সুখস্মৃতির ঝাঁপি

সুখস্মৃতির ঝাঁপি

  • আশরাফ উদ্দীন রায়হান

সকালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় গিয়ে সেখান থেকে আবার রাতেই ক্যাম্পাসে ফেরা মোটেও চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চাইলে কী না হয়। চুলায় চাপানো পাতিলে ধাওয়া জ্বালে উতলানো দুধের মতো উগড়ানো অশান্ত মনটাকে—বড় মেহনত করেই নিয়ে আসলাম স্টেশন থেকে প্যারিস রোড পর্যন্ত। চারজন সফরসঙ্গীকে রেখেই রীতিমতো চলন্ত অটো থেকে এক লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে ড্রাইভারকে বলি, ‘আমীর আলী হলে যাবো। খুব দ্রুত চলেন।’ আল্লাহ তাআলা অনুজতুল্য জাহিদ এবং সতীর্থ হাসান মাহমুদকে উত্তম যাজা দান করুন। এই দুজন আমাকে আপডেট তথ্য জানানোর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছে।

ডা. শামসুল আরেফীনের ইশকে পড়েছিলাম ক্যাম্পাস-লাইফের ঊষালগ্নেই। আপাদমস্তক চিকিৎসক একজন মানুষ কী করে পুরোদস্তুর লেখক বনে যান তা ভাবতে গেলে বিস্ময়ের পারদ কেবলই ঊর্ধ্বগামী হয়। তাঁর বিরচিত বইগুলো নিছক ক্ল্যাসিক সাহিত্যের নতুন দিগন্তের উন্মোচনই করে না; বরং আকর্ষণীয় যুক্তিপূর্ণ হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় শব্দগাঁথার অনবদ্য সংযোজন হয়ে অযুত মানুষের দ্বারা সমাদৃতও হয়ে চলেছে সমরৈখিক প্রবণতায়।

পাগড়ি-জোব্বার আটপৌরে পোশাকেও তিনি দেখতে কী শানদার-শওকতপূর্ণ। তার চেয়েও সুন্দর তাঁর কৌতূহলোদ্দীপক বাচনভঙ্গি। এর চেয়েও সুন্দর তাঁর লেখা। তাঁর প্রতিটি বই পড়েই আমি আশ্চর্য-অসীম মুগ্ধতায় মোহগ্রস্ত হয়েছি বারবার। আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট একটা ঘোর আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে রেখেছে অনেক দিন।

ঊর্ধ্বশ্বাসে হন্তদন্ত হয়ে আমীর আলী হলে ঢুকতেই নিচতলার ১১১ নম্বর রুমের দিকে নজর গেল। দেখি বারান্দায় একটা জটলা। মাদরাসার ছাত্রদের মতো পাঞ্জাবি-টুপি পরা অনেকেই ভিড় জমিয়ে রেখেছে। এবার আমি হাঁপ ছেড়ে নিশ্চিন্তে হাজির হলাম সবার মাঝে। সবাই ভীষণ ঔৎসুক্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে আলিমুজ্জামান ভাই, বন্ধুবর আব্দুর রহমান, সাইফুদ্দীন, আসাদ এবং ছোট ভাই আবু নাঈম সানন্দে আমাকে ইসতিকবাল করে নিল। তারা আমার বেচাইন অবস্থা বুঝতে সময় নিল না। খানিকক্ষণ ইনতিযারে থেকেই রুমে ঢুকি।

আমার দুচোখের দৃষ্টিজুড়ে উদ্ভাসিত হলেন ডা. শামসুল আরেফীন। তিনি বড় তশতরিতে কয়েকজনকে নিয়ে একসাথে খাবার খেয়ে কেবলই দস্তরখান ছেড়ে ওঠলেন। আমি সালাম দিয়ে পরিচয় দিতে উদ্যত হওয়ামাত্রই তিনি আমাকে সজোরে চেপে ধরে তাঁর বুকের সাথে আমার বুক মেলালেন, মুআনাকা করলেন। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় বনে যাই। হাজিরানে মজলিস অপলক নেত্রে অবলোকন করছিল সেই মনোলোভা দৃশ্য। যেন অযাচিতভাবে আমি হয়ে ওঠেছিলাম মধ্যমণির পরেরজন।

এ কী আশ্চর্য! তিনি কি আমার শত জনমের পরিচিত কেউ না কি যে আমাকে দেখেই তিনি এমনভাবে কাছে টেনে নিলেন! নাহ, তিনি এমন নন। তবে তার চেয়েও বেশি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য কেউ যখন নিজেকে বিলিয়ে দেন উম্মাহর মাঝে তখন তিনি এমন না হয়ে পারেন-ই না।

ডা. শামসুল আরেফীনকে আমরা ছেলেপেলেরা সবাই ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করি। আর তাঁকে আমরা মনে করি একদম সহোদর ভাইয়ের মতোই। তিনিও আমাদের সাথে একদম অগ্রজের মতোই ট্রিট করেন। তাঁর এবং আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক সম্ভবত এটাই। একজন মানুষের লেখা বই পড়ে, তাঁর কথা শুনে এবং তাঁর সম্পর্কে জেনে তাঁকে সন্দর্শনের যে আকুতি জন্মেছিল মনে—সেই আকুতির জোয়ারওঠা মাহেন্দ্রক্ষণেই তাঁর সাথে অবিস্মরণীয় সময় কাটিয়ে অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতায় লুটিয়ে পড়ি, যুল জালালী ওয়াল ইকরাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কুদরতী পদযুগলে।

  • ১৯ নভেম্বর ২০২২
  • লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *