সৃষ্টির অপার বিষ্ময়; ফেরেশতা: পর্ব-৫

সৃষ্টির অপার বিষ্ময়; ফেরেশতা: পর্ব-৫

  • মুফতি মাহতাব উদ্দীন নোমান

কথা বলছিলাম ফেরেশতাদের দায়িত্ব সম্পর্কে। গত পর্বে তাদের তিনটি দায়িত্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা, আল্লাহর হুকুমে মানুষকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও মানুষের সৎ-অসৎ সকল কাজকর্ম আমানতের লিপিবদ্ধ করা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সে ধারাবাহিকতায় আজ আমরা ফেরেশতাদের বাকি দায়িত্বগুলো সম্পর্কে জানবো।

চার. ফেরেশতাদের অন্য একটি দলের দায়িত্ব হলো, তারা মুসলমানদের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমায় অংশগ্রহণ করেন। আবু হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-  ইমাম غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ পড়লে তোমরা ‘আমীন’ বলো। কেননা, যার এ (আমীন) বলা ফেরেশতাদের (আমীন) বলার সাথে সাথে হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী, হাদিস ৪৪৭৫, মুসলিম, হাদিস ৪১০)  

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (সালাতে) ইমাম যখন سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলেন, তখন তোমরা বলবে اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক। আপনার জন্য সকল প্রশংসা) কেননা যার এ উক্তি ফিরিশ্তাগণের উক্তির অনুরূপ হবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী, হাদিস ৭৯৬, মুসলিম, হাদিস ৪০৯)

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জুমু‘আর দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে পূর্বে আগমণকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার পূর্বে সে আসে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে একটি মোটাতাজা উট কুরবানী করে। অতঃপর যে আসে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে একটি গাভী কুরবানী করে, অতঃপর মেষ কুরবানী করার ন্যায়। অতঃপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগী দানকারীর ন্যায়। অতঃপর আগমনকারী ব্যক্তি একটি ডিম দানকারীর ন্যায়। অতঃপর ইমাম যখন খুতবা দেওয়ার জন্য বের হন তখন মালাইকাহ তাঁদের খাতা বন্ধ করে দিয়ে মনোযোগ সহকারে খুৎবাহ শ্রবণ করতে থাকে। (বুখারি, হাদিস ৯২৯, মুসলি্‌ হাদিস ৮৫০)

পাঁচ. ফেরেশতাদের এক দলের দায়িত্ব হলো, তারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ভ্রমণ করে যিকিরের মজলিস গুলোতে অংশগ্রহণ করেন। যে ঘরে জিকির বা কোরআন তেলাওয়াত হয় সেই ঘরে তারা প্রবেশ করে ওই আমলের শরিক হন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

যখন কোন দল আল্লাহর কোন ঘরে একত্রিত হয়ে কোরআন পাকের তেলাওয়াত করে এবং কোরআন পর্যালোচনা করে, তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তা’আলার রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, রহমতের ফেরেশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের আলোচনা করেন। (মুসলিম হাদিস নং ২৬৯৯)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অবশ্যই আল্লাহর অতিরিক্তি কিছু ভ্রাম্যমান ফিরিশতা আছেন, যাঁরা যিকরের মজলিস খুঁজতে থাকেন। অতঃপর যখন কোন এমন মজলিস পেয়ে যান, যাতে আল্লাহর যিকর হয়, তখন তাঁরা সেখানে বসে যান। তাঁরা পরস্পরকে ডানা দিয়ে ঢেকে নেন। পরিশেষে তাঁদের ও নিচের আসমানের মধ্যবর্তী জায়গা পরিপূর্ণ ক’রে দেন। অতঃপর লোকেরা মজলিস ত্যাগ করলে তাঁরা আসমানে উঠেন। তখন আল্লাহ আযযা অজাল্ল অধিক জানা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এলে?’ তাঁরা বলেন, ‘আমরা পৃথিবী থেকে আপনার এমন কতকগুলি বান্দার নিকট থেকে এলাম, যারা আপনার তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ পড়ে এবং আপনার নিকট প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কী প্রার্থনা করে?’

তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আপনার জান্নাত প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে?’ তাঁরা বলেন, ‘না, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে?’ তাঁরা বলেন, ‘আপনার জাহান্নাম থেকে, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে?’ তাঁরা বলেন, ‘না।’ তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জাহান্নাম দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘আর তারা আপনার নিকট ক্ষমা চায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে ক্ষমা ক’রে দিলাম, তারা যা প্রার্থনা করে তা দান করলাম এবং যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তা থেকে আশ্রয় দিলাম।’ তাঁরা বলেন, ‘হে প্রতিপালক! ওদের মধ্যে অমুক পাপী বান্দা এমনি পার হতে গিয়ে তাদের সাথে বসে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাকেও ক্ষমা ক’রে দিলাম! কারণ তারা সেই সম্প্রদায়, তাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত হয় না।’

(বুখারি, হাদিস ৬৪০৮ / মুসলিম, হাদিস ২৬৮৯)  

ছয়. আল্লাহ তাআলা একদল ফেরেশতাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ করার জন্য নিযুক্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- নিশ্চয় আল্লাহ (ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের মধ্যে) নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দো‘আ করেন। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর উপর দরূদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।

আর কিছু ফেরেশতাকে উম্মতের দরূদ রাসুল পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য নিযুক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলার কতক ফেরেশতা এমনো রয়েছে, যারা পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ায়, তাঁরা আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেন । (সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১২২৭)

সাত. ফেরেশতাদের আরেক দলের দায়িত্ব হলো তারা মানুষের জন্য দোয়া করে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

‘তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দো‘আ করে, তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার জন্য; আর তিনি মুমিনদের প্রতি অতীব দয়ালু। (আহযাব- ৪৩)

ফেরেশতাগণ মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করেন- উপর থেকে আসমান ফেটে পড়ার উপক্রম হয়; আর ফেরেশতারা তাদের রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করে এবং পৃথিবীতে যারা আছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; জেনে রেখ, আল্লাহ, তিনি তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (শূরা-৫)

বিশেষ করে মুমিনদের জন্য আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

‘যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে যে, ‘হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যপ্ত করে রয়েছেন। অতএব যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন’।

‘হে আমাদের রব, আর আপনি তাদেরকে স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন। আর তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নি ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়।’

‘আর আপনি তাদের অপরাধের আযাব হতে রক্ষা করুন এবং সেদিন আপনি যাকে অপরাধের আযাব থেকে রক্ষা করবেন, অবশ্যই তাকে অনুগ্রহ করবেন। আর এটিই মহাসাফল্য।’ (মুমিন ৭-৯)

হাদীস দ্বারাও ফেরেশতাদের দোয়ার বিষয়টি প্রমাণিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ‏‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত সালাতরত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতাগণ এ বলে দুআ করতে থাকে, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন; হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করুন (এ দু’আ চলতে থাকবে) যতক্ষণ পর্যন্ত লোকটি সালাত ছেড়ে না দাঁড়াবে অথবা তার ওজু ভঙ্গ না হবে।’ বুখারী শরীফ- ৩২২৯

যে ব্যক্তি রাসূলের উপর দরুদ পাঠ করে, তার জন্যও ফেরেশতাগণ দোয়া করেন,

হযরত আমের বিন রাবীআ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

“যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে, ফেরেশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকেন যতক্ষণ সে দরূদ পাঠ করতে থাকে। অতএব বান্দা চাইলে তার দুআর পরিমাণ কমাতেও পারে বা বাড়াতেও পারে।” (মুসনাদে আহমাদ: ৩/৪৪৫, ইবনে মাজাহ: ৯০৭)

এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, দান, অনুপস্থিত মানুষদের জন্য দু‘আ ও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেলেও ফেরেশতাগণ তার জন্যে দোয়া করেন।

আট. ফেরেশতাগণ মুমিনের জন্য দুনিয়াতে করার পাশাপাশি কিয়ামতের দিন তারা মুমিনদের জন্য সুপারিশও করবেন এবং আল্লাহ তা’আলা তাদের সুপারিশ কবুল করবেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

‘তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না’। (সূরা আম্বিয়া: আয়াত-২৮)

আর আসমানসমূহে অনেক ফেরেশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট, তার ব্যাপারে অনুমতি দেয়ার পর। (নাজম ২৬)

(চলবে)

লেখক, মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক, আল জামি’আ দারুল উলুম মাদরাসা, হাড়িনাল, গাজীপুর। 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *