- আশরাফ উদ্দীন রায়হান
আমাদের আবাসিক হলগুলোর প্রতিটি রুমে বৈদ্যুতিক হিটারের চুলা থাকায় যে কোনো সময় যে কোনো কিছুই রান্না করে খেতে পারি আমরা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্তার অসুবিধার ফর্দে এই এক উল্লেখযোগ্য সুবিধা। পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজকর্ম করার পরে রান্না করাটা রীতিমতো অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার। তবু আমাদের মধ্যে ভোজনবিলাসী অনেকেই রান্না করে খায়। আর নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ার ভেতরে ভালোলাগার একটা ব্যাপার তো আছেই বৈকি।
আমাদের চারজন রুমম্যাটের রুমেও কালেভদ্রে রান্না হয়। একদা আমিও নিয়মিত-অনিয়মিত রান্না করতাম। তবে একদম নিয়ম করে রান্না করে খেতে পারাটা আর যার দ্বারাই হোক আমার দ্বারা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবুও চারজনের মধ্যে সবচে বেশি রান্না করে খাওয়ার খ্যাতি আমারই ছিল। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর থেকেই দৃশ্যত আমি রান্নাবান্না থেকে বেশ দূরে সরে এসেছি। মজার ব্যাপার হলো আমাদের চারজনের মধ্যে রান্না করা নিয়ে যাঁর সবচে বেশি উন্নাসিকতা ছিল সেই নাঈম ভাই এখন সকাল-বিকাল রান্না করে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
বেচারার দাঁতে অস্ত্রোপচার হয়েছে নাগাদ বাহিরের খাবার খাওয়া ডাক্তারি নিষেধ। একে তো তাঁর শক্ত খাদ্য গ্রহণ একেবারেই মানা তদুপরি ভাতটাও তাঁকে একদম নরম করে পাঁকিয়ে খেতে হয়। রান্নাবান্নায় অনভ্যস্ত ও চুলার ত্রিসীমানা থেকে হরহামেশা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে প্রয়াসী আমার এই রুমম্যাট এখন পাক্কা রাঁধুনী হবার পথে…! এর অবশ্য বহুমুখী লাভও আমরা বাকি তিন রুমম্যাট পাচ্ছি। সময়ে সময়ে দুধসেমাই আর নুডলসের অনাহূত মেহমান হয়ে চলেছি নাঈম ভাইয়ের ঔদার্য, ত্যাগ আর বদান্যতার কল্যাণে।
এই মাসের মাঝামাঝি গ্রামের বাড়ি থেকে যেদিন সকালে চলে আসি সেদিন লাউয়ের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছিলাম। তরকারিটা দারুণ সুস্বাদু হয়েছিল। লাউ বরাবরই আমার পছন্দের সবজি। আর লাউয়ের তরকারি আমার মুখে ভীষণ রুচিকর। ক্যাম্পাসে এসে মনে হলো সেদিন বাড়িতে লাউয়ের তরকারিটা ভালো মতো খাওয়া হয়নি। তাই ভাবছিলাম কচি দেখে একটা লাউ এনে মাছ দিয়ে রান্না করার কথা। আর লাউয়ের বাকল চিকন ফালি ফালি করে ভাজি হলে তো আর কোনো কথাই নেই। গত রাতেই আমার এই ইচ্ছার কথা অগ্রজতুল্য তিন রুমম্যাট সাইফুল ভাই, নাজমুল ভাই এবং উপর্যুক্ত নাঈম ভাইয়ের কাছে শেয়ার করি। তাঁরা সোৎসাহে আমার এই লাউ রান্নার উদ্যোগে একাত্ম হয়ে যান। ডিসিশন ফাইনাল!
এবার লাউ, মাছ ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা থেকে রান্না করা পর্যন্ত দায়িত্বও ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার ওপরে এসে পড়েছে। সকালে বাজার করতে হবে আবার সকাল আটটা পাঁচ মিনিট থেকে ক্লাস শুরু। ফজরের নামাজান্তে কেক আর ধোঁয়া-ওঠা এক কাপ কফি খেয়ে নিলাম। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই কেনাকাটা করে ফেলা যাবে—এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য নিয়েই বিনোদপুর বাজারে গেলাম সাইকেল হাঁকিয়ে। কিন্তু বিধি বাম! বাধ্য হয়ে আরও সামনে মির্জাপুর বৌবাজারে গিয়েও দেখি তথৈবচ! এ অবস্থায় ঘড়ির কাঁটার দিকে আমার সতর্ক নজরদারি চলছে।
যেখানে বাজার করতে এসেছি এখান থেকে আমার হলে সাইকেলের দূরত্ব মিনিট আটেকের মতো। অবশিষ্ট সময়, সবজি বিক্রেতাদের কাছে জুৎসই লাউ না থাকা, মাছ বিক্রেতার দেখা না পাওয়া আর ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার ত্রস্ততা আমাকে দিগভ্রান্ত করে ফেলার জোগাড়! সদাই কিনতে গেলে ক্লাসে যেতে দেরি হবে আর ক্লাসে চলে গেলে আজকের জন্য লাউ নিয়ে সব পরিকল্পনা অধরা থেকে যাবে—শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। এর মধ্যেই তড়িঘড়ি করে তেল আর তেজপাতা কিনে নিলাম। বৌবাজারে আর কালক্ষেপণ না করে ফের ছুটে আসি বিনোদপুর বাজারে। এবার এই বাজারটা জমে ওঠেছে মনে হলো। আগের তুলনায় ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি চোখে পড়ল দূর থেকেই।
ঊর্ধ্বশ্বাসে বিনোদপুর বাজারে এসে হাজির হলাম। হন্তদন্ত হয়ে তিনটি দোকানের লাউ বেছে দেখে পছন্দ করতে পারিনি। কচি আবাত্তি লাউ চেনার মোক্ষম উপায় সাইফুল ভাই আমাকে বলে দিয়েছিলেন—লাউটা হাতে নিয়ে এর নিম্নদেশের ফুলটা বরাবর হালকা করে নখ দেওয়া মাত্রই যদি ধেবে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটা কচি ও বিচিমুক্ত লাউ। আমি সেই কায়দা প্রয়োগ করে এর অব্যবহিত পরেই পঞ্চান্ন টাকা দিয়ে দুটি লাউ কিনতে সক্ষম হই। এখন মাছ কিনতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাতটা পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে! ক্লাস ধরতে না পারার আশঙ্কায় তখন আমার নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম।
সবজি এরিয়া পার হয়ে মৎস্য জোনে পা রেখেছি। সাইফুল ভাইয়ের প্রস্তাব করা এবং নাঈম ভাইয়ের পথ্য পাঙ্গাশ মাছ কিনতে হবে। দাম জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা জানিয়ে দিলেন এক শ চল্লিশ টাকা কেজি দর। এখানে অবশ্য পাঙ্গাশের সাথে অন্যান্য মাছও আছে। আমাদের এক কেজি ওজনের একটা মাছ হলেই যথেষ্ট। আমি দাম কমানোর ব্যর্থ গস্তিদারি করে একটা মাছ ওজন করতে বলি। আমি যেখানে এক কেজি ওজনের একটা মাছ কেনার খরিদ্দার সেখানে দশ-বারো-ষোলো কেজি মাছ নিচ্ছে একেকজন। আর এসব মাছ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা মেসগুলোতে রান্নার জন্য।
আমি কয়েকবার অনুচ্চ আওয়াজে ‘আমার জন্য এই মাছটা ওজন দেন’ বলতে বলতেই ‘দশ-বারো-ষোলো কেজি মাছ ক্রেতাদেরকে’ মাছ ওজন করে দিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতা। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অসহায়ভাবে করুণনেত্রে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই বিক্রেতার কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম। তিনি আমাকে এক কেজি ওজনের একটা মাছ মেপে দিলেন তাঁর পাশে বসে দ্রুতবেগে মাছ কুটতে-থাকা কিশোর ছেলেটার কাছে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে উপনীত হয়েছে। আমি ‘ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়’ সিআরকে ফোন দিলাম। ও জানালো ক্লাস হবে এবং ও-ও ক্লাসের কাছেই চলে গেছে!
আটটা দশ বেজে গেছে। আমার মাছটা মাছ কুটতে-থাকা ছেলেটাকে ঘেঁষে পড়ে আছে। বিশ-পঁচিশটা মাছের আঁশ পরিষ্কার করে আবার লহমায় একেকটা মাছকে টুকরো টুকরো করে প্যাকেট করে ফেলছে ছেলেটা। আমি ওর এই তীব্র গতিসম্পন্ন মৎস্যকর্তনকাণ্ড দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ‘আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে আমাকে একটু আগে দিয়ে দাও’ বলেও সাড়া পেলাম না। তখন রাগে আমার মেজাজটা ভারী তিরিক্ষি হয়ে ওঠছিল। তবুও আমি নির্বিকার দার্ঢ্যতায় আমার মাছটা কেটে দেওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আমার মাছটা কাটা হলো।
আমি এবার সাইকেল চালিয়ে আনাজ-তরকারির ভারী ব্যাগ সাথে করে রবীন্দ্র ভবন ও সিরাজী ভবনের মধ্যস্থিত যানবাহন রাখার গ্যারেজে ঢুকলাম। প্রতিদিন ক্লাসে ঢোকার সময় এখানেই সাইকেল রাখি। সাইকেল রক্ষণাবেক্ষকের কাছে ব্যাগটাও বুঝিয়ে রেখে দিলাম। ক্লাসে ঢুকতে দেরি হয়ে যাওয়ার অপরাধবোধ নিয়ে কলম-খাতাপত্রবিহীন ভোঁ দৌড় দিলাম রবীন্দ্র ভবনের তৃতীয় ব্লকের তিন তলার তিন শ একাত্তর নম্বর রুমের দিকে। বুকে ধুক্পুকানি শুরু হয়ে গেছে। ক্লাসের সামনে পৌঁছে দেখি মেম এখনো আসেননি।
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গেছি। মেম আসার আগেই দু তলার সেমিনার থেকে পানি খাওয়ার জন্য তড়িদ্বেগে ছুটলাম। তিন তলা আর দু তলার মাঝখানে মেম আর আমি মুখোমুখি! আমি মেমকে সালাম দিয়ে ঘুরে ফিরে চলে আসলাম ক্লাসে। এক সতীর্থ বন্ধুকে পানি এনে দিতে বললে ও আরেকজনের কাছ থেকে একটা বোতল এনে দিল আমাকে। আমি তিন ঢোক পানি গিলামাত্রই মেম ক্লাসে হাজির। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে ঢোকার জন্য মেম যখন দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘আমি স্যরি যে, আজকে তোমাদের ক্লাসে আসতে আমার একটু লেইট হয়ে গেছ।’ মেমের এই খেদোক্তি নিয়ে পাশে বসা বন্ধুবর নাজিম শ্লেষমাখা কণ্ঠে আমার কানে কানে বলে, ‘মেম, আমরা আপনার দেরিতে আসার জন্য দুঃখিত নই; বরং খুশি। অনেক খুশি, মেম।’
নাজিমের সত্যবচন আর আমার নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার আগাগোড়া ভাবতে ভাবতে তখন আমি গোপনীয় হাসা হাসি।
- লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী