সাকিব-মোসাদ্দেকের ব্যাটে উজ্জ্বল বাংলাদেশ

সাকিব-মোসাদ্দেকের ব্যাটে উজ্জ্বল বাংলাদেশ

খেলা প্রতিবেদক ● দিনের খেলা শেষে তিনি ড্রেসিংরুমে একটু বসতেও পারেননি। তাঁকে খুঁজে নিল সিরিজ সম্প্রচারক টেন স্পোর্টসের ক্যামেরা। ওটা সরতেই কৌতূহলী ক্রিকেট জনতা। ছোটদের অটোগ্রাফের আবদার, তাঁর একটু কাছে গিয়ে ধন্য হওয়ার ইচ্ছা। তিনি সাকিব আল হাসান, দারুণ এক শতকে শততম টেস্টে বাংলাদেশের ভালো কিছু পাওয়ার আশাটা উজ্জ্বল করে তোলার নায়ক।

কাল তৃতীয় দিনে কলম্বোর গোধূলিটা ছিল মেঘমুক্ত। যেমন আপাত মেঘমুক্ত দেখাচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। সাকিবের পঞ্চম টেস্ট সেঞ্চুরির সঙ্গে মুশফিকুর রহিমের ১৭তম ফিফটি এবং অভিষেকেই মোসাদ্দেক হোসেনের ঝলমলে ৭৫ রানের কল্যাণে বাংলাদেশ লিড পেয়ে যায় ১২৯ রানের। রেকর্ড বলছে, ২০১৩ সালের সেই গল টেস্টের পর এটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো লিড। দেশের বাইরে সবচেয়ে বড়। এর আগে ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০৯ রানই ছিল সর্বোচ্চ লিড।

আগের দিনের শেষ বিকেলে ব্যাটসম্যানদের সেই ভয়ংকর উন্মাদ ব্যাটিংয়ের পর বাংলাদেশ এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, বাজি ধরে বলা যেতে পারে, কেউ ভাবতে পারেনি। কিন্তু কী করে এটা সম্ভব হলো? সাকিব বলে গেলেন, রান করাটা দরকার ছিল, সেটি তাঁরা করতে পেরেছেন বলে তৃপ্ত।

এই তৃপ্তিটাকে ছোঁয়া গেছে উইকেটটাও ভালো আছে বলে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৩ ওভার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে শ্রীলঙ্কাও বিনা উইকেটে ৫৪ রান তুলে বুঝিয়ে দিয়েছে উইকেটের আচরণ। তবে এই উইকেটে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ তো আর শুধু শ্রীলঙ্কান বোলাররাই নন, আরেক পক্ষের নাম অনন্ত চাপ। আগের দিন ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাবীরা বলে গিয়েছিলেন, প্রথম সেশনটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রথম ঘণ্টা। সঙ্গে চাপটাকেও একটু বাড়িয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম ঘণ্টায়ই সেই চাপ খসিয়ে ফেললেন সাকিব-মুশফিক। ১৫ ওভারে রান এল ৬১। রানরেট চারেরও বেশি। মুশফিকই অগ্রণী ভূমিকায়। আর সাকিব একেবারেই বদলে যাওয়া মানুষ। সেই উগ্রতা নেই, তাড়াহুড়ো নেই। মারার বল পেলে মারো, ছাড়ার বল ছেড়ে দাও। শট খেলার নেশাটা বোধ হয় পেয়ে বসেছিল মুশফিককে। দ্বিতীয় নতুন বলে পেসার সুরঙ্গা লাকমলের ওভারের প্রথম বলে ড্রাইভ খেলতে গেলেন অধিনায়ক, ইনসুইঙ্গার উপড়ে দিল স্টাম্প। তবে এর আগেই পাওয়া হয়ে গেছে তাঁর ১৭তম ফিফটি, আর ষষ্ঠ উইকেটে এসে গেছে ৯২ রান। বেশ নিরাপদ জায়গা। শ্রীলঙ্কা তখনো ৪৮ রান দূরে। এমন অবস্থায় কতবার পা হড়কানোর সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ দল।

কিন্তু কোথায় পা হড়কানো? অভিষিক্ত মোসাদ্দেক যেন রোলার স্কেটার পায়ে সাকিবের সঙ্গী হয়ে ছুটিয়ে নিয়ে গেলেন রানের চাকা। সাকিব রয়েসয়ে খেলেন তো দুর্দান্ত ক্রিকেটিং শটে ছক্কা হাঁকান মোসাদ্দেক। এই করে করে রান বাড়তে থাকল তো বাড়তেই থাকল। এরই মধ্যে সাকিব ৭ ইনিংস পর পেয়ে গেলেন আরেকটি সেঞ্চুরি, অফ স্পিনার দিলরুয়ান পেরেরাকে চার মেরে। নিজের পঞ্চম টেস্ট সেঞ্চুরির পর সাকিব একটু আস্তিন গুটিয়ে আসরে নামতে চেয়েছিলেন। যে লক্ষ্মণ সান্দাকান কমবেশি জ্বালিয়েছেন, তাঁকেই মিডঅনের ওপর দিয়ে তুলে দিয়েছিলেন, বল ততটা ওঠেনি। দিনেশ চান্ডিমালের দুর্দান্ত এক ক্যাচে শেষ সাকিবের ১১৬ রানের ইনিংস, যাতে আশ্চর্যজনকভাবে কোনো ছক্কা নেই, চার ১০টি। সাকিব-মোসাদ্দেকের ১৩১ রানের সপ্তম উইকেট জুটিতে ৪২১ রানে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। তখন আবার সামনে এসে দাঁড়ায় আরেক মাইলফলক। ১০০ রানের লিড হবে তো? সেটিও হলো মোসাদ্দেক-মিরাজের ৩৩ রানের জুটিতে। শেষ পর্যন্ত ১২৯ রানের লিড!

কী তৃপ্তিদায়ক, কী জ্বলজ্বলে। একটু ছায়া ছায়া সকাল কিংবা দুপুরে সাকিব হয়তো সামান্য আড়ালে ঠেলে দিয়েছেন মোসাদ্দেককে। তা না হলে মোসাদ্দেককে ঘিরেই রচিত হতো প্রশস্তিগাথা। ২১ বছরের তরুণ যেন টেস্টের জন্য একেবারেই তৈরি হয়ে এসেছেন। প্রেসবক্সে শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকেরা বারবার বলছিলেন, ছেলেটির তো আগেই টেস্ট অভিষেক হওয়া উচিত ছিল। অভিষেকেই ফিফটি করেছেন মোসাদ্দেক, যোগ্য সঙ্গীর অভাবে না পড়লে প্রথম ফিফটিটিকে হয়তো তিন অঙ্কেই রূপ দিতেন। শেষ পর্যন্ত দলের শেষ উইকেটটিই কিনা তাঁর! হেরাথের বলে স্টাম্পড হওয়ার আগে ৭৫ রানের ইনিংস সাজিয়েছেন সাতটি চার এবং দুটি অনায়াসলব্ধ ছক্কায়।

সফরে এখনো পর্যন্ত উজ্জ্বলতম দিনটিতে ওই হেরাথই একটু কাঁটার খোঁচা দিয়েছেন। ১২৯তম ওভারের প্রথম দুই বলেই এলবিডব্লু করেছেন মিরাজ ও মোস্তাফিজকে। তাঁকে হ্যাটট্রিক-বঞ্চিত করেছেন শুভাশিস। হেরাথ ওরকম হন্তারক না হয়ে উঠলে বাংলাদেশ লিড নিতে পারত আরও। দিনের বাকি ১৫ ওভার কি ব্যাট করা যেত না?

হয়তো যেত, হয়তো না। তারপরও এটি মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না, মুশফিকের দল কাল হোটেলে ফিরেছে উপচে পড়া একটা তৃপ্তি নিয়ে। এমন দিন বাংলাদেশ দলের কাছে খুব বেশি আসেনি। এই সুন্দরের ধারাবাহিকতায় ফিল্ডিংয়ে আজ যদি আরেকটি দিন যায়, তাহলে কী হতে পারে, সেটি আপনারাই ভেবে দেখুন!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *