স্বপ্নবাজের মহাপ্রয়াণ | সাখাওয়াত রাহাত
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
শৈশবে বাবা হারানো মানসুর সাহেবের শিক্ষাজীবনটা কষ্ট ও সংগ্ৰামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। তবুও অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে হিফজুল কুরআন ও দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষা সফলভাবেই তিনি সম্পন্ন করেন। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে নিজেই একটি ক্যাডেট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে খেদমত শুরু করেন।
খেদমতের পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসায়ও নিজেকে যাচাই করে তিনি সফল হন। ফলে ছোটবেলা থেকে লালন করা ‘উদ্যোক্তা’ হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করার প্রয়াস পান। খোলেন মানসুর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও মানসুর টেইলার্স।
ব্যবসায়িক সাফল্য যেন এ সময় তাঁর পদচুম্বন করতে শুরু করল! বিশেষ করে টেইলার্স ব্যবসা। ফলে ক্যাডেট মাদরাসা অন্য বন্ধুকে হস্তান্তর করে পুরোপুরি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। এরইমধ্যে খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিয়ের কাজটিও সেরে ফেলেন।
কুমিল্লা শহরে তিন রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে নব দম্পতির সাংসারিক জীবন শুরু হয়। বাসার কাছেই টেইলার্স এবং ছোটকরে একটা গার্মেন্ট চালু করেন। দারুণভাবে তাঁর ব্যবসার উন্নতি হতে থাকে।
ব্যবসার অগ্ৰগতি দেখে পরিচিত কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে মুদারাবা চুক্তিতে পুঁজি দিয়ে যুক্ত হয়। এভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা একসময় মাঝারি আকারের ব্যবসায় পরিণত হয়। পুঁজিদাতারাও সন্তোষজনক হারে মুনাফা পেতে থাকেন।
মানসুর সাহেবের হাতে যখন অঢেল টাকা তখন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘আবু রায়হান’ তাঁর কাছে দুই লাখ টাকা ধার চান। তিনি দিতে সম্মতি জানিয়ে বললেন: ঠিকাছে দেব; তবে টাকা দেওয়ার সময় দু’জন সাক্ষী উপস্থিত থাকবেন এবং স্টাম্প পেপারে তোমাকে স্বাক্ষর করতে হবে।
মানসুর সাহেবের এই দুই শর্ত শুনে বন্ধু বললেন: কী বলছ এসব? তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না? আমাদের এত বছরের বন্ধুত্ব!
মানসুর সাহেব বললেন: অবশ্যই করি বন্ধু! কিন্তু ইসলামী শরিয়াহ আইনানুযায়ী এমনটা করা আবশ্যক।
এ কথা শুনে বন্ধু ভীষণ রাগ করলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। তাই বন্ধুত্ব রক্ষার খাতিরে মানসুর সাহেব বললেন: আরে! আমি তো তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম! শেষমেষ সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়াই তিনি তাঁর বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়ে দিলেন।
এদিকে কাপড়ের একটা বড় চালান আনতে মানসুর সাহেব ঢাকায় গেলেন। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার পর থেকেই তাঁর মোবাইল বন্ধ! দু-তিনদিন তাঁর কোনো খবর নেই! বাসায় একলা থাকা দুশ্চিন্তগ্ৰস্থ স্ত্রী মানসুর সাহেবের এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে তাঁর খোঁজ নেওয়ার অনুরোধ জানান।
চার ঘণ্টা পর সেই বন্ধু তাঁর স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানান- মানসুর সাহেব হাসপাতালে! ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বের হওয়ার সময় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাত করে সব টাকা নিয়ে গেছে!
মানসুর সাহেব ব্যাংক থেকে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা ওঠিয়েছিলেন! সবগুলো টাকাই ছিনতাই হয়ে গেছে! তাই হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। রোরুদ্যমান স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে স্ত্রী বললেন- টাকা গেলে গেছে; আপনি তো ঠিক আছেন, এতেই আমি খুশি। বেঁচে থাকলে আবার টাকা হবে।
প্রায় তিন সপ্তাহ পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। কিন্তু ততদিনে তাঁর ব্যবসার অবস্থা যাচ্ছেতাই! এতগুলো টাকা হারিয়ে মানসিকভাবেও তিনি বিপর্যস্ত। ফলে ব্যবসার পরিধি আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে।
ওদিকে মুনাফার টাকা না পেয়ে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন ফেরত দিতে চাপ প্রয়োগ করে। মানসুর সাহেব যতটুকু সম্ভব তাদের টাকা ফেরত দেওয়াও শুরু করেন। কিন্তু এরপরও অনেক টাকা ফেরত দেওয়া বাকি থেকে যায়!
হঠাৎ মানসুর সাহেবের মনে পড়ে বন্ধু আবু রায়হানের কথা! টাকা ধার নেওয়ার দুই বছর চলে গেলেও যিনি মানসুর সাহেবের টাকা ফেরত দেননি। তিনি বড় আশা নিয়ে নিজের পাওনা টাকা আদায় করতে বন্ধুর বাসায় গেলেন।
কিন্তু মানসুর সাহেবকে দেখেই সেই বন্ধুর মুখ কালো হয়ে গেল! তিনি যখন টাকা চাইলেন তখন বন্ধু বললেন: কিসের টাকা? আমি তো কবেই তোমাকে টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছি!
এ কথা শুনে মানসুর সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন: বন্ধু মিথ্যা কথা বলছ কেন? তুমি তো আমাকে টাকাটা ফেরত দাওনি!
বন্ধু রাগত স্বরে বলে ওঠল: তোমার এতবড় সাহস! তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী বলছ? আর তুমি যে আমাকে টাকা দিয়েছিলে এর কোনো প্রমাণ আছে? কোনো সাক্ষী আছে? থাকলে উপস্থিত কর!
মানসুর সাহেব বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে এলেন। বিকেলে আরেক বন্ধুকে ঘটনাটি জানালেন। তখন সেই বন্ধু বলল: আমাকে বিশ হাজার টাকা দাও। এই টাকা দিয়ে সন্ত্রাসী ভাড়া করে তার কাছ থেকে তোমার টাকা উদ্ধার করে দেব!
গুন্ডা পাঠিয়ে টাকা আদায় করার প্রস্তাবটি মানসুর সাহেবের কাছে যুতসই মনে হল না। তিনি বরং পুলিশের সহায়তা নেওয়াকে উত্তম মনে করলেন।
পরদিন সকালে থানায় গিয়ে তিনি অভিযোগ করলেন: আমার বন্ধু দুই বছর আগে আমার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ধার নিয়েছিল। কিন্তু সে এখন পাওনা টাকা ফেরত দিতে চাচ্ছে না!
থানার ওসি সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনার দাবির পক্ষে কোনো সাক্ষী-প্রমাণ আছে? হতাশ কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন: না, নেই! বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করে আমি তাঁকে টাকাটা দিয়েছিলাম!
ওসি সাহেব আবার বললেন: ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে গেলে রসিদ দিতে হয়। আবার টাকা ওঠাতে গেলেও রসিদ দিতে হয়। ব্যাংকের যে কোনো লেনদেনে কেন রসিদ দেওয়া হয়? এটা এ কারণেই যে, লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। এখন হয় আপনি মিথ্যা বলছেন। না হয় সাক্ষী উপস্থিত করুন।
মানসুর সাহেব থানা থেকে বের হয়ে টাকার বিনিময়ে দু’জন মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করলেন। এরপর তাদেরকে নিয়ে আবার সেই ওসি সাহেবের কাছে গেলেন।
এবার সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে তদন্তের উদ্দেশ্যে তিনি লিখলেন- আবু রায়হান নামক ব্যাক্তি দুই বছর আগে মানসুর সাহেবের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ফেরত দিচ্ছেন না।
এরপর ওসি সাহেব ঋণগ্ৰহীতা সেই বন্ধুকে থানায় ডেকে পাঠালেন। ধুরন্ধর আবু রায়হান সাহেব ওসি সাহেবের হাতে ত্রিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন! এরপর উল্টা মানসুর সাহেবের বিরুদ্ধে সম্মানহানির অভিযোগ দায়ের করলেন!
মানসুর সাহেবের টাকা তো আগে থেকেই বন্ধুর কাছে আটকে ছিল। তার ওপর এখন সম্মানহানির অভিযোগ দায়ের হওয়ায় তিনি ওসি সাহেবের পরামর্শে বন্ধুর কাছে ক্ষমা চান। এবং লিখিত দেন- আবু রায়হান আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি! তখন সেই বন্ধু অট্টহাসি দিয়ে অভিযোগ ফেরত নিল।
বাসায় ফেরার পর স্ত্রী অন্য চিন্তা মাথায় দিতে লাগলেন। বাসার চাল-ডাল সব শেষ! দুই মাসের বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে! বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য মালিক এটাসেটা বলে গেছেন!
রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে পরদিন সকালে মানসুর সাহেব আবারো ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। কী আশ্চর্য! এবারো তাঁর মোবাইল বন্ধ! তাঁর স্ত্রী মানসুর সাহেবের একের পর এক বন্ধুকে ফোন করেও তাঁর কোনো হদিস পাচ্ছেন না! অন্যদিকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পাওনাদার এসে তাঁর স্ত্রীকে শাসিয়ে যায়!
পাওনাদারেরা মানসুর সাহেবের গ্ৰামের বাড়িতেও গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে- তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই! সে তার ভাগের জমিজমা বিক্রি করে এখান থেকে চিরতরে চলে গেছে!
স্বামীর প্রত্যাবর্তনের আশায় ছয়মাস কাটিয়ে দিয়েও যখন স্ত্রী তাঁর সামান্য খোঁজটুকুও পেলেন না; তখন অভিমান করে তিনি চলে গেলেন বাপের বাড়ি।
মানসুর সাহেব নিখোঁজ প্রায় দুই বছর! এরপর হঠাৎ একদিন তাঁর খুব কাছের দুয়েকজন মানুষ তাঁর খোঁজ পেলেন! তিনি উত্তরায় এক মাদরাসার হিফজ বিভাগে খেদমতে আছেন। তবে দুঃখজনক বিষয় হল- নানারকম দুশ্চিন্তার কারণে তাঁর মস্তিষ্কে পানি জমেছে! ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে মেজর অপারেশন করাতে হয়েছে!
দুই বছরের নিরুদ্দেশ জীবনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি তিনি। বরং মিয়ানমার ও নেপালে যোগাযোগ-যাতায়াত করে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম..!
এরপর নাড়ির টানে ঢাকা ছেড়ে তিনি চলে আসেন প্রাণের শহর কুমিল্লায়। স্মৃতিবিজড়িত এই শহরের বদরপুর মাদরাসায় হিফজ বিভাগের শিক্ষক হিসেবে খেদমত শুরু করেন।
বদরপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে কেটে গেছে তিনটি বছর। এই তিন বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি কাটিয়ে দিলেন মাদরাসায়! মাদরাসার বন্ধেও এখানেই থাকতেন। যাবেন কোথায়? তাঁর যে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! কার কাছে যাবেন? তাঁর যে থেকেও কেউ নেই!
চার-পাঁচ বছর যাবৎ স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়াছাড়ি হয়নি! গ্ৰামের বাড়িতে বড় ভাইয়েরা থেকেও নেই! আর মা তো আরো দশবছর আগেই মারা গেছেন!
করোনা ভাইরাসের কারণে অধ্যুষিত লকডাউনের শুরুতে পুরনো সমস্যাটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কুঁকড়ে ওঠেন মানসুর সাহেব। মনে হয় পুরো আকাশটাই বুঝি তাঁর মাথায় ভর দিয়েছে! অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি মাঝেমধ্যে সংজ্ঞা হারান! শেষে সহকর্মীদের পরামর্শে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আবার তিনি ঢাকামুখী হন।
প্রায় এক মাস মধ্যবাড্ডায় এক বন্ধুর বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ঠিকমতো চিকিৎসাও নিতে পারছিলেন না। বহু বিড়ম্বনার পর শ্যামলির এক প্রাইভেট হসপিটালে ডাক্তার রাজিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনিই প্রথমবার তাঁর অপারেশন করেছিলেন। এমআরআই ও আরো দুয়েকটি পরীক্ষার পর তাঁকে জানানো হয়- মস্তিস্কে আবার পানি জমেছে! অপারেশন করতে হবে!
তবে অপারেশনের আগ পর্যন্ত অসহনীয় ব্যাথা থেকে উপশমের জন্য ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দেন। এসব ওষুধ সেবন করার পাশাপাশি পরিচিত হোমিও ডাক্তার আসাদ সাহেবের কাছ থেকে তিনি হোমিও চিকিৎসাও নিতে শুরু করেন।
আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবহীন মানসুর সাহেব হঠাৎ করেই একদিন তাঁর হিফজ বিভাগের প্রিয় শিক্ষক হাফেজ আমানুল্লাহ সাহেবকে ফোন দেন। পুরো নিরুদ্দেশের সময়ও একমাত্র তাঁর সঙ্গেই মানসুর সাহেবের যোগাযোগ ছিল! কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি তাঁর উস্তাদের কাছে আকুতি জানান- হুজুর! আমি আপনার এতিম-অসহায় ছাত্র মানসুর! আমি মনে হয় আর বাঁচব না! যদি মন চায় তাহলে আমাকে শেষবারের মতো একটু দেখে যান!
কিন্তু তাঁর এই আকুতি পূরণ হওয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা মানসুর সাহেবকে তাঁর কাছে ডেকে নেন। ঘুমের মধ্যেই তিনি রফিকে আলার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। মহাপ্রয়াণ ঘটে আপাদমস্তক একজন স্বপ্নবাজ যুবকের। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
#প্রিয় পাঠক! এটাই দুনিয়া! আল্লাহ তায়ালা এখানে বসবাসের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন ঠিক করে দিয়েছেন। এসব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নিজের মনগড়া জীবনযাপন করলে আমাদের যে ক্ষতি হবে তার জন্য আমরাই দায়ী হব।
ঋণ-কর্য মানুষের তথা সমাজের একটি প্রয়োজনীয় লেনদেন। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে জীবন-যাপন করার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় ঋণ নেওয়ার কিংবা অন্যকে দেওয়ার সম্মুখীন হতে হয়।
বর্তমান যুগে কারো ওপর ভরসা করা, কাউকে বিশ্বাস করা খুবই দুরূহ ব্যাপার! তাই যে কোনো লেনদেন, ঋণ আদান-প্রদানে দলিল সম্পাদন ও সাক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি। যা আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ওহি নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন।
সাক্ষী ও দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে তারাই ভয় পায়; যাদের মনে ঘাপলা আছে এবং যারা অন্যায় করে! অথবা মানসুর সাহেবের মতো সহজ সরল মানুষকে ধোঁকা দিতে চায়!
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে; লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া। এবং ঋন গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে। অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দূর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়, তবে তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখাবে। দু’জন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্যে থেকে। যদি দুজন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন ডাকা হয়, তখন সাক্ষীদের অস্বীকার করা উচিত নয়। তোমরা এটা লিখতে অলসতা করোনা, তা ছোট হোক কিংবা বড়, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এ লিপিবদ্ধ করণ আল্লাহর কাছে সুবিচারকে অধিক কায়েম রাখে, সাক্ষ্যকে অধিক সুসংহত রাখে এবং তোমাদের সন্দেহে পতিত না হওয়ার পক্ষে অধিক উপযুক্ত’।[১]
লেনদেনে অস্বচ্ছতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘যেই ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার উপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সাথে মুয়ামালা সাফ করে নেয়; সেই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে (এবং পাওনাদারকে আদায় করা হবে।) আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার উপর জুলুম করেছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে’।[২]
আরেক হাদিসে এসেছে, ‘একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? তারা বললেন, যার অর্থ-সম্পদ নেই আমরা তো তাকেই নিঃস্ব মনে করি। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের ময়দানে নামায, রোযা, যাকাত(সহ অনেক নেক আমল) নিয়ে হাযির হবে; কিন্তু সে হয়ত কাউকে গালি দিয়েছে বা কারো উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে বা কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে বা কাউকে খুন করেছে অথবা কাউকে আঘাত করেছে। ফলে প্রত্যেককে তার হক অনুযায়ী এই ব্যক্তির নেক আমল থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদি কারও হক বাকি থেকে যায় আর এই ব্যক্তির নেক আমল শেষ হয়ে যায় তাহলে হকদার ব্যক্তির পাপ পাওনা অনুসারে এই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। ফলে সে এই পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে’।[৩]
টাকা পয়সা বা যে কোনো লেনদেনে সাক্ষী এবং লিখে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরপরও সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহ মেনেই চলতে হবে। যেন আল্লাহ তায়ালার অনুগ্ৰহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুপারিশ লাভ করতে পারি। পাশাপাশি দুনিয়াতেও বিপদাপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। অন্যথায় ইতিহাসে এমনও ঘটনা আছে- এক মুহূর্তের ভুলের জন্য সারাজীবন মাশুল দিতে হয়েছে!
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ইসলাম বুঝার ও মানার তাওফিক দান করুন।
______________________________________
[১] আল কুরআন; ২:২৮২
[২] বুখারি শরিফ; হাদিস নং ২৪৪৯; তিরমিজি শরিফ; হাদিস নং ২৪১৯
[৩] মুসলিম শরিফ; হাদিস নং ২৫৮১; তিরমিজি শরিফ; হাদিস নং ২৪১৮