সাকরাইন উদযাপন: কী বলে ইসলাম

সাকরাইন উদযাপন: কী বলে ইসলাম

তামীম আব্দুল্লাহ

সাকরাইন উৎসব। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অনাড়নম্বর উৎসব। উপমহাদেশে এই উৎসবকে পৌষসংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি বলা হয়। সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। বাংলা বর্ষের নবম মাস পৌষের শেষদিন এই উৎসব পালন করা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায়ও এ দিনকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের উৎসব আয়োজন করা হয়।

উৎসবের অংশ হিসেবে থাকে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি। সারা দিন ঘুড়ি ওড়ানোর পর সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি টানা হয়।

ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা বসে। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ।

একসময় বাংলাদেশের পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় জমজমাটভাবে উদযাপিত হতো পৌষসংক্রান্তি তথা সাকরাইন। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, লালবাগ ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছোট, বড় সবাই মেতে উঠত এ উৎসবে। বিকেলবেলা এসব এলাকায় আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়ে। ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হতো।

অধিকাংশ সময়ে ভোঁ কাট্টার (ঘুড়ি কাটাকাটি) প্রতিযোগিতা চলত। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজে পার্টি, আতশবাজি, ফানুস ইত্যাদি। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক ভদ্রলোক আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, এটা যদিও বাঙালি ঐতিহ্য, কিন্তু বাংলা গানের কিছুই তো দেখি না। আগে এই অনুষ্ঠানে এত জৌলুসও ছিল না।

বিগত বছরে মিডিয়া ও বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর উৎসবটিকে যেভাবে প্রমোট করেছে, হয়তো এটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেবে।

তখন হয়তো কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করা আমার জন্য জায়েজ হবে কি না? কিংবা এই উৎসবে ইসলামবিরোধী কিছু আছে কি না? তাদের জন্যই আমার আজকের আয়োজন।

সাকরাইন উপলক্ষে ঘুড়ি ওড়ানো : প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাই সামাজিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব ছাড়াও এই দিনটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। পশ্চিম ভারতীয় প্রদেশ গুজরাটে উৎসবটি আরো অনেক বড় আকারে উদযাপিত হয়। তাদের ধারণা মতে মানুষ, সূর্য দেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা বা আকুতিকে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পালন করে ঘুড়ি উৎসব, যা মূলত প্রিয় দেবতার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি রূপক বা প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এসব যে শিরিক তা যেকোনো সাধারণ মুসলমানেরই সহজে বুঝতে অনুমেয়। আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছেই কিছু প্রার্থনা করা যাবে না। পবিত্র কোরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নির্দেশ হয়েছে, আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে ডাকা যাবে না, যে তোমার ভালো করতে পারবে না, আবার মন্দও করতে পারবে না। বস্তুত তুমিও যদি এমন কাজ করো, তাহলে তখন তুমিও জালেমদের (অত্যাচারীদের) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সুরা : ইউনুছ : আয়াত : ১০৬) ইসলামী আকিদামতে, সূর্য আল্লাহর একটি মাখলুক মাত্র। আল্লাহর হুকুম ছাড়া সূর্য আমাদের কোনো ভালো বা মন্দ করার ক্ষমতা রাখে না।

ফানুস ওড়ানো : ফানুস এখন আমাদের দেশের বার বি কিউ পার্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ষবরণেও আমাদের দেশের আকাশে ফানুস দেখা যায়। এনিমেটেড মুভি ট্যাংলেড দেখার পর সবার কাছেই এটি বেশ আকর্ষণীয় জিনিস। কিন্তু এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের পূজা। বৌদ্ধ ধর্মের সংবাদমাধ্যম ‘নির্ভানা পিস’-এ এ ব্যাপারে একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানে তারা লিখেছেন,

“স্বর্গের দেবতারা দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক স্থাপিত চুলামনি জাদীকে এখনো পূজা করেন বিধায় আমরাও প্রবারণা পূর্ণিমার দিন ফানুস উড়িয়ে পূজা করি। ফানুস উড়ানোর অর্থ ঐ চুলামনি জাদীর পূজা করা। প্রদীপ পূজা করা। আমরা বুদ্ধকে প্রদীপ পূজা করতে পারি খুব সহজেই, কিন্তু স্বর্গের চুলামনি জাদীর উদ্দেশে ফানুস উড়িয়ে আকাশে তুলে পূজা করি।”

উল্লিখিত অংশ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, এটি মূলত বৌদ্ধদের একটি পূজা। এছাড়া একেবারে সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি বলি। ফানুসে কেরোসিন দ্বারা প্রজ্বালিত বাতি থাকায় এগুলো অনির্বাপিত অবস্থায় জনবহুল নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পতিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকায় তা ওড়ানো নিষিদ্ধ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কেউ এ নির্দেশনা অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। (সূত্র : যুগান্তর, ৭ জানুয়ারি ২০১৮)

ডিজে পার্টি ও ফায়ার ওয়ার্ক : ইসলাম ধর্মের সঙ্গে তো এর কোনো সম্পর্কই নেই। বরং বাংলাদেশের সংস্কৃতিও এগুলোকে সমর্থন করে না। সাকরাইনের প্রতিবেদনে যুবক-যুবতীদের একসঙ্গে বিদেশি স্টাইলে নাচতে দেখে মনে হয়েছে, আমরা ২০১৯-এ নেই। আমরা ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে ফিরে গিয়েছি।

মূলত ভিনদেশিদের অনুকরণ করতে গিয়ে আমরা দিন দিন অধঃপতনের দিকে চলে যাচ্ছি। অথচ হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ইবন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো কাওমের (সম্প্রদায়ের) অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ : ৪০৩১)

তাই ফানুস, ডিজে পার্টি, ফায়ার ওয়ার্ক ইত্যাদি করার আগে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিক।

 

লেখক, তরুণ আলেম ও সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *