সিলেটে মাদানীয়্যাতের প্রভাব: অতীত ও বর্তমান

সিলেটে মাদানীয়্যাতের প্রভাব: অতীত ও বর্তমান

  • মুফতি ইয়াহইয়া শহীদ

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পরেও সিলেট ছিলো ভারতেরই  রাজ্য আসামের অংশ। পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে সিলেটবাসী ‘বাই চয়েজ’ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। সিলেট নানাকারণে ঐতিহাসিক। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালাল রহ. তাঁর ৩৬০ শিষ্য নিয়ে সিলেট আগমন করলে তাঁর মাধ্যমেই সিলেটে ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। মূলত বাংলাদেশে ইসলামের  প্রচার- প্রসার সিলেট থেকে শুরু হওয়ায় সিলেটকে আধ্যাত্মিক নগরীও বলা হয়।

সিলেটের মানুষ তুলনামূলক ধর্মভীরু। নামাজ-কালাম, ইসলামী কালচারের দিক থেকে সিলেট বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এগিয়ে। এখানকার মানুষ আলেম-উলামাপ্রিয়। তুলনামূলক আলেম-উলামার সংখ্যাও সিলেটে বেশি। মকতব, মাদরাসার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গ্রামের মসজিদে সকালের মকতবে বাচ্চাদের ইসলামি শিক্ষাদান সিলেটের ঐতিহ্য। বাচ্চারা ধর্মীয় জ্ঞান মূলত গ্রামের মসজিদ থেকেই গ্রহণ করে৷ শীতকালে গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে আলেমদের কাছ থেকে ওয়াজ-নসিহত শোনার প্রচলন সিলেটে বহু পুরানো।

সিলেটের মানুষের এই আমূল-পরিবর্তনের পেছনে হজরত শাহজালাল রহ. এর পরে সবচেয়ে বেশি অবদান বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক, আওলাদে রাসূল, শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এবং তাঁর খান্দানের। সিলেটের মানুষ তাঁর এবং তাঁর খান্দানের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত।

হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. সর্বপ্রথম সিলেট আসেন ১৯২৪ সালে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র ছিলেন তিনি। বৃটিশরা তাকে এক পর্যায়ে আহমদাবাদ জেলে বন্দী করে রাখে৷ জেলে যাওয়ার আগে তিনি কলকাতা কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। জেল যাওয়ার কারণে কলকাতা কওমি মাদরাসার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তখনো তাঁর আলাদা কোনো আবাসস্থল ছিল না। দুইবছর টানা জেলে থাকায় প্রচুর ঋণী হয়ে পড়েন। ঋণ পরিশোধ করা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করা তখন তাঁর জন্য জরুরী হয়ে পড়ে।

সরকারি-বেসরকারি অনেক চাকরির প্রস্তাব তাঁর কাছে আসে; কিন্তু এসব চাকরির জন্য শর্ত ছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। তিনি যেহেতু শাইখুল হিন্দের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন; তাই আন্দোলন থেকে বিরত থাকার শর্তে কোনো বড় চাকরি নিতেও রাজি ছিলেন না। সকল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। মিশরের আল আজহার, বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও লক্ষ টাকা বেতনের প্রস্তাব আসে; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।

মিশরের আল আজহার, বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও লক্ষ টাকা বেতনের প্রস্তাব আসে; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি

সিলেট যদিও শাহজালাল রহ. এর দাওয়াতের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল; কিন্তু সে অনুযায়ী ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল না। উচ্চতর ইসলামি শিক্ষার জন্য সিলেটের ছাত্রদেরকে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হত৷ এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে সিলেটে বড়বড় আলেম ও আরবী ভাষাবিদ তৈরী হলেও দেওবন্দ ও সাহারানপুরে হাদিসের দরসকে কেন্দ্র করে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার যে সুন্দর পরিবেশ হয়েছিলো, সিলেটে তেমনটি হচ্ছিল না। তাই সিলেটবাসী ইসলামি শিক্ষার ঐ সুন্দর পরিবেশ তৈরী করার জন্য তখন হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. কে সিলেট আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সিলেটের অনেকের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আগেই তৈরী হয়েছিল। তারা কলকাতায় তাঁর সাথে দেখা করার জন্য প্রায়ই আসাযাওয়া করতেন৷ তারা তাঁর ব্যক্তিত্ব হাদিসের উপর তাঁর পারদর্শীতা এবং মসজিদে নববীর মতো পবিত্র স্থানে দীর্ঘ ১৩ বছরের হাদিসের দরস দেওয়ার কথা জেনে তাঁর মাধ্যমেই সিলেটে হাদিসচর্চার সূচনা করার প্রতি উৎসাহী হন।

সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে কলকাতায় যে চিঠি তাকে লেখা হয়েছিলো তখন, সে চিঠিতে তারা লিখেছিলেন— সুবা আসাম ও বঙ্গদেশে প্রায় ৩ কোটি মুসলমানের বসবাস; কিন্তু এখানে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই নিম্নমানের। ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ দুর্বলতা আছে৷ বিশেষত ইলমে হাদিসের শিক্ষা খুবই দুর্বল। তাই আপনাকে এখানে এসে একবার অবস্থান করা এবং অন্তত সিহাহ সিত্তার পাঠদান করে যাওয়া জরুরী। তাহলে আমরা এ সূত্রে হাদিসের পাঠদান চালু করে নিব।

এরকম প্রস্তাব অনেক মাদরাসা থেকে আসে; কিন্তু তিনি সিলেটবাসীর আন্তরিকতা এবং তাদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিবেচনা করে ইস্তেখারার পর দুই বছরের জন্য সিলেট আসতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হযরত মাদানী রহ. সিলেটে আগমন করেন এবং সিলেট শহরের মানিকপীরের টিলা মহল্লায় নয়াসড়ক মসজিদের নিকট অবস্থিত খেলাফত বিল্ডিং এ হাদিসের পাঠদান শুরু করেন। বর্তমানে নয়াসড়কের সেই মসজিদ সংলগ্ন পয়েন্টকে তাঁরই নামে ‘মাদানী চত্তর’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। সেখানে তিনি কেবল হাদিস শাস্ত্র নয়; হাদিসের পাশাপাশি তাফসির, ফিকহও পাঠদান করেন। দৈনিক পাঁচঘণ্টা পাঠদান করে কিছু সময় লেখালেখি এবং ব্যাক্তিগত অধ্যয়নের জন্য রেখে দিতেন। বাকী সময় প্রত্যন্ত এলাকায় দাওয়াত ও হেদায়েতের কাজে বেড়িয়ে পড়তেন।

সিলেটের প্রাকৃতিক অবস্থা তখন আজকের মতো ছিল না। শহরের প্রাণকেন্দ্রেও খাল-বিল, ডোবা জালের মতো বিছিয়ে ছিল। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি দিনের বেলা হাদিসের দরস শেষ করে স্থানীয় কোনো ছাত্রকে সাথে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেরিয়ে পড়তেন। সবজায়গায় যে সভা-সমাবেশ, বা মাহফিলের ব্যবস্থা থাকত, এরকম না; অনেকবার এমনও হয়েছে সন্ধ্যা থেকে পায়ে হেঁটে গভীর রাতে নির্ধারিত বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেছে উপস্থিত শ্রোতা ১৫/২০ জনের বেশি নয়। বিচ্ছিন্ন বাড়ি, চতুর্দিকে পানি আর ধানক্ষেত থাকায় অন্যান্য বাড়ি থেকে আর শ্রোতা আসার সম্ভাবনাও নেই; এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মজলিসেও তিনি পূর্ণ আবেগ এবং গুরুত্বের সাথে ওয়াজ করতেন। মানুষ কম বেশ হওয়ায় তার ওয়াজে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হত না। বেশি মানুষের সমাবেশে যেরকম গুরুত্বের সাথে ওয়াজ করতেন, কম মানুষের উপস্থিতিতেও একইরকম গুরুত্বের সাথে ওয়াজ করতেন।

বেশি মানুষের সমাবেশে যেরকম গুরুত্বের সাথে ওয়াজ করতেন, কম মানুষের উপস্থিতিতেও একইরকম গুরুত্বের সাথে ওয়াজ করতেন

এই রুটিন প্রায় প্রতিদিনই মেনে চলতেন। দিনের বেলায় দারস দিয়ে রাতের বেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। ওয়াজ শেষ হতে রাত ৯-১০ টা বেজে যেত; কিন্তু কোথাও রাত্রিযাপন করতেন না। পরের দিন হাদিসের দরস যেন বিঘ্নিত না হয়, সেজন্য রাতেই দূর্গম পথ অতিক্রম করে আবার খেলাফত বিল্ডিং এ পৌঁছতেন। দীর্ঘ তিন বছর তার এই কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।

সিলেটে শাইখুল ইসলামের এমন সাধনার ফলে হাদিস চর্চার সুন্দর পরিবেশ গড়ে ওঠে। তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে অসংখ্য মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। নয়াসড়ক মসজিদ ছিল তাঁর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের স্থান। সেখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত থেকে শুরু করে আলেম উলামারা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে মুরিদ হওয়া শুরু করলেন। প্রত্যেক রমজানে নয়াসড়ক মসজিদেই তাঁর মুরিদ ও ছাত্রদের নিয়ে এতেকাফ করতেন। তাঁর তাসাউফের খেদমাত যদিও মদিনা শরিফ থেকে শুরু হয়েছিল; কিন্তু সিলেটে সেটা বেশি সে কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন। সিলেটে তাঁর মুরিদ ও খলিফার দিকে তাকালে সহজেই বিষয়টি অনুধাবন করা যায়।

৩ বছর পর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে তার প্রস্তাব আসলে তিনি সেখানে ফিরে যান। সিলেটবাসী তাঁকে ছাড়তে কোনো অবস্থাতেই রাজি হচ্ছিল না; তিনি তাদেরকে এই আশ্বাস দেন যে, প্রত্যেক রমজানে তিনি সিলেটেই ইতিকাফ করবেন। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করেছেন। প্রত্যেক রমজানে তিনি সিলেট নয়াসড়ক মসজিদে এতেকাফ করতেন। তাঁর মুরিদ শুভাকাঙ্ক্ষীরা বছরে অন্তত একমাস তাঁকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হত।

হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর ইন্তেকালের পরেও সিলেটের প্রতি মাদানী খান্দানের আন্তরিকতা একটুও কমেনি। তাঁর প্রজন্ম সিলেটবাসীর প্রতি তাঁর মতোই আন্তরিক। সায়্যিদ আসআদ মাদানী, সায়্যিদ আরশাদ মাদানী,  সায়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানীসহ তাঁর খান্দানের সকলেই সিলেটবাসীর প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করে আসছেন। এখনো সিলেটের ওয়াজ মাহফিলে মাদানী পরিবারের কেউ উপস্থিত না থাকলে তা যেনো পূর্ণতা পায় না। মাদানী রহ. এর দৌহিত্র মাওলানা মাহমুদ মাদানী দা. সিলেটের নয়া সড়ক মসজিদে প্রায়শই ই’তিকাফ করেন। ইদানীং জমিয়তের ব্যতিব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায়  নিয়মিত রমজানে তিনি অবস্থান না করলেও বছরে দু’চার বার ঘুরে যান দাদাজানের পদধূলিধন্য এই পুন্য নগরীতে।

মাদানী রহ. এর দৌহিত্র মাওলানা মাহমুদ মাদানী দা. সিলেটের নয়া সড়ক মসজিদে প্রায়শই ই’তিকাফ করেন। ইদানীং জমিয়তের ব্যতিব্যস্ততা বেশি থাকায়  নিয়মিত রমজানে তিনি অবস্থান না করলেও বছরে দু’চার বার ঘুরে যান দাদাজানের পদধূলিধন্য এই পুন্য নগরীতে

তবে আক্ষেপের সাথে বলতে হয়, বর্তমান সিলেটবাসী বিশেষ করে আলেম-উলামাদের একটি মহল মাদানীয়্যাতকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অঅনাকাঙ্খিত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। হযরত মাদানী রহ. এর খান্দানদেরকে নিয়ে  বিভক্তি তৈরী করছেন। তরুণ আলেমদেরকে দেখা যাচ্ছে মুরব্বি মাদানীভক্তদেরকে অমান্য করতে, তাদের সাথে কোনো পরামর্শ না করেই  আগ বাড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে বেইনতিজামী সৃষ্টি করছেন। মুরব্বিদের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো, মাওলানা আরশাদ মাদানী ও মাওলানা মাহমুদ মাদানী দা. বায়আত করবেন, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সবাই এখন বাইয়াত শুরু করছেন।  আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাদানী দুটি ধারার একটি সিলেটে মাদানী খানকা নিয়ে সরব হলেও আরেকটি ধারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এসব মতভিন্নতা মাদানী খান্দানের পুন্যময়তা নষ্ট করবে। সিলেটের আলেম-উলামাদের এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত।

মাদানী  দুটি ধারার একটি সিলেটে মাদানী খানকা নিয়ে সরব হলেও আরেকটি দল নীরব ভূমিকা পালন করছেন

আল্লাহ শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এবং তাঁর পরিবারকে আল্লাহ তাআলা উত্তম প্রতিদান দান করুন। সিলেটবাসীর উপর তাঁর পরিবারের আন্তরিকতা আরো বৃদ্ধি করুন। আমীন।

লেখক, শিক্ষক ও বিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *