মুনীরুল ইসলাম ● উম্মত-জননী খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রা.। একজন সেরা পুণ্যবতী নারী। জাহেলি যুগেও তিনি পূত-পবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরাÑপবিত্রবতী’ উপাধি পান। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী নারী। তাঁর ব্যবসার মালামাল সিরিয়ায় যায়। তাঁর একার পণ্যসামগ্রীই কুরাইশদের সবার পণ্যের সমান। অংশিদারী বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ-বিদেশে পণ্য বেচাকেনা করেন। তাঁর ব্যবসার মালামাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে বহন করার জন্য নিজস্ব সত্তর হাজার উট আছে। তাঁর বিশাল একটি গুদাম ঘর আছে, সেখানে আছে সবুজ রেশমি কাপড়ের তৈরি সাইন বোর্ড ঝুলানো। সে ঘরটি বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রীতে ভরপুর। তাঁর আছে অনেক দাস-দাসী বা কর্মচারী, তারা তাঁর ব্যবসার মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি-রপ্তানি করে। এর দ্বারা লাভবান হয় অন্যরাও।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যবসায় তাঁর সততা ও আমানতদারির কথা মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার কাছে তিনি তখন বিশ্বস্ত আল-আমিন। তাঁর সুনামের কথা খাদিজার কানেও পৌঁছে। তিনি ব্যবসার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠানোর চিন্তা করলেন। যোগ্য লোকের সন্ধান করছিলেন তিনি। খাদিজা আর দেরি করলেন না। লোক মারফত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেনÑ তিনি যদি ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদিজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাজি হলেন। খাদিজার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত গোলাম মাইসারাকে নিয়ে তিনি চললেন সিরিয়ায়। পথে এক গির্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলেন তিনি। গির্জার পাদ্রী অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন মাইসারার দিকে। জানতে চাইলেন, গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে?
মাইসারা বললেন, মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একজন লোক।
পাদ্রী বললেন, গাছের নিচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।
এই পাদ্রীর নাম ছিল বুহাইরা বা নাসতুরা।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেন এবং যা কেনার তা কিনে নিলেন। তারপর মাইসারাকে নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হলেন। পথে মাইসারা খেয়াল করলেন, মুহাম্মদ উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফেরেশতা দুপুরের প্রখর রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় ফিরে খাদিজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রি করলেন। ব্যবসায় এবার দ্বিগুণ মুনাফা হলো। বাড়ি ফিরে মাইসারা খাদিজার কাছে পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলি বলতে ভুললেন না।
খাদিজা অনেক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি নারী। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ভদ্রতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধে। তিনি তাদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করেন। মাইসারার মুখে সবকিছু শুনে খাদিজা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠান। খাদিজার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মানিয়া এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ নেন।
বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালিব, হামযা সহ তাঁর বংশের আরো কিছু মাননীয় লোক খাদিজার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। খাদিজাও তাঁর বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দাওয়াত দিলেন। সবার উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকষর্তার দিক দিয়ে এ খুতবা জাহেলি যুগের আরবি গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিয়েতে পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদিজা নিজেই দুই পক্ষের সব খরচ বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওলিমার (বউভাত) আয়োজন করতে বলেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খাদিজার নিবিড় ভালোবাসা উপলব্ধি করছিলেন। তিনি হৃদয়ে অনুভব করলেন, আসমান থেকে শব্দ এলো, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র নারীকে পবিত্র ও সত্যবাদী স্বামী দান করে থাকেন।’ তখন তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে যায়। তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে বেহেশতি হুর দেখতে পায়। চারদিকে বেহেশতি আতরের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বলাবলি করতে থাকে, ‘এত মনোমুগ্ধকর সুগন্ধ তাদের সততা থেকেই উৎসারিত হচ্ছে’।
হযরত খাদিজা হয়ে গেলেন আগামীর ‘উম্মুল মুমিনীনÑমুমিনদের জননী’। এটা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পনের বছর আগের ঘটনা। তখন মুহাম্মদের বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদিজার চল্লিশ। এই বিয়ের আগে খাদিজা এক আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নের কথা তার চাচাতো ভাই ওরাকা ইবনে নওফেলকে জানান। জাহেলি যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন। হিব্রু ভাষায় ইনজিল কিতাব লিখেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদিজা বলেন, আসমান থেকে আমার কোলে একটি চাঁদ নেমে এলো এবং সেটা আবার সাত ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
ওরাকা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, শেষ যুগে একজন রাসূল দুনিয়ায় তাশরিফ আনবেন, তাঁর সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। আর সেই বিয়ের ফলে তোমাদের থেকে সাতটি সন্তান জন্ম নেবে।
বিয়ের পর কুরাইশ বংশের একদল দোষ অন্বেষণকারী মূর্খ নারী খাদিজা সম্পর্কে অভিযোগ ও উপহাস করতে লাগল।Ñখাদিজার মতো একজন প্রসিদ্ধ ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বিত্তশালী নারীর এটা শোভনীয় নয় যে, একজন এতিম, রিক্তহস্ত, দরিদ্র ব্যক্তিকে বিয়ে করবে। এটা কি মন্দ একটা বিষয় নয়?…
তাদের নোংরা মন্তব্য হযরত খাদিজার কানে চলে গেল। তিনি দাস-দাসীদের সুস্বাদু খাবার তৈরির নির্দেশ দিলেন, আর ওই নারীদের দাওয়াত করলেন। খাদিজার দাওয়াতে তারা না এসে পারল না। সবাই যখন খাবার গ্রহণে ব্যস্ত, তখন খাদিজা তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, নারীরা! তোমরা নাকি মুহাম্মদকে বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে আমাকে উপহাস করছ? আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই, মুহাম্মদের মতো এমন ভালো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি কি তোমাদের জানাশোনায় আছে? মক্কা ও মদিনার আশেপাশে এমন ব্যক্তিত্ববান কেউ কি আছে, যিনি চরিত্র ও মর্যাদার দিক থেকে মুহাম্মদের মতো এত সুন্দর ও পরিপূর্ণতার অধিকারী? আমি তাঁর এই পূর্ণতার কারণেই তাকে বিয়ে করেছি। আর এমন কিছু তাঁর সম্পর্কে শুনেছি ও দেখেছি, যা অনেক উঁচু মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং কারো সম্পর্কে যা খুশি তাই বলা এবং না জেনে অশোভনীয় মন্তব্য করা উচিত নয়…।
হযরত খাদিজার এমন হৃদয়গ্রাহী কথা শুনে উপস্থিত নারীরা নির্বাক হয়ে গেল। এ সম্পর্কে তাদের বলার মতো কোনো ভাষা রইল না। খাদিজা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের কৃতকর্মের জবাব দিয়ে দিলেন।
এর আগে আবু হালা ও আতিক নামের দুই ব্যক্তির সঙ্গে খাদিজার বিয়ে হয়। তাদের ঘরে তিন-চারজন সন্তানও হয়। পরে তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হয়ে যান।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্জনে থাকতে ভালোবাসেন। খাবার সঙ্গে নিয়ে হেরা গুহায় চলে যান। সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদিজার কাছে ফিরে আসেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যান। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমন হলো। জিবরাইল ফেরেশতা তাঁর কাছে ওহি নিয়ে এলেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহির ভারে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদিজাকে ডেকে বললেন, ‘জাম্মিলুনী জাম্মিলুনীÑআমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’
খাদিজা ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল।
তিনি খাদিজার কাছে পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদিজা বললেনÑ না, তা কখনো হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরিব-দুখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ এবং মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।
এরপর খাদিজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই ওরাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। খাদিজা বললেন, শুনুন তো আপনার ভাতিজা কী বলে?
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওরাকা ইবনে নওফেলের মধ্যে চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক ছিল।
ওরাকা জানতে চাইলেন, ভাতিজা! তোমার কী হয়েছে?
আল্লাহর রাসূল পুরো ঘটনা খুলে বললেন।
শুনে ওরাকা বললেন, এ তো সেই ‘নামুস’Ñ আল্লাহ যাঁকে মুসা আলাইহিস সালামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! সেদিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে।
আল্লাহর রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, তারা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে?
ওরাকা বললেনÑ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ এমনটা হওয়ারই কথা। যখনই কেউ তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি ওই সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করব।
এর কিছুদিন পরই ওরাকা ইবনে নওফেল মারা যান।
হযরত খাদিজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দীন কবুল করে নিলেন। তিনি হয়ে গেলেন উম্মুল মুমিনীন রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আল্লাহও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। নারীদের মধ্যে তাঁরই প্রথম ইসলাম গ্রহণের খোশনসিব হলো। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের ওপরও পড়ল। তাঁর পিতৃকুল বনি আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি এখনো জীবিত আছেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদিজা রা. তাঁর সব ধন-সম্পদ ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজে ওয়াকফ করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদত এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সব আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে খাদিজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে সব প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করেন। ইসলামকে মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে আল্লাহর রাসূল যে ব্যথা অনুভব করেন, খাদিজা রা.-এর কাছে এলে তা দূর হয়ে যায়। তিনি তাঁকে সান্ত¡না দেন, সাহস ও উৎসাহ যোগান। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নেন। মুশরিকদের সব অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলের কাছে হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়ার কোনো ধন-সম্পদই আমাকে এতটা লাভবান করেনি যতটা খাদিজার সম্পদ করেছে।’ আল্লাহর রাসূল খাদিজা রা.-এর সম্পদ থেকে ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার কাজে, রিক্তহস্তদের সাহায্যের কাজে, এতিমদের প্রতিপালনের কাজে ব্যয় করেন। মুসলমানদের মধ্যে যারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে আসে, মুশরিকরা তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়, তিনি তাদেরকে খাদিজার রা. সম্পদ থেকে সাহায্য করেন। এর মাধ্যমে তারা মদিনায় পৌঁছে যায়। এক কথায়, তিনি যেভাবে ভালো মনে করেন খাদিজার সম্পদ সেভাবেই খরচ করেন।
নবুওয়তের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে খাদিজাও সেখানে অবস্থান নেন। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের কোনো ব্যবস্থা তাদের নেই। স্বামীর সঙ্গে খাদিজাও হাসিমুখে সেই কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে খাদিজা রা. প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে মাঝে মাঝে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেন। তাঁর তিন ভাতিজাÑ হাকিম ইবনে হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুমআ ইবনে আসওয়াদ ছিলেন কুরাইশ নেতাদের অন্যতম। অমুসলিম হয়েও তারা মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকিম ইবনে হিযাম তার গোলামের মাধ্যমে ফুফু খাদিজার কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছেন। পথে আবু জাহেল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহেলকে বললেন, ‘এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি এতে বাধা দিচ্ছ?’ প্রায় তিন বছর বনি হাশেম এই অসহনীয় দুর্ভিক্ষের মাঝে কাটায়।
তখনও নামায ফরজ হয়নি। তবুও খাদিজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে প্রথম থেকেই নামায আদায় করেন। একদিন আলী রা. দেখলেন, তাঁরা দু’জন নামায আদায় করছেন। তিনি জানতে চাইলেনÑ মুহাম্মদ, এ কি?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আলীর কাছে নতুন দীনের দাওয়াত পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। আলী দীন কবুল করে নিলেন। তিনি রাসূলের সাহাবী হয়ে গেলেন।
ইসলামের এই শুরুলগ্নে খাদিজা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরামর্শদাত্রী। রাসূলুল্লাহর সঙ্গে বিয়ের পর সব সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়েদ বিন হারেসা তাঁর প্রিয় গোলাম। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। আল্লাহর রাসূল যায়েদকে অনেক ভালোবাসেন, তাই খুশি করার জন্য তাকে মুক্ত করে দেন। মক্কার একজন ধনবতী নারী হয়েও তিনি নিজ হাতে স্বামীর খেদমত করেন।
একদিন তিনি পেয়ালায় করে আল্লাহর রাসূলের জন্য কোনো খাবার নিয়ে আসছিলেন। তখন জিবরাইল আ. আল্লাহর রাসূলকে বললেন, আপনি তাঁকে আল্লাহ ও আমার সালাম পৌঁছে দিন।
আরেকদিন জিবরাইল আ. বসে আছেন আল্লাহর রাসূলের কাছে। এমন সময় খাদিজা রা. সেখানে এলেন। জিবরাইল আ. আল্লাহর রাসূলকে বললেন, তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরি একটি বেহেশতি মহলের সুসংবাদ দিন। (বুখারী শরীফ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সময়টা নবুওয়তের দশম বছর দশই রমজান। জানাযা নামাযের বিধান এখনো চালু হয়নি। তাই জানাযা ছাড়াই তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। আল্লাহর রাসূল নিজে তাঁর লাশ কবরে নামান। আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা তাঁর জন্য রাসূলের কাছে কাফনের বিশেষ কাপড় নিয়ে আসেন। তিনি খাদিজা রা.-কে ওই কাপড় দ্বারা কাফন পরান।
খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ হিতাকাক্সক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। বিপদে-আপদে এ চাচাই তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর দুই নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণে মুসলিম উম্মাহর কাছে এ বছরটি ‘আমুল হুযন বা শোকের বছর’ নামে পরিচিত।
আরবের সেই ঘোর অন্ধকারে কিভাবে এক নারী নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়তে ঈমান এনেছিলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় ছিল না। সেই ওহি নাযিলের প্রথম দিনটি, ওরাকার কাছে গমন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয়তমা খাদিজা রা.-এর স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়িতে যখনই কোনো পশু জবাই হয়, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দেন। হযরত আয়েশা রা. বলেন, যদিও আমি খাদিজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় এমনটি হতো না। কারণ, আল্লাহর রাসূল সব সময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।
খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। রাসূলুল্লাহ তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে উঠলেন, হালা এসেছ?
রাসূলুল্লাহর মানসপটে তখন খাদিজার স্মৃতি ভেসে উঠে।
আয়েশা রা. বলেই ফেললেন, আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন। আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।
আল্লাহর রাসূল বললেন, কক্ষনো না। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফের ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে…।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্যে হযরত খাদিজাতুল কুবরা রা.-এর স্থান সবার উপরে। তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর কোনো বিয়ে করেননি। ইবরাহিম ছাড়া আল্লাহর রাসূলের সব সন্তানই তার গর্ভে জন্ম হয়েছেন। এছাড়া সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অমলিন হয়ে থাকবে।
[তথ্যসূত্র : সীরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৮৮, ১৮৯, ১৯২;
আল-ইসাবা : ৪/২৮১, ২৮৩; তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়া : ১/৬৪; হায়াতুস সাহাবা : ২/৬৫২; বুখারী, ১ম খ-; তাবাকাত : ৩/৭৪০, ৮/১০]
● অক্টোবর ২০১৭, মাসিকপাথেয়