সংকটে স্বস্তির ঋণ

সংকটে স্বস্তির ঋণ

  • অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

অর্থনীতিতে সংকট চলছে। সরকারও বারবার সাবধান বাণী উচ্চারণ করছে। এই সময় আইএমএফের ঋণের সবুজ সংকেত কিছুটা স্বস্তি দেবে। তবে অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য দরকার সংস্কার। আর আইএমএফের পক্ষ থেকে তা থাকল ঋণের স্বীকৃত-অস্বীকৃত শর্ত হিসেবে।

অবশ্য আইএমএফের একটি শর্ত শুরুতে মানতে হয়েছে। সেটা হলো রিজার্ভের হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত ছিল আইএমএফের। বাংলাদেশ সেই আপত্তি মেনে নিয়েছে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের হিসাব জানিয়েছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গতকাল তা থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে। বাকি অর্থে মূলত রপ্তানি ও বিনিয়োগ উন্নয়ন নামের দুটি তবহিল করা হয়েছে এবং শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, তাঁরা যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে ঋণ পেতে যাচ্ছেন। তবে আইএমএফ তাদের প্রধান দপ্তর থেকে যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে সংস্কারমূলক পাঁচটি শর্ত বা করণীয়র কথা উল্লেখ আছে।

আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। তখন পাওয়া যাবে ৪৪৭.৪৮ মিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। ঋণের সুদহার হবে বাজারদর অনুযায়ী। গড় সুদহার হবে ২.২ শতাংশ।

সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বাজেট সহায়তা বাবদ দেড় বিলিয়ন করে তিন বিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। বাকি দেড় বিলিয়ন চাওয়া হয়েছে আইএমএফের নতুন উদ্যোগ, সহনশীলতা ও টেকসই সহায়তা তহবিল (ট্রাস্ট) থেকে।

গত ২৪ জুলাই ব্যালান্স অব পেমেন্ট, বাজেট সহায়তা ও অবকাঠামো খাতের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি পাঠায় সরকার। এই ঋণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর ১৫ দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে। প্রতিনিধিদলটি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফের প্রতিনিধিরা। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী ও আইএমএফ পৃথকভাবে ব্রিফিং করে। দুই পক্ষ থেকেই ঋণের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এবং অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন উপস্থিত ছিলেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবেই আইএমএফের ঋণ পেতে যাচ্ছি।’ আর আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতা রাহুল আনন্দ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশকে রিজার্ভ আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সারা বিশ্বের অর্থনীতি এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল—সব দেশে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রায় সব দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। বৈশ্বিক এই উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতা থেকে যাতে কোনো ধরনের সংকট ঘনীভূত না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফের ঋণ চেয়েছি।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আইএমএফের সফররত দলটি বাংলাদেশ সরকারের সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো বলে তারা আমাদের জানিয়েছে। আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচি নিতে যাচ্ছি।’

এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। রিজার্ভ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রিজার্ভের হিসাব সম্পর্কিত আইএমএফের শর্ত আমরা মেনে নিয়েছি। বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তার থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বাড়িয়েছি। নানা সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে।’

আইএমএফ টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা এরই মধ্যে এই কাজ শুরু করেছি।’

অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আইএমএফ করপোরেট সুশাসন আরো বলিষ্ঠ করা, বর্তমান অবকাঠামোর ওপর তদারকি আরো কঠোর করা এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ঋণদাতাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য আরো বলিষ্ঠ সহযোগিতা ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিতের জন্য আইনি ব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কার করার কথা বলেছে।

পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলেছে সংস্থাটি। অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে। প্রায় ১৪ বছর যাবৎ আমরা এটি করে আসছি। সরকারের সব সময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতিকে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫.১ শতাংশ। এই অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৫.৫ শতাংশ ধরা আছে।’

আইএমএফ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলেছে। অর্থমন্ত্রী এসব খাতের ব্যাপারে বলেন, ‘আমরা প্রতি অর্থবছরে এগুলো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে আমাদের বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ।’

আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার, আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরনো কয়েকটি আইন সংশোধনের কথা বলেছে। অর্থমন্ত্রী জানান, এগুলো চলমান কার্যক্রম। রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানো হবে।

আইএমএফের দেওয়া বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের ব্যাপারে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্থাটির কাছে একটি চিঠি পাঠাবে। সরকারের পক্ষ থেকে চিঠিটি পাঠাবেন অর্থমন্ত্রী। চিঠি পাঠানোর পর ঋণ প্রস্তাবটি আইএমএফ বোর্ডে তোলা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে। তারপর ফেব্রুয়ারিতে মিলবে ঋণের প্রথম কিস্তি।

বিষয়গুলো জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, আইএমএফ তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা এবং চূড়ান্ত বোর্ড অনুমোদন সম্পন্ন করবে। ঋণটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি। এ ঋণ মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে। মোট ঋণের পরিমাণ ৩.৪৬৮ বিলিয়ন এসডিআর। এটি বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফ প্রথম কিস্তিতে ৩৫২.৩৫ মিলিয়ন এসডিআর অর্থ ছাড় করবে। বাকি ঋণ প্রতি ছয় মাসে ৫১৯ মিলিয়ন এসডিআর হিসেবে ছয়টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে। বর্তমান এসডিআর ইন্টারেস্ট রেট অনুযায়ী ঋণের গড় সুদহার ২.২০ শতাংশ।

এসডিআর হলো আইএমএফের তৈরি একটি মুদ্রামান। মার্কিন ডলার, জাপানিজ ইয়েন, ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ড মিলিয়ে এসডিআর তৈরি করা হয়েছে।

মুস্তফা কামাল জানান, ঋণের মোট তিনটি অংশ। এর মধ্যে প্রথম অংশের ৮২২.৮২ মিলিয়ন এসডিআরের জন্য কোনো সুদ দিতে হবে না। ঋণের বাকি অংশের মধ্যে ১৬৪৫.৬৪ এসডিআরের সুদহার নির্ধারিত হবে এসডিআর ফ্লোটিং রেটের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করে। আর বাকি এক বিলিয়ন এসডিআরের সুদহার হবে এসডিআর ফ্লোটিং রেটের সঙ্গে ০.৭৫ শতাংশ যোগ করে।

আইএমএফ প্রতিনিধিরা পৃথক ব্রিফিং করেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তাঁরা। এ সময় স্টাফ মিশনের নেতা রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বেশি। ফলে আমদানি করা পণ্য বেশি দামে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সব মিলিয়ে এ বছর বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ শতাংশে।

তবে অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া নিয়ে আইএমএফের কোনো উদ্বেগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের উন্নয়ন অংশীদারি দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও এই সম্পর্কে কোনো সমস্যা হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *