জিনাত আরা আহমেদ : সরকারের মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শুদ্ধাচার বর্তমান সময়ের দাবি। তাই শুধু উন্নয়নের নতুন নতুন মডেল হাতে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি সরকার। নেয়া হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল। ২০১২ সালে ১৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সারাদেশে সব দপ্তর বিভাগের প্রতি নির্দেশ দিয়ে জারি হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল। যাকে ইংরেজিতে বলে Notional Integrity Strategy সংক্ষেপে NIS। প্রতিটি দপ্তরকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে শুদ্ধাচারে উদ্বুদ্ধ করাই এই নীতিমালার উদ্দেশ্য।
এই কৌশল রাষ্ট্রীয়ভাবে সততা ও শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের অনন্য দৃষ্টান্ত। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তথা দপ্তরে নৈতিকতা কমিটি গঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এই কমিটি কর্মচারীদের নৈতিক গুণাবলী ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এর আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রতি মাসের নিয়মিত আলোচনায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সদাচার ও নীতিগত বিষয়ে মতামত ও বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে শুদ্ধতার বিষয়ে কথা বলেন। প্রচারের একটা সুবিদিত কৌশল হলো, বারবার যদি কারো সামনে কোনো কথা বলা হয় একসময় মানুষটি তা বিশ্বাস করতে থাকে। এর ধারাবাহিক পরিণতি হলো ইতিবাচক চিন্তা, অর্থাৎ কথা-কাজ-আচরণে সঠিক বিশ্বাসকে ধারণ করা। বারবার নৈতিক কথার পুনরাবৃত্তিতে ঐ ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধ দিনে দিনে বাড়তে থাকে।
মনে-প্রাণে সৎ অর্থাৎ স্বচ্ছ হওয়ার যে গুণাবলী, যাকে অন্য কথায় সদাচার বলা যায়। রাষ্ট্রীয় পবিত্র দায়িত্ব পালনে দরকার সংযমী, উদ্যোমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ সৎকর্মচারী। তিনি অন্যের সাথে সদ্ব্যবহার করবেন। বিনয়ী ও নিরহংকারী হয়ে কাজ করবেন। গণকর্মচারীরা জনকল্যাণকামী সরকারের হাতিয়ার। তাদের নীতিনিষ্ঠা, শৃংঙ্খলা ও সেবামূলক মনোভাব রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে জনবান্ধব করে তোলে। শুধু তাই নয় সুশাসনের মূলনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা, এর জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি প্রতিপালন ও আইন-পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়ন। অফিসে সময়মতো আসা, সেবা প্রদান সহজে ও দ্রুত গতিতে করা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও দক্ষতার সাথে অফিসের কাজে সম্পৃক্ত থাকা, ঘুষ-দুর্নীতিকে ঘৃণা করা তথা প্রতিরোধ করা একজন সরকারি কর্মচারীর কাছে জনগণের প্রত্যাশা।
জনকল্যাণে সরকারের রয়েছে অসংখ্য সুরক্ষামূলক কর্মসূচি। অনেকক্ষেত্রে এই সেবা সহজে না পাওয়া এবং প্রয়োজনীয় সেবা পেতে অর্থের লেনদেনসহ ভোগান্তি জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজ নিজ অফিসে সুন্দর কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করি এবং সঠিক সেবা নির্দিষ্ট সময়ে ও আন্তরিকতার সাথে দিতে চেষ্টা করি তাহলে প্রত্যেকেই সব জায়গায় নিজেদের প্রাপ্য সেবাও যথা নিয়মে পাব। ধরা যাক, একজন কর্মচারী তিনি একটি অফিসে সেবা দিচ্ছেন কিন্তু বাকি অফিসগুলোতে তিনি সাধারণ নাগরিক তথা সেবাগ্রহীতা। ঠিক একইভাবে প্রত্যেকে যে যেই অফিসে কর্মরত তার বাইরে অন্য সব অফিসেই তিনি সাধারণ জনগণ। তাই অসংখ্য প্রয়োজনে বিভিন্ন অফিসে যখন যেতে হয়, সেখানে দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছে উপযুক্ত সেবা পেলে স্বাভাবিকভাবে সকলেই উপকৃত হয়। অথচ এই সাধারণ বিষয়টি আমরা বুঝি না বলেই মানুষকে হেনস্তা হতে হয়।
একজন গণকর্মচারীর অন্যতম গুণাবলী চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং বৈধ উপার্জনে সন্তুষ্টি যা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখে। তাই দাপ্তরিকভাবে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। জনগণের করের অর্থেই সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। তাই দেখার বিষয় জনসেবার পরিমাণ ও গুণমান অর্থনীতির ভাষায় কতটুকু কস্ট-ইফেক্টিভ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জনপ্রশাসন খাতের ব্যয় ৫৪ হাজার কোটি টাকা, যা সমগ্র বাজেটের সাড়ে ১৩ শতাংশ। সততার জন্য পুরস্কার এবং দুর্নীতির জন্য শাস্তির চর্চা থাকলে শুদ্ধাচার বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় শুদ্ধাচার নীতির বাস্তবায়নে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু কর্মকৌশল। যেমন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রণোদনা দিতে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। এটা প্রতি বছর একজন উপযুক্ত দপ্তর প্রধান ও একজন যোগ্য কর্মচারী পাবেন। তাঁরা পরবর্তী তিনবছর বাদে আবার বিবেচিত হতে পারবেন। এসময় অন্যরা পুরস্কার পেতে পারবেন। যদি কোনো ব্যক্তির নৈতিক গুণাবলীর সাথে উপযুক্ত দক্ষতা, যোগ্যতা, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষতাসহ তার মাঝে সেবা প্রদানের সহজাত প্রবণতা থাকে তবে তিনি একমাসের মূলবেতনের সমপরিমাণ অর্থ এবং সার্টিফিকেট পাবেন।
রাষ্ট্রের প্রতিটি দপ্তরে সুশৃঙ্খল কর্মপরিবেশ জনগণের ভোগান্তি লাঘব করে প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তিকেই উজ্জ্বল করে। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের আদর্শে অনুপ্রাণিত সরকারি কর্মচারীর সততা, দক্ষতা আর নীতিনিষ্ঠার সার্বিক সাফল্য এনে দেয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের ধারাবাহিক উন্নয়ন। মনে রাখা দরকার আর্থিক সততাই একমাত্র সততা নয়। দুমুখো নীতি, পক্ষপাতদুষ্ট পলিসি বা আইন ভঙ্গের সংস্কৃতি এগুলোও ভিন্নমাত্রার দুর্নীতি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার পরিবেশ জনসেবায় গুরুত্বপূর্ণ। সমমর্মিতা অর্থাৎ অন্যের অবস্থানে নিজেকে ভাবতে পারলে প্রতিটি সেবাপ্রার্থীর প্রয়োজনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হবে।
২১.১০.২০১৮