তরুণ প্রজন্মের মাঝে শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার লক্ষে খুলনার খালিশপুরের তরুণ আলেম সম্প্রদায় আয়োজন করেছে বাংলা বানান প্রতিযোগিতার। উম্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে যখন ব্যক্তি পর্যায় থেকে নিয়ে শুরু করে এফএম রেডিও , টেলিভিশন চ্যানেলের মতো জাতীয় গণমাধ্যমে মাতৃভাষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তখন তরুণ আলেম সম্প্রদায়ের এমন উদ্যোগ সবার নজর কেড়েছে। সমাজের গদবাধা আর দশটি প্রতিযোগিতার চেয়ে এই প্রতিযোগিতা নানা কারণেই আলাদা অর্থ বহণ করছে। কারণ ইতোপূর্বে বাংলা ভাষা নিয়ে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে এমন কোন প্রতিযোগিতার আয়োজন হতে দেখা যায়নি। ভাষা নিয়ে কোন প্রতিযোগিতায় এ দেশের সব শিক্ষামাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। বিশেষভাবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এরকম উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে। তাই সৃজনশীল নিউজ পেপার পাথেয়২৪ এর পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতার অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ আলেম মাওলানা ওমর ফারুকের সঙ্গে কথা হয়েছে তার ভাবনা নিয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ নাঈমুল ইসলাম।
পাথেয় : মাওলানা ওমর ফারুক ! সমাজে এত কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন এখন চলছে সবকিছু বাদ দিয়ে বাংলা বানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করার প্রয়োজনীয়তা কীভাবে মনে ধরলো?
ওমর ফারুক : দেখুন যদিও আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা তবুও দুঃখের সাথেই বলতে হয় আমরা লক্ষ করছি ইদানীং মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে যেমন শুদ্ধ বাংলাচর্চা করছে না তেমনি জাতীয় গণমাধ্যমেও চরমভাবে বাংলা ভাষার বিকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং একজন সচেতন আলেম হিসেবে এই বিষয়টি সবসময়ই আমাকে, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের পীড়া দেয় সেই জায়গা থেকেই আসলে এমন একটি উদ্যোগের কথা মাথায় আসে এবং আমরা একত্র হয়ে এই প্রতিযোগিতার আয়োজনটি করেছি।
পাথেয় : এই যে ভাষার প্রতি আগ্রহ আপনার কি করে হল ?
ওমর ফারুক : আমি জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেছি।সেখানে আমার হাদিসের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম আল্লামা ফরীদ উদ্দন মাসঊদ। তিনি সহ আরও যে সব শিক্ষক ছিলেন সবাইকেই দেখেছি শুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যমণ্ডিতভাবে কুরআন ও হাদিসের পাঠদান করতে এবং তাতে কুরআন ও হাদিসের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনিভাবে তা মানুষের মাঝে সুদূর প্রভাব ফেলে। সেই থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি আমার আলাদা আগ্রহ জন্ম নেয় ।
পাথেয় : আপনি যেহেতু কওমী মাদরাসায় পড়েছেন সেই হিসেবে কওমি মাদরাসায় বাংলা ভাষা চর্চা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
ওমর ফারুক : দেখুন এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে গত একশত বছরে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার শিক্ষা ধারায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষা চর্চা ছিল না বললে অত্যুক্তি হবে না তবে আশার কথা হল এখন সেই অবস্থা নেই। আশির দশকের শুরুর দিকে লাজনাতুত তালাবা নামে একটি সংগঠন কওমি মদারাসার ছাত্রদের মাঝে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা শুরু করে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রচুর ইসলামি লেখক অনুবাদক তৈরী হয়েছে। এখন যারা এই অঙ্গনের পুরোধা তারা প্রায় সকলেই কোন না কোনভাবে এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তারপর ত কয়েক প্রজন্ম এসে গেছে এই আমাদের পর্যন্ত । এখন ত আলহামদুলিল্লাহ্ প্রচুর লেখক সাহিত্যিক কওমি মাদরাসায় তৈরি হয়েছে। এখনো হচ্ছে তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখন যে স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মাদরাসায় পড়ানো হয় আমি মনে করি তা আরও বাড়িয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীত করা দরকার।
পাথেয় : সকলকেই দেখা যায় ফেব্রুয়ারি মাস এলে ভাষা নিয়ে তোরজোড় শুরু হয় এখন ত মার্চ মাস , এই মাসে কেন এই আয়োজন?
ওমর ফারুক : দেখুন শুদ্ধ ভাষা চর্চা ত আর শুধু এক মাসের সাথে সম্পৃক্ত না এটা সারা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় তাই আমরা ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে একমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আমরা চাই এই বিষয়গুলো নিয়ে সারা বছর কোন না কোনভাবে কাজ করতে। তাই এই মাসেই উদ্যোগ আর তারপরও আরেকটা বিষয় হল আমাদের স্বাধীনতার চেতনার সূচনা কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল। সুতরাং স্বাধীনতার সাথে ভাষারও একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
পাথেয় : অন্যান্য আর দশটা প্রতিযোগিতা থেকে আপনাদের এই আয়োজন কেন মানুষের কাছে আবেদন রাখবে?
ওমর ফারুক : কারণ আমাদের এই বাংলা বানান প্রতিযোগিতায় আমরা সর্বজনীনতা আনতে পেরেছি আর তা হল আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষামাধ্যমের বিভিন্নতা দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে। এই যেমন ধরুন, যারা জেনারেল শিক্ষায় পড়াশোনা করছে তাদের সাথে মাদরাসার একটা মানসিক দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করা হচ্ছে। আবার মাদরাসার মধ্যেও আলিয়া মাদরাসা ও কওমি মাদরাসার মধ্যে এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতা কাজ করে এতে করে কিন্তু জাতির ভিতরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে এ দেশের সব মহলই অনেকটা দায়ী। আমরা চাচ্ছি শিক্ষামাধ্যমের বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতাকে দূর করতে। তাই আমরা স্কুল, আলিয়া মাদরাসা, কওমি মাদরাসাসহ সব শিক্ষামাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম আমাদের মাতৃভাষা বাংলার শুদ্ধ চর্চা করার একটি প্রয়াস শুরু করেছি।সে ক্ষেত্রে এই বাংলা বানান প্রতিযোগিতা অনেকটা ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
পাথেয় : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পাথেয় নিউজকে সময় দেওয়ার জন্য ।
ওমর ফারুক : আপনাকে এবং পাথেয় নিউজকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের এই প্রয়াসকে জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য।