মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান : ১৯৪৭ সাল। উপমহাদেশের ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণ। এর আগে পৃথিবীতে বহু বিচিত্র ঘটনার জন্ম হয়েছে। তবুও সাতচল্লিশের ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হয় আরো বহু বিস্ময়কর বৈচিত্র ইতিহাসের উদরে রয়ে গেছে। ৪৭ থেকে ২০১৮ একাত্তর বছর। পৌনে এক শতাব্দী। অতীতের বিরাট সময়ের তুলনায় খুব সামান্য কিছু মুহূর্ত যেন। প্রায় শত বছর আগের ঘটনাবলী সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন ও বিচার বিশ্লেষণের জন্য ৭১ বছরের এ সংক্ষিপ্ত সময় তবু যথেষ্ট বিরতি বলে ধরা যেতে পারে।
যারা চায় অতীত থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে তারা খুব উপদেশের সুরে বলেন, এই এতদিন পর ৪৭ নিয়ে আলোচনায় কি কাজ? যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। ইতিহাস বিমুখতা বা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একটা জাতির জন্য কত বড় ক্ষতিকর বিষয় তা তারা বোঝেন না বা বুঝেও না বোঝার ভান করেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের অন্ধ করে রাখতে চান।
উপমহাদেশ। যা আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে একটি মহাদেশের সমান। পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর। উত্তরে শ্রীনগর থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত ভারতবর্ষ। এই বিরাট আয়তনের দেশটিতে অতীত হয়েছে মহেঞ্জদরো ও হরপ্পার মত প্রাচীন সভ্যতা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছাড়াও প্রায় তিন হাজার বছরের ধারাবাহিক এক ঐতিহ্য আছে। বিশেষত ইসলামের পয়গম্বর মহানবী সা.এর শুভাগমনের পর পৃথিবীতে এক নবজাগরেণর সূচনা হয়। গঙ্গা অববাহিকায় নবীজির জীবতকালেই সে জাগরনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বেড়ে ওঠা নতুন মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্পর্কেও এসে যায় ভারত বর্ষ। গুপ্ত, মৌর্য যুগের পর পাল চৌল ও রাষ্ট্রকুটদের কালে যে এক স্থবিরতা ভারতের সমাজে সংস্কৃতিতে গেড়ে বসে ছিল তা থেকে পরিত্রাণের পথ প্রস্তুত হয়।
জনবহুল এ ভুখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানের গৌরবময় এক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে গাঙ্গেত্রয় অঞ্চলে। ইসলামের উদারতা, ন্যায়বিচার, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সাথে সদাচারণের প্রেরণা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব শান্তিপ্রিয়তা প্রভৃতি সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এরই প্রভাবে হিন্দুদের ভেতর ইসলামের প্রচার প্রসার ঘটতে থাকে বিস্ময়কর দ্রুততায়। ইতিহাসের বিভিন্ন বাকে ঘুরি, খিলজি, লোধি, মোঘল দক্ষিণ এশিয়া থেকে নব উত্থিত রাজনৈতিক বেশ কিছু মুসলিম শক্তির রাজ্য জয়ের নেশার কারণে ইসলামের প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়েছে সত্য। কিন্তু ইসলাম অসহিষ্ণুতার ধর্ম এমন অপবাদ কোন শত্রুও দিতে পারেনি কখনো। ১৯৪৭ সালে এই প্রথম ইসলামের ওপর এমন ধাব্বা লাগানোর চেষ্টা। চেষ্টা করা হয় ইসলামকে অসহিষ্ণু ও বর্বর রূপে বিশ্ববাসীর সামনে মেলে ধরার। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয় যেন ভারতবর্ষের হিন্দু জৈন বৌদ্ধ শিখ পার্সি পাহাড়ি আদিবাসী প্রভৃতি সকল জাতি এক ভুখণ্ডে সহাবস্থানে তাদের কোন সমস্যা নেই। কেবল বিশ্বধর্ম ইসলামের অনুসারীরাই হাজার বছর ধরে যাদের মাঝে অবস্থান করে এসেছে তাদের সাথে সহাবস্থানের হার্দিক সামর্থ্য তাদের আর নেই। নৈতিকভাবে মুসলিম সমাজের এর চেয়ে বড় অধপতন আর কিছুতেই ইতিহাসের কোথাও কোন ভাবে প্রমাণ করা যাবে না।
১৯৩০ এর দশক থেকে শুরু হয়েছিল ভারত ভাগের এ তত্ত্ব নিয়ে উদভ্রান্ত তাত্ত্বিকদের পথ চলা। ১৯৩০ সালে ইলাহাবাদে লীগের কনফারেন্সে আল্লামা ইকবাল প্রথম দাবি করেছিলেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য। তারপর ধীরে ধীরে এক জাতিতত্ত্ব দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের এ দেশীয় একদল চর কোরআন হাদিস ফিকাহ ঘেটে তাদের মতলবে কাজে লাগে এমন সব খতি উদ্ধৃতি জমা করতে থাকে। এসব আলোচনা পর্যালোচনার জোয়ারে ভেসে যায় সে সময়ের রাজনীতি। ইসলামের রাষ্ট্র দর্শন নিয়ে এমন ধোয়াশা সৃষ্টির পায়তারা করতে থাকে মওদুদী গং। ইসলামকে অস্বাভাবিক অসহিষ্ণুুবর্বর প্রমাণে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সভা সমাবেশে গর্জে ওঠেন মাওলানা মাদানী। ধর্মের নামে দেশ ভাগ করার তত্ত্বের ওপর প্রচন্ড আঘাত হানতে থাকেন। মদিনা সনদ বিশ্লেষণ করে ইসলামের উদারনৈতিক মানবিক স্বভাবজ রাষ্ট্রচিন্তা খোলাসা করে উপস্থাপন করতে থাকেন। ১৯৩৭ সালের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের এক সভায় এবিষয়ে যে বক্তব্য দেন তা তৎকালীন ভারতীয় দৈনিকে শিরোনাম হয়। আর সে সময়ে আল্লামা ইকবাল তার তীর ছুড়ে দেন মাওলানা মাদানীর দিকে। মাদানী রহ.এর কুতসায় রচিত তার কবিতার তর্জমা দিয়ে দেয়া হলো-
অনারবরা আজও ধর্মের গভীরে পৌঁছতে পারল না
তা না হলে দেওবন্দের হুসাইন আহমদের মুখে এমন বিস্ময়কর কথা কেন প্রকাশ পাবে?
মাওলানা মিম্বরে উঠে বলে ফেলল যে দেশের ভিত্তিতে জাতীয়তা হয়
হায় সে (মাদানী) রাসূল সা.এর মর্যাদা সম্বন্ধে কোন ধারণাই রাখে না
তুমি নিজেকে রাসূলের সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর কেননা তিনিই পূর্ণ ধর্ম
যদি তুমি জাতীয়তার প্রশ্নে রাসূলের মতে মত না দাও
তাহলে তোমার সব কর্ম আবু লাহাবের মত কুফরী-শিরকী হয়ে যাবে
ইরানী কবি হাফিজের একটি কবিতা কাটছাট করে লেখা এ কবিতায় কাব্যরস কতটুকু আছে তা পাঠকই বিচার করতে পারবেন। অনুবাদ টা একটু ভদ্রোচিত হয়ে গেছে হয়ত। মূল ফার্সি কবিতাটি যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন কতটা স্থূল আক্রমণ করেছেন আল্লামা। মসজিদে নববীতে রাওজায়ে আতহারের পাশে ১৮ বছর হযরত মাদানী হাদিসের দরস দিয়েছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের ৩০ বছর বুখারী পড়িয়েছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে মাল্টার কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন চার বছর। আরও বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন কয়েদখানায়। ইসলাম ও মুসলমানের জন্য তাঁর এক জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের বর্ণনা দিতে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা লেখা যেতে পারে। এমন একজন জ্ঞানতাপস বিপ্লবী বুযুর্গ মনীষীকে ইত্তিবায়ে রাসূলের উপদেশ দিচ্ছেন অক্সফোর্ড ফেরত ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী এই আল্লামা। কি পরিমান বিকার তা সহজেই বুঝতে পারছেন। এ ধরনের বিকারগ্রস্থ মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত যে তত্ত সে তত্ত্বের ধারক উন্মত্ত জনগোষ্ঠি সম্পর্কে ধারণা দিতে একটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট হবে।
বিগত একশত বছরে মুসলিমবিশ্বে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ ফাজায়েলে আমাল। এ গ্রন্থেও লেখক তার নিজের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আপবীতীতে। খুশবন্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান থেকে উদ্ধৃত নয়। দেশভাগ নিয়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে বা পার্টিশন সাহিত্য বলে যা সৃষ্টি হয়েছে এমন কোন বই থেকে উদ্ধৃত নয়। এ ঘটনার সাক্ষ্য স্বয়ং একজন নিরেট হাদিস বিশারদ আল্লাহভীরু মহান বুজুর্গের। যিনি কোনো অতিরঞ্জিত কথা বলেছেন এমন ধারণা করা যায় না। এ বুযুর্গের নাম শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.।
৪৭ এর ১৫ আগস্ট তিনি দিল্লির নিজামুদ্দিনে অবস্থান করছিলেন। তখন চলছিল রমজান মাস। ১৫ আগস্ট রাত ছিল শবে কদরের রাত। ৭ আগস্ট বোম্বের বিরাট প্রাসাদ ছেড়ে হিমারে আজম গাদ্দারে কওম জিন্না পাকিস্তান হিজরত(?) করেন। ৪৬ এর আগস্ট থেকেই বছরব্যাপী দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল। বিশেষত বাঙলা বিহার পাঞ্জাবে সারা বছরই হত্যা লুটপাট চলেছে। কিন্তু সাহরানপুর মুজাফফরনগর থানভন দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। রমজানের শুরুর দিকে জিন্না খলীকুজ্জমানসহ লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে চলে যাবার পর সারা দেশে থেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে নতুন কল্পরাজ্যে যাবার হিড়িক পড়ে যায়। দিল্লি থেকে প্রত্যেকদিন তখন একটা করে স্পেশাল ট্রেন লাহোর যেতো। প্রচন্ড ভিড় হত সে ট্রেনে। আগে-পিছে সেনা বাহিনীর কড়া পাহারা থাকতো। তবু সারা পথে যা হামলা হবার তা হতোই। লাহোর থেকেও অনুরূপ একটি ট্রেন প্রতিদিন দিল্লি আসতো। লাহোরের উদ্দেশ্যে যে ট্রেনটি ছাড়তো তা নিজামুদ্দিন মারকাজ সংলগ্ন স্টেশন থেকে ছেড়ে যেত। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর চারমাস সপরিবারে দিল্লি ছিলেন। দাঙ্গা হাঙ্গামায় মার্কাজ থেকে বের হতে পারেননি। সেই রমজানে নিজামুদ্দিনে মুফতি মাহমুদ গাংগুহী, মনজুর নোমানী সহ ভারতের আরো বহু প্রখ্যাত আলেম অবস্থান করছিলেন। তাবলীগের তৎকালীন আমীর পাকিস্তানে হিজরতের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা করতেন। তিনি বলতেন তোমরা কেউ ভারত ছেড়ে যেও না। ভারতের মানুষের মরতে হলে পাকিস্তানিরা কি মারবে না?
বোম্বের বড় বড় শেঠ কদিন পর পর ২৫ থেকে ৩০ টা বিমানের টিকেট এনে হযরতজী ইউসুফ রহ.কে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত। তারা বলতো এখন তো ভারত হিন্দুর দেশ। মুসলমান সব পাকিস্তান চলে যাচ্ছে; আপনি ওখানে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করবেন। ওখানে আপনার জন্য সুবন্দোবস্ত করা আছে। নানান প্রলোভনও দেখাতো তারা। মাওলানা জাকারিয়া রহ. এর ভাষায় কিয়ামতের ন্যায় বিভীষিকার ভেতর এমনতরো বহু ঘটনা তখন দিল্লিতে ঘটত।
পাকিস্তানগামী প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার পূর্বে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. বলেন, দেখা যেত প্লাটফর্মে ৮০/৮৫টি দুধের বাচ্চা পড়ে আছে। এই অবোধ অসহায় শিশুদেরকে তাদের বাপ মা এভাবে প্ল্যাটফর্মে ফেলে ইসলামী রাষ্ট্রে হিজরত করে যাচ্ছে। হযরত শায়েখ তাদেরকে জিজ্ঞেস করতেন এ তোমরা কি করছ? নিজের সন্তানকে ফেলে যাচ্ছো? মুসলিম লীগী অমানুষরা তখন যে জবাব দিত তা প্রকাশ করতে শাইখ লিখেছেন- বেদরদী কে সাথ- অর্থাৎ চরম নিষ্ঠুর ভাবে তারা বলতো, সহি-সালামতে পাকিস্তান পৌঁছতে পারলে বহু বাচ্চা জন্ম দিতে পারব; ভিড়ের ভেতর এই বোঝা বহন করে ঝামেলা বাড়িয়ে কি কাজ?
এই ছিল তাদের উত্তর। ইকবাল ও জিন্নার অনুসারীদের এই মস্তিষ্ক বিকৃতির বিশ্লেষণ ঐতিহাসিকরা কিভাবে করবেন তা আমাদের জানা নেই। আমরা তো ভেবে পাই না- এখনো যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি তাদের অটল আস্থায় সামান্য আঘাত বরদাশত করতে পারেন না কোন দুনিয়ায় তারা বাস করছেন? কোন ইসলামের তারা স্বপ্ন দেখেন? ইসলাম বলতে তারা কি বোঝেন? জানিনা আর কত রক্তের বন্যা বওয়ার পর তাদের বোধোদয় হবে!
পরবর্তী অনেক গবেষকই প্রমাণ করেছেন জিন্না মানসিক ভারসাম্যহীন এক অসুস্থ এবং উন্মাদ ছিলেন। এমন উন্মাদের পেছনে যারা ছুটেছে তাদের ভিতর উন্মাদনা এসে যাওয়াই স্বাভাবিক। শাইখুল হাদীস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন- বিভাগ পূর্ব শেষ রমজানের আগের রমজান অর্থাৎ ৪৬ এর আগস্ট মাসের পুরো সময় মুসলিম লীগ গুন্ডারা দল বেঁধে বেঁধে এ সব স্লোগান দিত- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, মরকে লেঙ্গে পাকিস্তান, মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান, যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, জীবন নিয়ে, রক্তের বন্যা বহায়ে পাকিস্তান হাসিল করবো। সারাদিন ওই সব স্লোগান তাদের মুখে ফিরত। রমজানের ২৭ এর রাতে যেদিন পরের বছর পাকিস্তানের জন্ম হলো র্যাডক্লিফ ও মাউন্টব্যাটেনের রেখা টানার মাধ্যমে; সেই রাতেও সারা রাত এই জপ মালা। হযরত শায়েখ তাদের বারবার নিষেধ করলেন যে, এই পবিত্র রাতে অন্তত এমন কথা মুখে এনো না। পাকিস্তান চাও সে কথা বলো কিন্তু রক্তের কথা বলো না। তোমাদের মুখের কথা কবুল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মুসলিম লীগী উন্মাদদের নেতা তখন জিন্না। মৌলবিদের কথা শুনার মত ধৈর্য তাদের নেই। সুতরাং তাদের দোয়া ঠিকই কবুল হলো। পরের বছর শবে কদরের রাতে পাকিস্তান তারা পেল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের রক্তের ভেতর দিয়ে উঠল পাকিস্তানের ভয়ঙ্কর সূর্য।
১৫ই আগস্ট রাত পোহানোর পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পথে নেমে বীভৎসতার চিত্র গুলো দেখে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ লিখেছিলেন,
ইয়ে দাগ দাগ উজালা
ইয়ে শবগুজিদা সেহের
ওহ ইন্তিজার থা জিসকা
ইয়ে ওহ সেহের তো নেহি
ইয়ে ওহ সেহের তো নেহি
জিসকি আরযু লে কার চলে থে ইয়ার
কি মিল জায়েগি কাহি না কাহি
এই মসি লিপ্ত আলো/ এই রাতের আঁধারে আচ্ছন্ন সকাল /যে সকালের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল /এতো সেই ভোর নয় /যে প্রভাত আলোকের স্বপ্ন নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম /এটা তো সেই সকাল নয়/ ভেবেছিলাম, কোথাও না কোথাও একটু আলোর দেখা পেয়ে যাব/ কিন্তু কোথায় উজ্জল ঊষার সূর্যরশ্মি? কোথায় সেই স্বপ্নময় ভোর?
১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের পর লীগের নেতারা দ্বিজাতিতত্ত্বের দর্শন প্রচার করে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে নতুন করে। মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীও প্রতিটি সভা ও মাহফিলে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির গুরুত্ব বর্ণনা করতে থাকেন। এ সময় তার একটি বক্তব্য বিকৃত করে লীগের কয়েকটি দৈনিকে ছাপা হয়। তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে যায় মুসলিম লীগী মহলে।
কবি ইকবাল তখন রোগশয্যায়। সে অবস্থায় হোসাইন আহমাদ নামে তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি লেখেন। ইকবাল কাব্য সমগ্রের একদম শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় আরমুগানে হিজায কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যা ছাপা হয়। এসব বিতর্কের পর মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী তার ঐতিহাসিক ইসলাম ও একজাতি তত্ত্ব বই লিখে ইসলামের সঠিক চেতনা বিশ্লেষণ করেন। দুঃখজনক হচ্ছে স্যার ইকবাল এই বইটি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৩৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
এ সময় মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. বেঁচে ছিলেন। মুসলিম লীগীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হীন উদ্দেশ্যে মাওলানা থানভী রহ.এর কিছু একান্ত জনকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে লীগের রাজনীতিতে আনতে সমর্থ হয়। এদের ভিতরে মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী ও মাওলানা মুফতি শফি রহ. অন্যতম। এর ফলে সারা দেশে থানভী সিলসিলার অনেক আলেমই মুসলিমলীগে যুক্ত হয়ে যান। শুরু হয়ে যায় মূল ধারার জাতীয়তাবাদী আলেমদের প্রতি গালাগালির তুফান। লীগের পক্ষ থেকে দেওবন্দী আলেমদেরকে মুসলমানের শত্রু আখ্যা দেয়া হতে থাকে। এক শ্রেণীর আলেম বিভিন্ন ফতোয়ার বানে বিদ্ধ করতে থাকে মাদানী ও দেওবন্দীদের। মাদানী থানবী দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সেখান থেকেই। ১৯৩৮ সালেই জাকারিয়া রহঃ লিখেন তাঁর সাড়া জাগানো বই আল ইতিদাল। এ বইয়ে তিনি দুই পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। মতানৈক্য সত্তেও হক্কানী আলেমদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তা বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভেতর কান্দলা সাহারানপুর ও দেশজোড়া তাবলীগের শীর্ষ বুযুর্গ শাইখ জাকারিয়া রহ.এর নিজস্ব চিন্তাধারা প্রচ্ছন্ন থেকে যায়।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পাস হয়। যা পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে বিখ্যাত হয়। সাহারানপুর লীগের তৎকালীন সদর ছিলেন মানফাআত আলী নামে জনৈক উকিল সাহেব। শেখ জাকারিয়া রহ.এর বাবা মাওলানা ইয়াহিয়া কান্ধলভীর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। উকিল সাহেব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতে শেখের কাছে পত্রের মাধ্যমে জানতে চান বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শেখের মতামত কি? তিনি দেশ ভাগের পক্ষে না বিপক্ষে? উকিল সাহেব আশ্বস্ত করেন তিনি কাউকে এ কথা জানাবেন না। শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রহ.এর পত্রোত্তরটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রাখে। তিনি তাতে লিখেছিলেন,
এই অধম রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই রাখে না। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া রাজনীতিকদেরই কর্ম। কিন্তু আমার যে কথাটি বুঝে আসে তা হচ্ছে দো আবা অর্থাত গঙ্গা-যমুনার মাঝের যে অঞ্চল হযরত নানুতুবি গাঙ্গুহি এবং থানভী রহ.এর বরকতে দীন ইলম আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার প্রাণ কেন্দ্র হয়ে আছে- সারা পৃথিবীতে এর কোনো দৃষ্টান্ত নাই। দেশ দ্বিখ-িত হলে পাকিস্তানের ভাগে পড়বে যে অংশ সেখানে এ সকল মনীষীর কোন বিকল্প অনুপস্থিত। এবং সেখানে এমন কোন ধর্মীয় কেন্দ্র তৈরি হবে সে আশাও করা যায় না।
আপ বীতি ৫এ এ পত্রের স্মৃতিচারণ করে দেশভাগের পরের অবস্থা উল্লেখ করে লিখেন, আমি যা ভেবেছিলাম তা-ই হলো। দেওবন্দ সাহারানপুর এর প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও আগের মতই আছে কিন্তু পাঞ্জাব সিন্ধু বাংলাদেশ প্রভৃতি অঞ্চলের ছাত্রদের এখানে আশার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পূর্ব পাঞ্জাবের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আলা হযরত রায়পুরী রহ. এর পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো চলতো এসবই দেশভাগের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে।
খৃ. দ্বাদশ শতক থেকেই দিল্লি মুসলিম প-িতদের প্রাণ কেন্দ্র। ত্রয়োদশ শতকে নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ও আমির খসরু প্রমুখ সুফিদের বদৌলতে আধ্যাত্মবাদেরও কেন্দ্রিয় নগর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। মোজাদ্দেদে আলফেসানী শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর পর শাহ অলিউল্লাহ ও মির্জা মাজহার জানে জানার কর্মক্ষেত্রও এই দোয়াবা অঞ্চল।
স্যার সৈয়দ আসারুস সানাদীদ গ্রন্থে ১৮৫৭ সালের আগে-পরের দিল্লির জ্ঞান বিজ্ঞান সুফিবাদ ও আরবি ফারসি ও উর্দুসাহিত্য চর্চার চিত্র অঙ্কন করেছেন। ১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ, মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর, শাহী মোরাদাবাদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে কান্ধলায় কয়েক শত বছর ধরে একটি ধর্ম চর্চার ধারা চলে আসছিল। শাহ গোলাম আলী রহ. দিল্লিতে নকশবন্দীয়ার ধারাকে গতিশীল করেন। চিশতিয়া তরীকার ভেতর নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ.। এবং তা ছিল থানা ভবনে।
উল্লেখ্য এসব ইলমি ও দ্বীনী মার্কাজ ছিল যমুনা ও গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় এসব অঞ্চলের আল্লাহওয়ালা বুজুর্গরা সবাই ছিলেন দেশভাগের বিরুদ্ধে। ব্যতিক্রম কেবল থানা ভবন। মাওলানা থানভী তখন অশীতিপর বৃদ্ধ। ৪০এর দশকের কিছু পূর্ব থেকে হজরত থানভী রহ.এর কয়েকজন খলিফা থানাভন থেকে হযরতের নামে বিভিন্ন বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। এর ভেতর কিছু বক্তব্যে তার সম্মতিও থাকতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৪৩ সালে মাওলানা থানভী রহ ইন্তেকাল করেন। তখনও দেশভাগের পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পায়নি। তিনি যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন আর লীগী গু-াদের পরবর্তী কাজকর্ম দেখতেন তাহলে লীগের ব্যাপারে তার মতামতে যে পরিবর্তন আসত সে কথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা চলে। কি হলে কি হত আর কি হতো না এ আলোচনায় সব ঐতিহাসিকই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেছেন। পাকিস্তান পন্থী কিছু রাজনীতিকও সরলমনা বাঙ্গালীদের ধোঁকা দিতে এই যদির ফেরে ফেলে উল্টা বুঝাতে চায়। তারা বলে যদি ৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হতো তাহলে একাত্তরে বাংলাদেশ হতো না।
এ প্রস্তাবে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। আসলেও কি তাই? পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না? উত্তরে বলব, বাস্তবেই তাই; পাকিস্তান না হলে বর্তমান খণ্ডিত বাংলাদেশ হতো না। কিন্তু বর্তমানের চেয়ে অবশ্যই উতকৃষ্ট কোন বাঙলাই হতো আমাদের প্রাপ্য। পাকিস্তান না হলে বিকল্প দুটি সম্ভাবনার যে কোনটিই আমাদের জন্য কল্যাণ বৈ অকল্যাণের হত না। এক সময় বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিশাল ভ’খন্ড নিয়ে সোবায়ে বাঙাল ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়েও বঙ্গের এ বৃহত্তর সীমানা বহাল থাকার বিষয় সাধারণ পাঠক সবারই জানা কথা। ত্রিপুরা মণিপুর আসাম ওড়িয়া ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষা বাংলা এখনো আছে। বাংলা ভাষাভাষী বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে এক জাতি না হলেও পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ আসামকে নিয়েও যদি শরৎ বসু ও অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক নেতৃবৃন্দের প্রস্তাব মানা হতো তাতেও ভারতবর্ষের জাতীসমূহের মাঝে সমৃদ্ধতর জাতি হতে পারত বাঙালি।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু অববাহিকায় মহেঞ্জদর নামক প্রাচীন সভ্যতার সূচনার পর ধীরে ধীরে গাঙ্গত্রেয় অঞ্চলে নতুন নতুন সভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে। উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতে দুই ধারায় অগ্রসর হয় ভারতীয় জাতিসমূহের উত্থান। একই সময় পূর্বদিকেও বসতি বাড়তে থাকে এবং ভারতবর্ষের উর্বরতম অঞ্চল বাংলায় বিকাশ হতে থাকে একটি শক্তিশালী জাতিসত্তার।
হিন্দুকুশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিশাল ভুখন্ড ক্ষমতার পালা বদল হয় প্রত্যেক সহস্রাব্দে। তক্ষশীলা থেকে নালন্দা পর্যন্ত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। গান্ধারী উজ্জয়নী পাটলিপুত্র প্রভৃতি বহু অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ। ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। বাঙালি জাতির জন্য এক টার্নিং পয়েন্ট। সময় ছিল পূর্ব ভারতের আসমুদ্র হিমাচল এর চির অবহেলিত নিপীড়িত বিরাট জনগোষ্ঠীর নব উত্থানের। সত্যিকারার্থে ৪৭ সালে পাকিস্তান না হয়ে যে কোন বিকল্পে বাঙালিই হতো সবচে বেশি লাভবান। (যেমন এখন পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়ে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালি।) এই সত্য গুজরাটের দুই নেতা গান্ধী জিন্না এবং উত্তর ভারতের হিন্দু নেতৃবৃন্দও বুঝতে পারছিলেন। এজন্যই চিত্তরঞ্জন ও সুভাষকে কোনরূপ সুযোগ দেয়নি কংগ্রেস। একই ভাবে মুসলিমবাংলার শেরে বাঙলাকে কৌশলে বাংলার মসনদ থেকে হটানো হয়। ইংরেজরাও ভয় পেত দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কোন বিরাট জাতিসত্তার উত্থানে।
প্রথম বিকল্প এর কথা সংক্ষেপে বললাম। দ্বিতীয় বিকল্প ছিল ক্রিপ্স এবং ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে অখন্ড ভারতে ফেডারেশন তথা যুক্তরাজ্য গঠন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ শেষ সময় পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। সেখানে একটি দুর্বল কেন্দ্রের অধীনে ভারতের জাতিসমূহের স্বায়ত্ত শাসনের কথা ছিল। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও জমিয়তের প্রস্তাব অনুসারে যদি পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ চার ভাগেও ভাগ করা হতো তাতে বাঙালি সবচে বড় জাতি হিসেবে ভারত শাসন করার সুযোগ পেত। আর বাঙালির ভেতর মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এভাবে পুরো ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘু হয়েও রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারত ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন না হলে। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় সচেতন ভাবেই এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছিলেন। মুসলিম ইয়াহুদী নাসারা মুশরিক এভাবে ভাগ করেন নি। বানু নাজির, বানু কুরাইজা, আউস, খাজরাজ, বানুন্নাজ্জার, কাইনুকা, বানু আউফ প্রভৃতি গোত্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল মদিনা সনদ। বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে সাম্প্রদায়িকতার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠে। তখন যোগ্যতা বা দক্ষতার মূল্যায়নের বদলে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মন মানসিকতা। বিশেষ ধর্মের অনুসারী হওয়ার বিনিময়ে অন্যায্য পার্থিব সুবিধা ভোগ করার মতাদর্শের মত বর্বর কোন রাষ্ট্রদর্শন হতে পারে না। লীগী রাজনীতিকরা ইসলামের ওপর এই অযৌক্তিক রাষ্ট্রদর্শন আরোপ করেই মুসলিম উম্মাহর চরম ক্ষতিসাধন করে। (এর পেছনে যেমন ছিল বৃটিশদের কূটচাল সঙ্গে ছিল পাঞ্জাবী পুজিপতি ইস্পাহানী দাউদ ও আদমজির মত ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। ভারতে যেমন ছিল বিড়লা ও অন্যান্য শিল্পপতির স্বার্থ রক্ষার চিন্তা।) আর এভাবে ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত (পরবর্তীতে তৃখন্ডিত) হয়ে যায়। যার ক্ষুদ্রতম অংশের ওপর অধিকার করে আছে হতশ্রী বাঙালি মুসলমান।
আজ এতদিন পরও পাকি সেই চিন্তা চেতনা আমাদের চির সবুজ বঙ্গে ঘাটি গাড়ার স্বপ্ন দেখে। বাঙলার বুক জুড়ে একে বেকে বয়ে যাওয়া সুদীর্ঘ পদ্মা মেঘনার সচ্ছ জলে পাকিস্তানী চেতনার বিষ মেশানোর অলীক কল্পনায় এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছে একটা উন্মাদ গোষ্ঠি। খোদার কসম তা কোন দিন হবার নয়। যতদিন পদ্মা যমুনা মধুমতি সুরমায় এক ফোটা জলও আছে এবং যতদিন সবুজ বনানীর ফাক দিয়ে প্রভাত সূর্যের রশ্মি ঘুম থেকে জেগে ওঠা বালক বালিকার আদুরে পবিত্র গাল রাঙিয়ে দিবে।
অন্নদাশঙ্করের কাব্যাংশ দিয়েই আজকের আলোচনার ইতি টানছি-
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা?
আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ফোরামের আলোচনাসভায় পঠিত প্রবন্ধ।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ, ঢাকা