পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : কওমি মাদরাসাগুলোকে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তের উপর চালানোর জন্যই বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
তিনি বলেন, আমাদের এই বোর্ড প্রতিষ্ঠার পেছনে দুনিয়াবি কোনো মোহ নেই, কওমি স্বীকৃতি লাভের উদ্দেশ্যেও এই বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল কওমি মাদরাসাগুলোকে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তের উপর পরিচালিত করা। এই মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের পথচলা শুরু হয়েছে।
শনিবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরিপাড়ায় জামিআ ইকরা বাংলাদেশ মিলনায়তনে বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশের কাউন্সিল সভায় আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এসব কথা বলেন।
দেওবন্দই বর্তমান সময়ে হক ও হক্কানিয়তের সঠিক মাপকাঠি উল্লেখ করে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান যামানায় হকের উপর চলা অত্যন্ত মুশকিল ও কঠিন। বর্তমানে একমাত্র দেওবন্দই শতভাগ হক পথ ও পন্থার উপর রয়েছে। এর বাইরে আর কেউ শতভাগ হকের উপরে অটল নেই। তাই যারা দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তকে অনুসরণ করবে, তাদের হকের উপরে চলা সহজ হয়ে যাবে। আর যারা দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তের অনুসরণ করবে না, দ্বীনের উপর চলা, হকের উপরে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন। সুতরাং হকের উপরে চলতে হলে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তের বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন: ঠকবাজি ও প্রতারণা করা মারাত্নক গুনাহ : আল্লামা মাসঊদ
দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়ত কী তা ব্যক্ত করতে গিয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম বলেন, দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়ত নতুন কোন বিষয় নয়। দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়ত হলো ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসবিহী’-এর উপর প্রতিষ্ঠিত এক জামাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অবস্থার উপর দ্বীনকে রেখে গিয়েছেন, যে মানহাজের উপর দ্বীনকে রেখে গিয়েছেন, ঠিক সেভাবে কোনো বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ছাড়া দ্বীনকে মানাই হলো দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়তের আদর্শ।
আল্লামা মাসঊদ বলেন, এই উম্মতের উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অবস্থায় দ্বীনকে রেখে গিয়েছেন, সেভাবে দ্বীনকে হেফাজত করা এবং নিজের মাঝে দ্বীনের বাস্তবায়ন ঘটানো। সেইসাথে অন্যের কাছেও সঠিক দ্বীনকে পৌঁছে দেয়া।
নবীগণ নিষ্পাপ ও সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার উর্ধ্বে জানিয়ে বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান বলেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বিদা হলো, নবীগণ নিষ্পাপ, তাদের কোন গুনাহ নাই। আর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। সুতরাং নবীদের সমালোচনা করা তো যাবেই না। পাশাপাশি সাহাবায়ে কেরামেরও সমালোচনা করা যাবে না, তাঁদেরকে গালি দেয়া যাবে না। সাহাবায়ে কেরামকে যারা গালি দেয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ দিয়েছেন।
মওদুদী-জামায়াতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি উল্লেখ করে ফিদায়ে মিল্লাতের এই খলীফা বলেন, মানুষকে ধোঁকায় ফেলতে যুগে যুগে শয়তান চেহারা পাল্টে এসেছে, কখনো কখনো নেক সূরতে তারা মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে, বিভ্রান্তিতে ফেলেছে, গোমরাহ করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এই যামানায় শয়তান মওদুদীর চেহারায় এসেছে। এই মওদুদী নবীদের ভুল ধরেছে, সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করেছে, এরা আমাদের নেতৃবৃন্দ সাহাবায়ে কেরামকে গালিও দিয়েছে। এই মওদুদীরা এখন কওমি মাদরাসাগুলোকে নিজেদের টার্গেট বানিয়েছে। গোপনে গোপনে বড় বড় মাদরাসায় নিজেদের চিন্তা-চেতনার ছাত্রদের ঢুকিয়ে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়ত থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে কিতাব রচনা করছে। তাই মাদরাসাগুলোকে বাঁচাতে, দ্বীনকে রক্ষা করতে মওদুদি জামাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। আমাদের এই শিক্ষা বোর্ড দ্বীন সংরক্ষণের পাশাপাশি সমস্ত বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাবে।
বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা শিক্ষাবোর্ডের সব নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবৃন্দের উদ্দেশে সংগঠনের চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের এই বোর্ড দুনিয়া অর্জনের মাধ্যম নয়। এই বোর্ডকে কখনো দুনিয়া আয়ের মাধ্যম মনে করবো না। আমরা দুনিয়া অর্জন করবো দুনিয়ার মাধ্যমেই, দ্বীনকে বিক্রি করে দুনিয়া কামাই করবো না।
তিনি বলেন, বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা শিক্ষাবোর্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হতে হলে ৫টি বিষয়ের উপর সবাইকে অটল থাকতে হবে,
এক. নেতৃবৃন্দের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা।
দুই. হিম্মত নিয়ে কাজ করা।
তিন. পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়া।
চার. সর্বোচ্চ পর্যায়ের মেহনতের সাথে বোর্ডের দায়িত্বগুলো আঞ্জাম দেওয়া।
পাঁচ. সফলতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
এক দঙ্গল জাদুকরদের বিরুদ্ধে একা হযরত মুসা (আ.)-এর বিজয়ের নজীর দিয়ে ‘হকের উপরে থাকলে অল্প সংখ্যাই যথেষ্ট’ মন্তব্য করে আল্লামা মাসঊদ বলেন, আমরা হকের উপরে আছি এবং থাকবো। কারণ, হকের উপর থাকলে অল্প সংখ্যাই যথেষ্ট, হকের উপর থাকলে আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথে থাকবে। অন্যদিকে হকের উপরে না থাকলে, সংখ্যায় বেশি হলেও আল্লাহর সাহায্য আমাদের সহায় হবে না। ইনশাআল্লাহ, বাতিল একদিন পরাজিত হবেই হবে।
প্রসঙ্গত, আজকের এই কাউন্সিলে জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশের উপদেষ্টা পরিষদ, মজলিসে আমেলা ও মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডটির সভাপতি নির্ধারণ করা হয়েছে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে।
মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলুম, ঢাকার মুহতামিম মুফতি মোহাম্মাদ আলী। এছাড়া সহকারী মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ৪ জন। তারা হলেন, জামিআ আশরাফিয়া খাগডহর, ময়মনসিংহের মুহতামিম মুফতি তাজুল ইসলাম কাসেমী। জামিআ ইসলামিয়া ভাসানটেক, ঢাকার মুহতামিম মাওলানা শাহাদাত হুসাইন। জামিআ আশরাফিয়া নূরেরচালা, ঢাকার মুহতামিম মাওলানা আবদুল আলীম ফরিদী, এবং মাদরাসাতু উসমান বিন আফফানের মুহতামিম মাওলানা শরফুদ্দীন।
উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ৪ জন। তারা হলেন, দারুল উলুম আযমিয়া, বনশ্রীর সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আসআদ আল হুসাইনি, দিনাজপুর হিলি মাদরাসার মাওলানা শামসুল হুদা খান, ঢাকা সাভারের মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন সাইফী এবং তেজগাঁও রেলওয়ে মাদরাসার মাওলানা মুজিবুর রহমান।
সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ২ জন। তারা হলেন, জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম, খুলনার মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম এবং দারুল উলুম আযমিয়া, ঢাকার মুহতামিম, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ।
জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ঘোষণা করা হয়েছে ৬ জনকে। তারা হলেন, জামিআ কাসেমিয়া ধনতোলার মুহতামিম মাওলানা হুসাইন আহমদ, জামিয়া শায়েখ যাকারিয়া দক্ষিণখান, ঢাকার মুহতামিম ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, নশাসন ইসলামিয়া কওমি মাদরাসা, শরিয়তপুরের মুহতামিম মাওলানা আব্দুল বাতেন ফরিদী, আলহাজ্জ শামসুদ্দীন ভূইয়া জামেয়া ইসলামিয়ার মুহতামিম মাওলানা হিফজুর রহমান, জামেয়া ইসলামিয়া হেমায়েতুল ইসলাম সিলেটের মুহতামিম মাওলানা ক্বারী শামসুল হক এবং জামিআ আরাবিয়া খাদিজাতুল কুবরা, খুলনার মুহতামিম মুফতী মুমতাযুল করীম।
কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন জামিআ মাদানিয়া আসআদুল উলুম, খুলনার মুহতামিম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী। অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন তাকওয়া মাদরাসা ও এতিমখানা, ঢাকার মুহতামিম মাওলানা আবদুর রহীম কাসেমী। শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন জামিআ ইকরা বাংলাদেশ, ঢাকার মুহতামিম মাওলানা আরিফ উদ্দীন মারুফ। প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আয়শা সিদ্দীকা মহিলা মাদরাসা সিলেটের মুহতামিম মাওলানা মুখলিছুর রহমান। প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন রওজাতুল বানাত মহিলা মাদরাসা, গাজীপুরের মুহতামিম মাওলানা আতিকুর রহমান। তাহফীজ বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন আল কারীম ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা, ঢাকার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা আবদুর রহমান।
এছাড়া জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশের সদস্য পদে রয়েছেন জামিয়া ইসলামিয়া নূরুল উলূম কুলিয়ারচরের মুহতামিম মাওলানা আবদুল কাইয়্যুম খান। জামিআতুস সাহাবা বাগেরহাট-এর মুহতামিম মাওলানা আবুবকর। জামিয়াতুল ইসলাহ আল মাদানিয়া, কিশোরগঞ্জ-এর মুহতামিম মাওলানা সাঈদ নিজামী। জামিআ হানিফিয়া বাঘিবাড়ী, নরসিংদীর মুহতামিম মাওলানা শওকত আলী কাসেমী। জামেয়া হাফসা রা. মহিলা মাদরাসা, খুলনার মুহতামিম মাওলানা মোজাফ্ফর হুসাইন। জামেয়া তৈয়বা (পুরুষ-মহিলা) খুলনার মুহতামিম মাওলানা মফীজুল্লাহ ফয়েজী। ইমদাদুল উলূম রশিদিয়া মহিলা মাদরাসা, খুলনার মুহতামিম মুফতি গোলামুর রহমান। আয়শা সিদ্দীকা মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহের মুহতামিম মুফতি নুরুজ্জামান নূরী। আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া সোহাগী, ময়মনসিংহের মুহতামিম মাওলানা নজরুল ইসলাম।