স্মৃতির মিনারায় মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি

স্মৃতির মিনারায় মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী 

ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া। ৩২ খণ্ডের বিশাল এক কিতাব। আমার বুক সেলফের উপরে সাজানো। প্রতিদিন নজর পড়ে সেখানে। যখনই নজর পড়ে তখনই মনে পড়ে প্রিয় উস্তাদ মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি (রহ.) এর কথা।

দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক প্রধান মুফতি। চলন্ত লাইব্রেরী খ্যাত ব্যক্তিত্ব। ইলমের ময়দানে বেমেছাল এক মনীষা। যিনি বিদায় নিয়েছেন ২৮ বছর আগে। কিন্তু প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ যেন হৃদয়-মন্দির জুড়ে আছেন। তাঁর স্মৃতিগুলো যেন চোখের পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তাঁর কর্মযজ্ঞ এই পৃথিবীর মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামের এবং মুফতিয়ানে ইজামদের হৃদয়ে বাসা বেঁধে আছে। প্রতিদিন তাঁর কিতাবগুলো আলেমদের হাতে ওঠছে। তারা মুতালাআ করছেন। দুআর মধ্যে শামিল তাঁকে করতে ভুলছে না কেহ।

মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি একজন প্রতিভাধর আলেম এবং সুলুকের লাইনের মহান ব্যক্তিত্ব। বিশ্বসেরা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতির আসন অলংকৃত করে ছিলেন।  একটানা বহুবছর এ পদে সমাসিন ছিলেন তিনি। যার ইলমী ছোঁয়ায় আলোকিত হয়েছিল লাখো আলেম। যার ইলমী ভান্ডার থেকে আহরণ করে ধন্য হয়েছে গোটা বিশ্বের আলেম সমাজ। বিশ্বের যেখানে ওলামায়ে কেরাম আছেন, সেখানেই তাঁর খেদমতের ধারা অব্যহত। তাঁর লিখনী, পুস্তক এবং কিতাবাদীর প্রতি মানুষ আজো মুখাপেক্ষী।  এমন কোন আলেম পাওয়া যাবেনা, যিনি মুফতী মাহমুদ সাহেবের কিতাব থেকে উপকৃত হননি।

তিনি ছিলেন সুলুকের লাইনের মহান সাধক। শাইখুল হাদীস জাকারিয়্যা (রহ.) থেকে খেলাফত ও ইজাজত প্রাপ্ত। শায়েখ জাকারিয়্যা (রহ.) এর তিরোধানের পর তিনি তাঁর জানেশীন হয়েছিলেন।  দ্বীনী ইলমের আলোকবর্তিকা নিয়ে যেমন ছুটেছেন, অকাতরে ইলম বিতরণ করেছেন দেশ ও বিদেশের সর্বত্র, তেমনি ইলমে তাসাউফের সাধক হিসাবে সারা দুনিয়ার মাঝে সফর করেছেন তিনি। লক্ষ লক্ষ ইলম-পিপাসু ছাত্রের পাশাপাশি অগণিত ভক্ত-অনুরক্তের রুহের খোরাক জুগিয়েছেন। দাওয়াত ও তবলীগের মেহনতে  নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন সবসময়। দ্বীনি মশাল নিয়ে ছুটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।

  • জন্ম

১৯০৭ সনে সাহারাণপুর জেলার ‘গঙ্গুহ’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মাওলানা হামেদ হাসান, যিনি শাইখুল হিন্দ (রহ.) এর ছাত্র ছিলেন এবং ইমামে রব্বানী ফকিহুন নফস রশিদ আহমাদ গঙ্গুহি (রহ.) এর নিকট বায়আত গ্রহন করেন। মুফতী মাহমুদ হাসান গঙ্গুহি (রহ.) এর বংশের সূত্রপরম্পরা প্রখ্যাত সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) এর সাথে মিলিত হয়েছে।

  • শিক্ষাজীবন

শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহ.) এর নিকট তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সুচনা হয়। রশিদ আহমাদ গঙ্গুহির মেয়ের বৈঠকখানাতে এই মোবারক কাজ শুরু হয়। এরপর হাফেজ করিম বখশ এবং হাফেজ আব্দুল করিমের নিকট হেফজ সমাপন করেন। ১৩৪১ হিজরীতে সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুমে ভর্তি হন। সেখানে ইলমে ছরফ, ইলমে নাহু এবং ইলমে ফিকাহের প্রাথমিক কিতাদী পড়াশুনা করেন। এরপর ১৩৪৮ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দে গমণ করেন। সেখানে ‘হেদায়া আখেরাইন’ জামাতে ভর্তি হয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দেওবন্দের শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৩৫০ হিজরীতে শাইখুল ইসলাম মাদানী এর নিকট বুখারী শরীফ ও তিরমিজি শরীফ পড়েন।

  • কর্মজীবন

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে ১৩৫১ হিজরীতে সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুমে শিক্ষকতা শুরু করেন। একটানা ২০ বছর সেখানে সুনামের সহিত দ্বীনি ইলমের খেদমতের আঞ্জাম দেন। ১৩৭১ থেকে নিয়ে ১৩৮৫ হিজরী পর্যন্ত কানপুর জামিউল উলুমে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেখানে একটানা চৌদ্দবছর ছিলেন। এরপর ১৩৮৫ সন থেকে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি পদে আসীন হন। সেসময়ে দেওবন্দে বুখারী শরীফের একাংশের দরসও দিতেন তিনি। দারুল উলুম দেওবন্দ থাকাকালিন বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্টানের সেরপুরুস্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি মাজাহিরুল উলুমের মুরুব্বী হিসাবেও বহুবছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

  • আধ্যাত্মিক সাধক

একজন আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবে মুফতী মাহমুদ সাহেবের খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপি। তিনি শাইখুল হাদীস জাকারিয়া (রহ.) এর কাছে বায়আত হন। এরপরে তাঁর নিকট থেকে খেলাফত-ইজাজত লাভ করেন। শায়েখ জাকারিয়ার ইন্তেকালের পরে তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

মুফতী মাহমুদ সাহেব (রহ.) পুরো দুনিয়া সফর করতেন। শায়েখ জাকারিয়্যা (রহ.) এর জানেশীন হওয়ার কারণে দেশ-বিদেশের বহুস্থানে তাঁর সফর হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগের মিশন নিয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দুনিয়া জুড়ে। পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিয়েছেন। পাক-ভারত উপমহাদেশ ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকার মত আধুনিক শহরগুলোতে তাঁর দাওয়াতের মিশন অব্যহত ছিল।

তিনি আধ্যাত্মিক রাহবার হিসাবে লাখো আলেম-উলামা এবং সাধারণ জনতার মাঝে কাজ করেছেন। আলেমদেরকে দ্বীনি তালিমের পাশাপাশি সুলুকের লাইনে যুহদ-মুজাহাদার কাজে জুড়ে দিয়েছেন। যে কারণে দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলোতে আজও ইলমে তাসউফের তাহরীক অব্যবহিত ভাবে চালু রয়েছে।

বাংলাদেশে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহির বেশ কয়েকজন খলিফা রয়েছে— ১. আল্লামা নুর হোসেন কাসেমী (রহ.), ২. মুফতি মামুনুর রশিদ ৩. মুফতি শফিকুল ইসলাম ৪. মাওলানা মোস্তফা সাহেব ৫. মুফতি জাকির হোসেন (দামাত বারাকাতুহুম) প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম তাঁর কাছ থেকে খেলাফত-ইজাজত লাভ করেন।

  • বাংলাদেশ সফর

তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। এরমধ্যে ১৯৯৬ সনে জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ এর মসজিদে রমজানে মাসব্যাপি ইতিকাফ করেছিলেন। যেখানে হাজারো ওলামায়ে কেরাম ইতিকাফে শরীক হয়েছিল। মালিবাগ মসজিদের নিচতলা, দোতলা এবং তিনতলাতে আলেমদের উপস্থিতিতে ভরপুর ছিল। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ওলামায়ে কেরাম সে মজলিসে শরীক হয়েছিলেন। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), আল্লামা নুর হোসেন কাসেমী (রহ.), আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ (দা.বা.)-সহ বহু উলামায়ে কেরামকে সে ইতিকাফে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল।

  • দারুল উলুম দেওবন্দে যেভাবে দেখেছি

দারুল উলুম দেওবন্দে মুফতি মাহমুদ সাহেবকে আমরা পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৯৬ সনের কথা। সেসময়ে নাসায়ী শরীফের দরস দিতেন। বছরের শুরু থেকে তাঁর কাছে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। বয়সের কারণে তিনি তখন দুর্বল ও দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লেও তাঁর ইলমের সাগরে কোনো ভাটা পড়েনি। যখন তিনি হাদীসের তাকরীর করতেন, একদম নওজোয়ান আলেমের মতো তাঁর কথাগুলো শোনা যেত।

দারুল উলুমের ছাত্তা মসজিদে তাঁর খানকা ছিল। দেশ-বিদেশের আলেম-উলামা এবং ভক্তগণ সেখানে জমা হতেন। সবচেয়ে মজার ছিল তাঁর বিকেল বেলার মজলিস। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ছাত্তা মসজিদের সেহেনে চেয়ার পেতে বসতেন। আলেমগণ বিভিন্ন ইলমী বিষয়ে সমাধানের জন্য তাঁর কাছে যেতেন। আবার দেশ-বিদেশের মানুষের বিভিন্ন চিঠি পড়ে তাঁকে শোনানো হতো। বিভিন্ন মাসয়ালা বা ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকাহের জটিল জটিল প্রশ্ন তাঁকে করা হত, সবচেয়ে আজব লাগত, তিনি মুখস্থ ভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। কিতাবের উদ্বৃতিসহ, এমনকি কোন কিতাবের কোথায়? কোন অধ্যায়ে? কোন পৃষ্ঠায়? কোন লাইনে আছে? —সব তাঁর নখদর্পনে ছিল। ছাত্তা মসজিদের খানকায়ে আমল ছিল সুখকর। নিয়মিত মুতাআল্লিকীনদের বিভিন্ন আমলে শরীক থাকতে দেখা গেছে। চব্বিশঘন্টা সেখানে আমল চালু ছিল। তাতে এক নুরানী পরিবেশ বিরাজ করত সেখানে।

  • ইন্তেকাল

আমরা তখন দেওবন্দে। তিনি তিনমাস দরস দেওয়ার পরে আফ্রিকা সফরে যান। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সফর। আবার জীবনের শেষ বছরের দরসও ছিল সেটা। দেওবন্দের মাটিতে আর ফেরা হয়নি। দাওয়াত ও তবলীগের মিশন নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন। সফরের হালাতেই  দক্ষিণ আফ্রিকাতে ১৯৯৬ সনের ২ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। জানাযা ও দাফন হয় সেখানেই। দারুল উলুম দেওবন্দসহ পুরো আলমের ওলামা এবং ভক্তদের মাঝে শোকের ছায়া নেমেছিল সেদিন। তিনি বিদায় নিলেন। আর দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে ফেরেননি, আর দারুল হাদীসের মসনদে বসেননি।

  • রচনাবলী

মুফতী মাহমুদ সাহেবের ইলমে ফিকাহের উপরে দখল ছিল বেশী। যে কারণে দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান মু্ফতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর ৩২ খণ্ডের বিশাল ফতোয়ার কিতাব ‘ফতওয়ায়ে মাহমুদিয়া’, যা থেকে হাজারো উলামায়ে কেরাম উপকৃত হচ্ছেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো লিখনী রয়েছে। তাঁর ৯ টি মালফুজাত এবং ৯ টি মাওয়েজ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য রচনাবলী— ১. আল তাবারীর উর্দু: অনুবাদ সীরাতে সাইয়্যেদুল বাশার ২. ফাহারসিল হাওয়ী লি-হাসিয়াতুত ত্বাহাবী ৩. মানাযিলুল ইলম ইত্যাদী কিতাবসমূহ থেকে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

‘বাকিয়্যাতুচ্ছলফ’ মুফতি মাহমুদ সাহেব, তাঁর ইলম এবং আমল ছিল ঈর্ষনীয় পর্যায়ের। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও মহান প্রভুর ইবাদতে সবসময় মশগুল থাকতেন। ঢাকা মালিবাগ মাদরাসাতে মাহে রমজানে যখন ইতিকাফ করেছিলেন, তখন তো তাঁর বয়স প্রায় ৯০ এর কাছাকাছি। সেই বয়সেও তিনি পুরো ২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ পড়েছেন। একদিনও তাঁকে কোতাহী করতে দেখা যায়নি। তাঁর আমল ও ইলম দেখে মনে হত, তিনি ‘বাকিয়্যাতুচ্ছলফ’ তথা পুর্বসূরী মহান ব্যক্তিদের অবশিষ্ট ব্যক্তি।

আল্লাহ তাআলা এই মনীষীকে জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *