সেই নদী এবং বেলী ফুলের শুভ্রতা

সেই নদী এবং বেলী ফুলের শুভ্রতা

বেড়ানো । লাবীব আব্দুল্লাহ

সেই নদী এবং বেলী ফুলের শুভ্রতা

নদীর কিছু দূরে আমাদের বাড়ি৷ নদীতে আমি মাছ ধরি৷ সাঁতার কাটি৷ নতুন পানি এলে নদীতে নৌকা চলে৷ পাল তোলা নৌকা৷ নদীর ঘাট থেকে নৌকা চলে জামালপুরে৷ ইসলামপুরে৷ মেলান্দহে৷ বর্ষার সময় মাঝিদের হৈ হুল্লোড় নদীর ঘাটে৷ সকাল আটটা থেকে বারোটা নৌকা ছাড়ার সময়৷ কারণে অকারণে আমি নৌকার ছইয়ে ওঠি৷ দশ টাকা ভাড়া দিয়ে জামাপুর যাই৷ শহরটা দেখে আবার বিকেলে নদীর রূপ দেখে দেখে বাড়ি ফিরি৷ নদীতে ঝাঁপ দিই৷ নৌকা থেকে লাফ দিয়ে হারিয়ে যাই পানির গভীরে৷ দমবন্ধ করে অনুসন্ধানী চোখ রাখি মাছের খোঁজে। দেখা যায় কি না মাছ চলার দৃশ্য৷ সাঁতার দিয়ে চলে যাই গভীর জলে৷ ভাসি স্রোতে৷ দেখি ঢেউয়ের খেলা৷ নৃত্য৷ দেখি নদী পারাপার৷

নদীর তীরে চর৷ বাড়ি দেখে দূরের ছবি কামারের চর৷ নদীর ঘাট থেকে দেখা যায় ডিগ্রির চর৷ নদীর দক্ষিণে সাত নং চর৷ ইউনিয়নের নাম চর পুটিমারি৷ আমার গ্রামের নাম বেনুয়ার চর৷ জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়৷ আমি চান্নিপসর রাতে নৌকায় চলে যাই আম্মার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে৷ নদীতে রাত কাটাতে৷ আব্দুল করিম মামা আমার সাথী৷ মাহাবুর ভাই আমার মামাতো ভাই সাথী৷ নৌকার ছইয়ে কাঁথা বালিশ রেখে নদীতে বসে বসে চাঁদ তারার ঝিলমিল দেখি৷ আম্মা তালাশ করেন কিন্তু পর্দানশীন মহিলা তো ঘর থেকে বের হতে পারেন না৷ আব্বা ব্যবসার উদ্যেশ্যে বাইরে৷ অন্য শহরে৷

দুরন্ত শৈশবের সেইদিনগুলো স্মরণ হয় আজও৷ দুপুরে নদীতে সাঁতার পর্ব৷ বেলীর জন্য অপেক্ষা৷ বেলী কি প্রতিদিন আসবে? তাদের সঙ্গীরা ভিন্ন৷ ভিন্ন আমার খেলার সাথীরা৷ শাহাদুল, একাব্বর, সভা, সামিদুল, হাজিরা আমার শৈশবের সাথী৷ বিকেলে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলায় উম্মাতাল৷ গোল রক্ষক আমি৷ লাল সবুজসক্লাবের ফুটবল খেলায় আমিও খেলোয়াড়৷ রৌদ্রময় দুপুরে ডাক্তার বাড়ির গাবগাছের নীচে মাচাং-এ আড্ডা৷ অলস দুপর৷ এজাক ডাক্তার বাড়ির বাইরে বিশাল গাব গাছ৷ নিবিড় ছায়া৷

এই বৈঠকখানায় হালখাতার সময় জারি গানের শিল্পীরা ধুতি পড়ে উদারকণ্ঠে প্রথমে বন্দনা করি… আষার মাসে ভাসা পানি… বাড়ির ঘাটে বান্ধা নাও… জাতীয় গান৷ তিনদিনব্যাপী উৎসব৷ বাবড়ি চুলের বাউলরা এক তারায় উদাসী টান গানের খাঁচার ভেতর… …৷

আমাদের বাড়ির পেছনে সড়ক৷ বাড়ি ও নদীর মাঝে আর কোনো ঘর নেই৷ সরাসরি নদীর প্রতিবেশী৷ এটি আশির দশকের শুরুর কথা৷ যমুনা নদী থেকে বর্ষার সময় নতুন পানি আসে এই শাখা নদীতে৷ কৃষকরা গরুর পাল নিয়ে নদী পারি দিয়ে যায় চরে৷ আমি গরু দেখি৷ দেখি কৃষকের হাল চাষের লাঙ্গল জোয়াল৷ নদীর তীরে আমাদের ৬৪ শতাংশ জমিন আছে৷ চাষ করা হয় বাদাম বা মিষ্টি আলু৷ বর্ষ মৌসুম ছাড়া সাঁতার দিয়ে নদীর এপার থেকে ওপারে চলে যাই৷ নদীর কাছে ছন ক্ষেত৷ কাশবন৷ ছোট ছোট পাখির নীড়৷ আমি পাখি শিকারের নেশায় বা প্রজাপতি ধরার আশায় নদীর তীরে দৌড়াই৷ কাঁঠালের আঠা পাটের শুলাতে লাগিয়ে ধরি লাল, নীল প্রজাপতি৷ ধরি আবার ছেড়ে দেই৷ দেখি প্রজাপতির উড়ালকাব্য৷ মৎসশিকারী ঝালোদের খলইয়ে দেখি বোয়াল, আইর, বাউশ, টেংরা, গোলশা, বাগাইর, পুঁটি৷ টেপা মাছের মুখে ফঁ দিয়ে পেট বড় করে আছে৷ দেখি রঙের বউ মাছ৷

নদীর কাছে তিনটি শিমুল গাছ৷ শিমুলের রঙ কত সুন্দর!

আমি যে নদীর কথা বলছি সেই নদীর যৌবন আজ নেই৷ নেই সেইসব আনন্দের দিন৷ কোথায় সেই নদীর ঘাট? কোথায় নৌকার পাল? কোথায় সেই নদীমুখী মেঠো পথ? গেল কৈ সেই নানা প্রজাতির মাছ? কৃষকের সেই হাসি কোথায়? কোথায় হারিয়ে গেলো নদীর পারাপার?

সেই নদীর কাছে আমাদের ঈদগাহ৷ সেই তিন গ্রামের ঈদগাহর ঐতিহ্য নেই আজ৷ সেই ঈদগাহ চৌচির৷ আমার নানা ছিলেন সেই মাঠের খতীব৷ মৌলভী আশরাফ আলী রহ.৷ পরে আরেক মাওলানা৷ পরে আমার উস্তায মাওলানা নূর মুহাম্মদ রহ.৷ কেউ আজ নেই৷ গ্রামের সেই কাঁচা ঘর পাকা হয়েছে৷ মুরুব্বীরা ওপারে৷ যুবকরা বুড়ো হবার পথে৷ বিদ্যুৎহীন গ্রামে এখন আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন৷ মেঠো পথের ধুলি আর ওড়াওড়ি করে না আগের মতো৷ সেই বেলী এখন চার সন্তানের জননী৷ সেই শাহাদুল একাব্বর সংসারী৷ সেই নদীও নেই, নেই সেই প্রাণবন্ত দিন৷ স্ম়ৃতিতে ভাসে আমার প্রিয় গ্রাম৷ গ্রামের বেলী ফুলের গাছ৷ বাঁশঝাড়৷ গাবগাছ৷ আমগাছ৷ ঘুড়ি৷ বাজারে বাইস্কোপ৷ স্কুলে বিলাতি দুধ৷ জাম্বুরা ফল দিয়ে ফুটবল বানিয়ে লাথি দেওয়ার সেই দিন আজও মনে পড়ে৷

একদিন রাতের আঁধারে সে এবং আমি কথা বলেছিলাম সেই কথাও মনে পড়ে৷ সে কোথায়? কেমন আছে? আমি সেই আমি৷ শহরে থেকেও আমার মন নদীর ঘাটে৷ ঘ্রাণ পাই বেলী ফুলের৷ অনুভব করি সুবাশ৷ চোখে ভাসে বেলীর শুভ্রতা৷ শুদ্ধতা৷

লেখক : কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *