনাফের নয়াপাড়া ত্রাণ কেন্দ্রের পাশে ধানে জমিতে নতুন করে ঘর তৈরী করতে দেখা যায়। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে অনেকে আবার ছাউনি দিতে পারেননি। বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত ১৫ ফুট লম্বা একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন পরিবারের ২০ নারী ও শিশু। নারীদের সঙ্গে আছে পাঁচ মাস থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ৫ জন শিশু। ঠা-ায় (শীতে) বেশির ভাগ শিশু সর্দি-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। কিছু শিশুর গায়ে কাপড়ও নেই। আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসিনি। আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি-সহায়সম্বল সবকিছু হারিয়েছি। শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের জন্য এই ঝুপড়িঘরে কারও ঘুম হয় না। রাতে ঝুপড়িঘরের বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠা-া বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। একটা কম্বল কিংবা গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের শীত নিবারণেরও কোনো জো-নেই। এর মধ্যেও খাবারের সঙ্কটও চলছে।
মহান আল্লাহর অশেষ কৃপা, এতবিপুল সংখ্য মানুষের জীবনে যে আশ্রয়হীন জীবনের গল্প শুরু হয়েছিল তা এখন অনেকটা প্রশমিত হয়েছে। তবে এসব বাড়িঘর কিছুতেই দীর্ঘ মেয়াদি বসবাসের উপযুক্ত নয়। এসব ঝুপড়ির ভেতরই চৌকি পদ্ধতির আবাসন করা গেলে এই শীতে হয়তো রোহিঙ্গা শিশুরা একটু স্বস্তি পেতে পারতো। সত্য ও সুন্দরের জন্য এভাবেই কাজ করে যাক জমিয়তুল উলামা। যুগ যুগ ধরে হযরত সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানীর রহ.-এর চিন্তাধারায় বার বার আলোকিত করে তুলুক আমাদের হৃদয়তন্ত্রী। আমীন।
মাসিক পাথেয়, ডিসেম্বর ২০১৭