- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
দীর্ঘ একমাস ধরে অপেক্ষায় আছি। কবে আসবে ২৯ সেপ্টেম্বর। প্রিয় শায়েখ ও মুর্শিদের খেদমতে হাজির হবো। কেননা এ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার, মাসিক শবগুজারীর দিনটি ২৯ তারিখে পড়েছে। যে কারণে বারবার শুধু ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই। দিন গুণতে থাকি। কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। রাজধানী ঢাকার জামিআ ইকরাতে যাব। প্রিয় শায়েখ, ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ. এর খলীফা, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের সাথে সাক্ষাত হবে।
শায়েখের সাথে দেখা না হলে এখন আর ভাল লাগেনা। আগে অনেক লম্বা সময় পরে তাঁর সাথে দেখা করতাম। কিন্তু বর্তমানে এমন অবস্থা, মনে হয় প্রতি সপ্তাহে গিয়ে তাঁর সাথে মোলাকাত করি। তাঁর কাছে বসে থাকি। কিন্তু এদিকে সময়ের যেমন অভাব, আবার ওদিকে প্রিয় শায়েখও অনেকদিন যাবত অসুস্থ। বারবার সাক্ষাতে গেলে তাঁর কষ্ট হতে পারে বিধায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। তারপরেও মনের মধ্যে কেমন যেন অপূর্ণতা রয়ে যায়। আর এটা হল তাঁর প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। আপন শায়েখ ও মুর্শিদকে কাছে না পাওয়ার অপূর্ণতা, ব্যাথা-বেদনা। যেটা নিসবত বা সম্পর্কের কারণে হয়ে থাকে।
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. তাঁর শায়েখ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর সাথে সাক্ষাত করতে প্রতি সপ্তাহে যেতেন। কোনো সপ্তাহ বাদ দিতেন না। তিনি তখন সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুমে পড়াশোনা করছেন। সেটা ছিল ১৯২২ সনের কথা। সাহারনপুর থেকে থেকে থানাভবন এর দুরত্ব ছিল ৩৫ মাইল। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলবেলা শায়েখের সাথে দেখা করার মানসে পায়ে হাঁটা শুরু করতেন। সেখানে পৌছানোর পর সারারাত খানকাতে কাটাতেন। পরের দিন হযরত থানবী রহ. এর পিছনে জুমুআর নামাজ আদায় করে আবার সাহারানপুর পায়ে হেঁটে চলে আসতেন। এভাবে চার বছরে ২০৮ বার তিনি থানবী রহ. এর দরবারে গিয়েছিলেন।
হিসাব কষে দেখা যায়, পীরের সোহবত হাসিল করার জন্য চার বছরে ৭,২৮০ ( সাত হাজার দুইশত আশি) মাইল পায়ে হেঁটেছেন। বড় আজব ব্যাপার। এগুলো আমরা এখন কল্পনাও করতে পারিনা। কত মোজাহাদা, কত কোরবানী তাঁরা করেছেন।
এখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। সব জায়গাতে গাড়ি। পায়ে হাঁটার পথ নেই। তারপরেও আমরা আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যেতে চাইনা। নিজেরা মাহরুম থাকি। সবকিছু উন্নত হয়েছে, কিন্তু আমাদের আত্মার উন্নতি হয়নি। সেই ঘুণ লেগে আছে, কিন্তু পরিচ্ছন্ন করার মানসিকতা নেই। আমাদের বড়দের মধ্যে সবসময় এই মানসিকতা কাজ করত— আত্মার সংশোধন করতে হবে। কীভাবে ‘তাআল্লুক মাআল্লাহ’ পয়দা হবে —এমন ফিকির তাঁদের মাঝে কাজ করতো।
যেমন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর একটা কথা আছে, “তুমি দুনিয়ার সবকিছু পেয়েছো কিন্তু আল্লাহকে পাওনি, তাহলে তুমি কিছুই পাওনি।” অনেক মুল্যবান কথা। আমরা ধন-সম্পদ গাড়ি-বাড়ি সবকিছু পেয়েছি, কিন্তু আমাদের আত্মার শুদ্ধি হয়নি। আমাদের চরিত্র ঠিক হয়নি। তাহলে কিন্তু আমাদের কিছুই হয়নি।
আজকাল দেশের বিভিন্ন জায়গাতে ইসলাহী ইজতেমা হচ্ছে। দেশের খ্যাতনামা সব আলেমের খানকাতে মানুষের ইসলাহী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আমার শায়েখের খানকাতেও বসছে সেই মিলনমেলা। যেখানে দেশসেরা আলেমদেরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরপরেও কিন্তু আমাদের চরম গাফলতি। যথাসময়ে হাজিরী হয়না। পিছনে থাকা হয়। কিন্তু সত্যিকারার্থে কেউ যদি আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির সোহবতে বসে, তবে তাঁর আমূল পরিবর্তন এসে যায়।
প্রতিটি মানুষের জন্য ভাল পরিবেশ এবং ভাল মানুষের সংস্রব জরুরী। এগুলো ছাড়া মানুষের আত্মার সংশোধন হয়না। আর আত্মার সংশোধন ছাড়া মানুষ সফলকাম হতে পারেনা। আল্লাহ তাআলা কালামে পাকের মধ্যে ইরশাদ করেছেন—
‘ক্বদ আফলাহা মান তাঝাক্কা’
ঐ ব্যক্তি সফলকাম যে আত্মশুদ্ধি করে।
সুতরাং বন্ধুগণ, আমরা যে যাই করিনা কেন, মহান রবের কাছে ফিরে আসতে হবে। তাঁর সামনে মস্তক অবনত করতে হবে। আর এর জন্য জরুরী হলো, ভাল পরিবেশ, ভাল মানুষের সংস্রব। দুনিয়া থেকে ফারেগ হয়ে সোহবতে আহলুল্লাহ জরুরী। এর দ্বারা আত্মার উন্নতি ঘটবে। দূর হবে নিকষ কালো অন্ধকার।
আকাবিরে দেওবন্দের বৈশিষ্ট ছিল এটা, রিজাল তৈরী করা। শুধু নেসাবে তা‘লীমের মধ্যে তাঁরা আলেম এবং তালেবুল ইলমদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং দরস-তাদরিসের পাশাপাশি খানকাহী আমলের সাথে সকলকে জুড়ে দিয়েছেন। যেকারণে দেখা যায়, দারুল উলুম দেওবন্দে বুজুর্গদের খানকা বিদ্যমান। দেওবন্দ, সাহারানপুর, গঙ্গুহ, থানাভবন সবজায়গাতে সেই খানকাগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনো মাদানী খানকাতে ভক্তবৃন্দের কোলাহল দেখা যায়।
সোহবতে আহলুল্লাহ আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটায়। এজন্য এ মিশন অব্যহত রাখতে হবে। প্রিয় শায়েখ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ যে মিশন নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, সেটা যথার্থ। তাঁর এই সংগ্রাম-সাধনা সফল হোক। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট