পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শীতের তীব্রতার সঙ্গে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যাও বাড়ছে। হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেড়েছে কয়েক গুণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ঠাণ্ডা-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ভাইরাল ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি। আর এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন নবজাতক, শিশু ও বৃদ্ধরা।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সারা দেশে তিন হাজার ১০১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয় ৮৯০ জন। ভাইরাল ডায়রিয়াজনিত কারণে ভর্তি হয় দুই হাজার ২১১ জন।
এই সময়ে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শনিবার শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলায়। আর ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি রোগী বেশি ছিল কক্সবাজার, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও কুষ্টিয়া জেলায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
ভর্তি রোগীদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক রোগী প্রায় ৮০ শতাংশ।
শিশুদের জন্য সতর্কতা
শীতজনিত স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি বেশির ভাগ শিশুরই বয়স পাঁচ বছরের নিচে এবং তারা নিউমোনিয়া আক্রান্ত। শ্বাসপ্রশ্বাসের ধরন বুঝতে না পেরে অনেক অভিভাবক বেশি দেরিতে হাসপাতালে আসেন। এতে শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। দ্রুত শ্বাস নেওয়া ও বুক দেবে যাওয়া এই দুটি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে এটা নিউমোনিয়া।
তখন দ্রুত শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ রকম আবহাওয়ার সময়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স খাওয়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। এ ছাড়া শরীর চর্চা করা ও সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সেরাজুল আসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশেই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের রোগীর সংখ্যা বাড়ে। হাসপাতালে আসা বয়স্ক রোগীদের বেশি ভাগই নিউমোনিয়া, সিওপিডি, হাঁপানি (অ্যাজমা) ইত্যাদিতে আক্রান্ত। এসব রোগী সাধারণত খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। শুরুতে চিকিৎসা দিয়ে ৯৬ শতাংশের ক্ষেত্রে তাদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
বরিশালে শয্যার সাত গুণ রোগী
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৩৬ শয্যার বিপরীতে গতকাল ভর্তি ছিল প্রায় ২৫০ শিশু। তাদের বেশির ভাগই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নতুন করে আরো ৭১ শয্যা যুক্ত করেছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। ছয়জন চিকিৎসক ও ১৫ জন নার্স দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে শয্যা না পেয়ে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে।
হবিগঞ্জে এক সপ্তাহে ১৫ নবজাতকের মৃত্যু
হবিগঞ্জে আক্রান্তদের বেশির ভাগ শিশু। গত শুক্রবার এক দিনে হবিগঞ্জে ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিটে (স্ক্যানু) পাঁচ নবজাতকের মৃত্যু হয়। এক সপ্তাহে এখানে মারা গেছে ১৫ নবজাতক। মেডিক্যাল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাস জানান, স্ক্যানুর ১১ শয্যার বিপরীতে ভর্তি নবজাতকের সংখ্যা ৭৫। অনেক নবজাতকের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় সিলেটে রেফার করা হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রারের তথ্য মতে, শনিবার ভর্তি ছিল ৯৬টি শিশু। অথচ সেখানে সিট আছে ৫৯টি। ভর্তিকৃত রোগীর বেশির ভাগই নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।
লালমনিরহাট জেলাজুড়ে রোগীর চাপ
লালমনিরহাট জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর চাপ বেড়েছে। হাসপাতাল সূত্র মতে, প্রতিদিন প্রায় হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে ভর্তি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ জন।
সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বলেন, ‘হঠাৎ রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দিয়েছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি সেবা দিতে।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যালে গড়ে চার শ শিশু রোগী
গত কয়েক দিনের তীব্র শীতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি। হাসপাতালের শিশু বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. বিশ্বজিত চৌধুরী বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। শিশু বিভাগের তিনটি ইউনিটে গড়ে প্রায় চার শ রোগী ভর্তি আছে।
পঞ্চগড় সদরে ভর্তি রোগী দ্বিগুণের বেশি
শীতের তীব্রতা বাড়ায় পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবুল কাশেম জানান, বর্তমানে ১০০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৭০ শিশুসহ ২২০ জন রোগী। এ ছাড়া বহির্বিভাগেও প্রতিদিন আট শর বেশি মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা সাধারণ সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
নওগাঁয় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ সময়ে ৮২৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় রোগী বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। শয্যাসংকটে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে অনেক রোগী।
রংপুরে হাসপাতালের বারান্দায়ও জায়গা নেই
শীতের সঙ্গে সঙ্গে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন গড়ে ৬০ শিশু ও বয়স্ক রোগী ভর্তি হচ্ছে। এতে রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। বারান্দায়ও আর জায়গা নেই।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. ইউনুস আলী বলেন, রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।