স্মৃতিতে বেলঙ্কা ইজতিমা  

স্মৃতিতে বেলঙ্কা ইজতিমা  

  • তামীম আব্দুল্লাহ  

মেইন রাস্তায় বড় দুটো ভাড়া বাস করে রাখা আছে। বাসের উপরে যাবতীয় দরকারী  জিনিসপাতি রাখা হচ্ছে। এই গুরু দায়িত্ব আমাদের মেশকাত- দাওরার বড়ভাইদের কাঁধেই থাকে। তখন নাহবেমীরে পড়ি। চৌদ্দ পনের সালের দিকে। ভোর রাত।  ফজরের একদম প্রথম প্রহরেই নামায সেরে নিয়েছি৷ কাঁধে ব্যাগ। বেশকিছু কাপড়-চোপড়। এই মুহূর্তে একটাই মুখ্য কাজ। ভালো সিট দখল করা। আরাম করে পথযাত্রা করতে হলে এই একমাত্র পথ। সিট বায়ান্নটা করে দুই বাসে একশ’ চারটা, সামনে  পিছনে এদিক সেদিক করে আরও দশ বারো জনের ব্যবস্থা হবে। বাকি চল্লিশ জনের ভরসা বাসের মাঝে লম্বালম্বি শুয়ে বসে। এই চল্লিশ জনের যাত্রাটা একটু কষ্টের। সেই কষ্ট দূর করতেই এত দৌড়ঝাপ। সমস্ত দৌড়ঝাপ করেও কোনো লাভ হলো না। শেষমেষ বাসে সিট ছাড়া যাত্রা শুরু করা লাগলো। আমাদের ব্যাচের মোটামুটি বসার জায়গা পেয়েছে পিছনের দিকে। অবশ্য পিছে একটু ঝাকুনির সমস্যা থাকলেও পুরো  পথ বোরিং না কাটানোর এইটাই এক উপায়। বাস চলতে শুরু করলো। আমি দাঁড়িয়ে  আছি। আমার সামনে বসে আছে মহিউদ্দিন আর রিয়াজ। আমি বললাম, ‘ফাইনালি  উই গাইজ আর গোয়িং টু শ্রীলংকা’। মহিউদ্দিন মাথায় চাটি মেরে বলল, ওইটা শ্রীলংকা না বেলংকা।

মাদরাসায় যেহেতু কোনো আলাদাভাবে শিক্ষাসফর থাকে না তাই উস্তাদরা বলতেন, এটা তোমাদের শিক্ষাসফর

শুরু থেকে বলি! আমাদের বড় হুজুর আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা. এর আহ্বানে তাঁরই গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের বেলঙ্কায় তিন দিন ব্যাপি ইজতিমা হয়। সে অনেকদিন ধরেই হয়। প্রতি বছর মাদরাসার পক্ষ থেকে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মাদরাসায় যেহেতু কোনো আলাদাভাবে শিক্ষাসফর থাকে না তাই উস্তাদরা বলতেন, এটা তোমাদের শিক্ষাসফর। যেহেতু সফর তাই তাতে বিদেশ বিদেশ একটা ভাব আনতে আমরা বেলংকার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা বলতাম শ্রীলংকা। বড় হুজুরের এই ইজতিমা ওইখানকার একটা ট্রাডিশনাল কালচারের মতো ছিলো। স্থানীয় লোকেদের ভাষায়, আত্মীয়-স্বজনেরা দুই ইদে গ্রামে না আসলেও ইজতিমার সময় ঠিকই আসে। সেই প্রেক্ষিতে পুরো ইজতিমা হয়ে ওঠে এক মধুর মিলনমেলা। আল্লাহ  ভোলা মানুষের যেমন আল্লাহর কাছে ফিরে আসার মেলা তেমনি দূর থাকা স্বজনদেরও ঘরে ফেরার মেলা। এই দুই মেলার মধ্যে তখন আমাদের জন্য আরো এক মেলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। সেখানকার সমাগম উপলক্ষে বাজারের পাশে বসা শীতের রঙিন মেলা। মানুষের সমাগমকে পুঁজি করে তারা সেখানে নানান দোকানপাট বসাতো। দূর দূরান্ত থেকে এসে মানুষেরা দোকানের পসরা বসাত।

পাজকোলে জমা যাওয়া শিশুর মতো কাটে আমাদের শহরের থৈ থৈ গদবাঁধা জীবন। যা কিছু রঙিন সব যেন জানালার কাঁচ। কিন্তু সেখানে তেমন নয়। শহরের পিচ গলা রাস্তা ডিঙিয়ে বৈদ্যুতিক তারের অনশন ছাপিয়ে জনাজীবনের যাবতীয় স্থবির চিত্রপট হারিয়ে যেন এসেছি সিন্দবাদের মত নতুন দেশের খোঁজে। ঋতুকালের আবর্তনের মতো সরু রাস্তার কোল খানিকটা গিয়ে মিশে গেছে মেঠোপথে। মেঠোপথের পাশ ঘেঁষে গেছে উদ্দাম মাঠের নামে সবুজের আল্পনা। সবুজের পরে সবুজ। তার ওপারে আরো কিছু সবুজ। চোখের আলোতে নেমে আসে নীলাভ আভাস৷ কুয়াশার চাদর জড়িয়ে সমস্ত মেঠোপথ ঘাসেদের ডগায় শিশিরের দোলদোলানিতে উড়ে যায় বাতাস। হীম হীম করে আড়াল হয় পাখিদের ডানা ঝাপ্টানোর সুখ। সূর্য উঠার কালে যেমন আলোড়িত হয়ে জেগে ওঠে সমস্ত গ্রামের সুখ দুঃখ।

আমল, জিকির ও বয়ানের ফাঁকেফাঁকে যাই মেলায়। মেলায় কতশত খাবার। সবাই  ঘুরে ঘুরে দেখি। কেউই খাই না। একদম প্রথম দিন খেয়ে প্রায় সবারই পেটের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাই দূর থেকে দেখেই শান্তি। খাওয়ার মতো তিন বেলা ভাত। ওই ভাতই সম্বল। এখানকার খাবার সবার সুস্বাদু লাগলেও বড় ভাইদের না খাওয়ার কারণ তখন বোঝা গেল। তবে খাওয়ার জন্য সবচেয়ে উৎসুক ছিলাম উইর‍্যা খাওয়ার জন্য। উইর‍্যার কথা শুনেছি অনেক। একসময় এটাকে দিল্লি কা লাড্ডু মনে  হতে লাগলো। কিন্তু বেলংকা যাওয়ার পর যখন দেখলাম তখন খাওয়ার ইচ্ছাকে দমাতে কষ্ট হলো৷ দশ টাকার উইর‍্যা কেনা হলো। কিন্তু পাঁচ জনে মিলে শেষ করা  দায়! গুড় আর মুড়ির মিশেলে বানানো। এমন শক্ত যেন পাথর ভাঙা সম্ভব। সেই দশ টাকার উইর‍্যা সবাই মিলে পাঁচ টাকারও খেতে পারিনি৷ প্যাকেট ধরে স্থানীয় এক ছোট ছেলেকে দিয়ে দিলাম। তার চোখ খুশিতে চকচক করে  উঠলো।

হারিকেন আর কুপির আলোয় হলদে আভায় কীরণ মেখে বেলঙ্কা জুড়ে জ্বলে ওঠে জোনাকি পোকার মৃয়মাণ আলো

সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের সুরে মিলিয়ে নতুন করে হারিকেন আর কুপির আলোয় হলদে আভায় কীরণ মেখে বেলঙ্কা জুড়ে জ্বলে ওঠে জোনাকি পোকার মৃয়মাণ আলো।  উৎসবমুখর বাড়ির উঠোনগুলোতে শীতের পিঠার ধুম। রঙিন চোখে গ্রামীণ মেলায় ঘুরে জোড়ায় জোড়ায় চরকি। ঘরে ঘরে রাত্রি বাড়ে। শীত জড়ায়ে আসে গায়ে।

ইজতিমায় মুরুব্বিদের ইসলাহী দিকনির্দেশনায় মানুষ নিজেদের ভুল-ত্রুটি খোঁজে। আফসোসে নত হয় নফস। তওবার আশায় চোখে-মুখে আকুতি। এক অবিনশ্বর জীবনের জন্য জমা করা বাকি অনেক সঞ্চয়। তবু মনে বাঁধে আল্লাহ কাছে প্রিয় হওয়ার এক প্রবল সংকল্প। প্রকৃত মুমিন হওয়ার এক দৃঢ় স্পৃহা। ব্যস এতটুকুই অন্তরে দরকার। সেই স্পৃহাই তো এক জ্বলন্ত অঙ্গার। হাজারো অন্ধকারের মাঝে ক্ষীণ আলোই একদিন খোলস ভেঙে আনবে ইমানের নূরে উজ্জীবিত এক রাঙা প্রভাত।

শেষদিন বড় হুজুরের আকুতিকণ্ঠে আল্লাহ ডাকের মূর্ছনায় আন্দোলিত হয় প্রতিটা মানুষের হৃদয়। মাইকের আওয়াজে আওয়াজে ঘর থেকে হাত তুলে দোয়ায় শরীক হয় বাড়ীর মা-বোন। ঘোলা চোখে নফস নতজানু হয় তওবার ফরিয়াদে। চোখ থেকে ঝরতে চাওয়া একেকটা চোখের জল অপেক্ষায় কাটায় মাবুদের মঞ্জুরীর তরে। চোখ মুছে দোয়া শেষে সবাই বাড়ীর পথ ধরে। চোখে মুখে মানুষের এক ইসলাহী পণ। আমরাও মাঠ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ি। মেইন রোডে বাস আমাদের অপেক্ষায় আছে। সমস্ত মেঠোপথে একটা লাঠিওয়ালা গাড়ী কিনে পথে ঠেলে ঠেলে দুষ্টামীর ভঙ্গিতে এগিয়ে যাই। আবার কবে আসা হবে বেলংকা!

লেখক, তরুণ আলেম ও সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *