হকার পুনর্বাসনে ব্যর্থ ডিএসসিসি

হকার পুনর্বাসনে ব্যর্থ ডিএসসিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করে বিদেশে পাঠানোসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। গত বছরের শুরুতে এই ঘোষণা দেওয়ার পর হকারদের একটি তালিকা করে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। ফুটপাত পাহারায় কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের পর দেড় বছর অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত কোনও হকারকে বিদেশে পাঠানো কিংবা দেশে পুনর্বাসন করতে পারেনি ডিএসসিসি। তাই আবারও হকাররা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন। হকাররা বলছেন, ডিএসসিসি কেবল ঘোষণাই দিয়েছে, বাস্তবমুখী কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। আর সংস্থাটির মেয়র সাঈদ খোকনের দাবি, হকারদের কল্যাণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে তারা সাড়া দেননি। এ কারণেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, হকারদের আইডি কার্ড দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। যেসব হকার বিদেশ দেতে চান, তাদের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মাধ্যমে কম খরচে বিদেশে পাঠানোর কথাও বলা হয়েছিল। এছাড়া যারা দেশে পুনর্বাসিত হতে চান, তাদের সিটি করপোরেশন পুনর্বাসন করবে। এছাড়া যারা করপোরেশনের নিয়ম মেনে ব্যবসা করবেন, তাদের আইডি কার্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ের সুযোগ দেওয়া হবে। এ জন্য নগরীর নির্দিষ্ট কিছু স্থানকে হলিডে মার্কেট ঘোষণা দিয়ে সেখানেই তাদের ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হবে। চাকরি করতে চাইলেও সুযোগ থাকবে তাদের জন্য। প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়া হবে।

কিন্তু হকারদের তালিকা তৈরি করা হলেও আইডি কার্ড দেওয়া হয়নি। কাউকে বিদেশ বা দেশেও পুনর্বাসন করা হয়নি। তবে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, হকার পুনর্বাসনের জন্য সম্পত্তি বিভাগ থেকে ৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি প্রবাসী কল্যাণ ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়েও জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে আমরা কাজ শুরু করবো।

মূলত হকারদের ব্যবসাকে সুনির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই এসব মার্কেট চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ডিএসসিসি এলাকার প্রায় ১৯টির মতো স্থানের তালিকা জমা দেওয়া হয়। এরপর এগুলো যাচাই-বাছাই শেষে প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পাঁচটি স্থানের অনুমোদন দেন। এগুলো হচ্ছেÑমতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে ফুটপাতের উভয় পাশে আইডিয়াল স্কুল থেকে এজিবি কলোনি মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতের অংশ, যার দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। বায়তুল মোকাররম লিংক রোড। এর জায়গা হচ্ছে মার্কেটের উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণের জিপিও গেট পর্যন্ত বিস্তৃত। এর দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার সাধারণ বীমা কার পার্কিং থেকে ইউনুছ সেন্টার পর্যন্ত। এর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ফুট ও প্রস্থ ৪ ফুট। নবাবপুর রোডের কাপ্তান বাজার মোড় থেকে রায় সাহেব বাজার মোড়। এর দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। সেগুন বাগিচা এলাকার কার্পেট গলি থেকে রাজস্ব ভবন রোড পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম অংশ। এর দৈর্ঘ্য ৮০০ ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। এরপর শর্তসাপেক্ষে ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে হলিডে মার্কেট চালু করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

শর্ত অনুযায়ী সপ্তাহের সরকারি ছুটির দিন শুক্রবার হলিডে মার্কেটে বসতে পারবেন হকাররা। এতে সপ্তাহের একদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে নগরবাসী ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। কিন্তু পরের বছরের (২০১৭ সাল) ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মার্কেটগুলো মোটামুটি সচল থাকলেও পরবর্তী সময়ে আবার বন্ধ হয়ে যায়।

উচ্ছেদের পর ফের ফুটপাতে বসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গুলিস্তান হকার রিয়াজ উদ্দিন, মতিঝিলের শিল্প মন্ত্রণালয় সংলগ্ন ফুটপাতের হকার আরাফাত উদ্দিন ও বায়তুল মোকাররম এলাকার হকার মো. সিরাজুল ইসলাম  বলেন, বিদেশ পাঠানো বা দেশে পুনর্বাসন, ক্ষুদ্রঋণ বা আইডি কার্ড দেওয়াসহ সিটি করপোরেশন যেসব কথা বলেছে, তার কোনোটিই তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সে জন্যই তারা আবার ফুটপাতে বসতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তাদের সংসার রয়েছে। ব্যবসা বন্ধ থাকলে পরিবার চলবে না।

এদিকে, ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করে দুই হাজার ৫০৬ জন হকারের তালিকা চূড়ান্ত করে ডিএসসিসি। তালিকাভুক্ত হকারদের মধ্যে মাত্র ৬৯ জন বিদেশ যাওয়ার আবেদন করেছেন। তবে তাদের কাউকেই বিদেশ পাঠানো বা দেশে পুনর্বাসন করতে পারেনি সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, হকারদের বিদেশ পাঠানোর জন্য আমরা তালিকা তৈরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিয়েছি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

অন্যদিক হকারদের অভিযোগ, বিদেশ পাঠানোর নামে যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তারা কেউই হকার নন। সিটি করপোরেশনের তালিকায়ও অনেক প্রকৃত হকারের নাম নেই।

মেয়র সাঈদ খোকন নির্বাচিত হয়ে নগর ভবনের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নগরীর ফুটপাত থেকে সব হকার উচ্ছেদের ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৭ সালের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮ মাস ফুটপাতে কাউকে বসতে দেওয়া হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে পাহারায় নিয়োগ করা হয় স্বেচ্ছাসেবক ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যদের।

উচ্ছেদ হওয়া হকারদের একজন মিরাজ মিয়া। তিনি গুলিস্তানের রাজধানী হোটেল সংলগ্ন সামনের সড়কে ফলের দোকান করতেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সিটি করপোরেশন যা বলে, তা করতে পারে না। হঠাৎ করেই একটা ঘোষণা দিয়ে দেয় আলোচনায় আসার জন্য। হকার পুনর্বাসনের জন্য তাদের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও নেই। সে কারণেই কোনও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারছে না তারা।

হকারদের আরও অভিযোগ, বিদেশ পাঠানোর নামে সিটি করপোরেশন যে কয়জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের কেউ হকার নন। হকার নামধারী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নিয়ে কিছু সভা-সেমিনার করেই মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকৃত হকাররা কেউই প্রশিক্ষণ পাননি। তালিকায়ও তাদের অনেকের নাম নেই।

বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের উপদেষ্টা মুর্সিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, সিটি করপোরেশন হকারদের বিদেশ পাঠানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কি হকাররা জানে? গত ১২ জুন হকার নেতাদের নিয়ে সেমিনার করা ছাড়া আর কী কাজ হয়েছে? আমরা চাই না হকাররা রাস্তায় থেকে জনগণের সমস্যা সৃষ্টি করুক। কিন্তু তারা যেহেতু রাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু এই নাগরিকদের পুনর্বাসন করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর বিষয়টাও অত সহজ না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, অতীতেও অনেকবার হকারদের পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত হকাররা পুনর্বাসিত হননি। হকার পুনর্বাসনের নামে রাজনৈতিক নেতাকর্মী পুনর্বাসিত হয়েছেন। এখন সিটি করপোরেশন যাদের তালিকা করেছে, তাদের অধিকাংশই হকার নন। এছাড়া বিদেশ পাঠানোর বিষয়ে যাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তাদের সঙ্গেও হকারদের কোনও যোগসূত্র নেই। যে কারণে হকারদের দিক থেকে সিটি করপোরেশন সাড়া পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহ-সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ফুটপাত হচ্ছে সাধারণ মানুষের হাঁটার জায়গা। আদর্শ নগরী গড়তে হলে ফুটপাত পথচারীদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। এখন হকারের দিকটা মানবিকভাবে বিবেচনা করলে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? প্রথমত সারা শহরের বিশেষ বিশেষ স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসার জন্য তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু ফুটপাতে নয়। দ্বিতীয়ত তাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি সঠিক নীতিমালা করতে হবে। ফলে হকার পুনর্বাসন প্রকল্পে আর অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, অতীতে দেখা গেছে হকারদের জন্য তৈরি মার্কেট হকাররা পাননি। এ জন্য হকারদের যেমন সিটি করপোরেশনের প্রতি আস্থা আসছে না, তেমনি সিটি করপোরেশনও বিষয়টি নিয়ে সামনের দিকে এগুতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি একটা পরিকল্পনার প্রয়োজন। শুধু ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করে দিলেই তারা ফুটপাত ছেড়ে চলে যাবে না।

এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা দীর্ঘ ৮ মাস শক্ত অবস্থানের পর নানা মহলের রিকোয়েস্ট ও মানবিক দিক বিবেচনা করে গত কোরবানির ঈদের সময় তাদের বসতে দিয়েছি। এরপর থেকে তারা আর উঠে যাননি। পরবর্তী সময়ে তাদের আর তুলে দেওয়া হয়নি। বিদেশ পাঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা উদ্যোগ নেওয়ার পর হকারদের পক্ষ থেকে সাড়া পাইনি। প্রকল্পও তৈরি করা হয়েছে। কেন হকাররা আগ্রহ দেখাচ্ছে নাÑ তা ঠিক বলতে পারছি না।

 

_Patheo/105/sl

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *