হাফিজ ভাইয়ের ধৈর্য

হাফিজ ভাইয়ের ধৈর্য

হাফিজ ভাইয়ের ধৈর্য

আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ ● তখন আমি ঢাকা শহরে একদম নতুন। কিছুই চিনি না। আমার কোন পরিচিত মানুষও নেই। এ কারণে ঘরের ভিতর একা একা বসে থাকি। পড়াশোনা করার জন্য এসেছি। পড়াশোনা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে ঢাকা শহরে নামীদামী চাকরি পাওয়া যায়। হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা বেতন। আমি লাখ লাখ টাকা কামানের স্বপ্নে পুরোদমে পড়াশোনায় লেগে গেলাম। আমার পাশের সিটে থাকতেন হাফিজ ভাই। খুব ভালো মানুষ। মানুষের উপকার করার জন্য সারাক্ষণ ব্যাকুল থাকতেন। কখন কার কি উপকার করবেন সে জন্য নিজেই জিগ্যেস করতেন। আমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজের থেকে কাপড় চোপড় ধুয়ে দিতেন। বড় ধরনের কোন অসুখ হলে অভয় দিতেন। বি পজেটিভ রক্তের অধিকারী হাফিজ ভাই ভালোমতো খাওয়া দাওয়া করতেন যাতে করে অন্য আরেকজনকে ফ্রেশ এবং ভালো রক্ত দিতে পারেন। আমরা খুব অবাক হতাম।

মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা চাকরি খুঁজতেছেন, কিন্তু কোথাও চাকরি হয় না। বাপ-মায়ের তরফ থেকে হাফিজ ভাইয়ের প্রতি টাকা পয়সার কোন আবদার নেই। হাফিজ ভাইয়ের বড় দুইভাই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন। বড়ভাই দুইটা হাফিজ ভাইয়ের প্রতি দারুণ সন্তুষ্টি কারণ হাফিজ ভাই তার দুই ভাবির মন কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাড়ি গেলে সমস্ত কাপড় চোপড় হাফিজ ভাই ধুয়ে দিতেন। ভাবিদের জামা কাপড়, ছোট তিনটা ভাতিজা সাথে বাবা মার কাপড় চোপড় তো আছেই। ভাবিদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে ভাইয়েরা থাকবে খুশি। যদিও এসবের কিছুই হাফিজ ভাইয়ের মধ্যে ছিলো না। নিঃস্বার্থ একজন মানুষ। যতদিন হাফিজ ভাই আমাদের মধ্যে ছিলেন ততদিন এমনটাই দেখেছি।

এরপরে একদিন হাফিজ ভাইয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেলো। তিন বছর ঘুরাঘুরির পরে চাকরি। তবে চাকরিটা আরো আগে হয়ে যেতো যদি একটু মালপানি ছাড়তেন। এ নিয়ে হাফিজ ভাইয়ের সাথে অনেক তর্ক হয়েছে কিন্তু হাফিজ ভাই আমার পিঠে হাত রেখে বলতেন, মিয়া, আমার যোগ্যতা কি আল্লাহ পাক কম দিছেন? প্রত্যেকটা পরীক্ষায় এ প্লাস এ প্লাস এ প্লাস সুতরাং আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে যাবো কেন?

আমি লিংক-মিংক ধরার কথা বলেছিলাম, হাফিজ ভাই সেটাকেও নাকচ করে দিয়েছিলেন। শেষমেষ অবশ্য লিংকের মাধ্যমেই হাফিজ ভাইয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি হয়েছিল। ধুমধাম করে আমি নিজের উদ্যোগ হাফিজ ভাইয়ের হয়ে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায় ছিলাম। হাফিজ ভাই যখন জয়েন লেটারটা দেখিয়েছিলেন তখন আমি বলেছিলাম, দিনদিন বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হয়ে যাচ্ছে যেখানে বিশ হাজার টাকার উপরের লেভেলের চাকরিগুলোর জন্য ঘুষ বাধ্যতামূলক হয়ে যাচ্ছে। আজকাল যতই ডিগ্রি থাকুক। কোন কাজ হবে না। সুতরাং এ দেশের মানুষগুলো সৎ হবে কেমনে? আগামী প্রজন্ম সব হবে অসৎ। ঘুষের টাকায় স্মার্ট মানুষ হয় কিন্তু গর্ব করার মতো মানুষ হয় না। সৎ মানুষ হয় না। কতগুলো ব্যর্থ মানুষ হয় তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ঢাকতেই ব্যস্ত জনগণকে সময় দেবে কখন?

হাফিজ ভাই সেদিন আমার দিকে চোখ দুইটা বড়বড় করে তাকিয়েছিলেন। অবাক হয়ে বলেছিলেন, তুই এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারিস? সত্যিই আমি জানতাম না। ভবিষ্যতে তুই মহাত্ম গান্ধী কিম্বা বঙ্গবন্ধু যদি হয়ে যাস, তাহলে আমি অবাক হবো না। আমি হাফিজ ভাইয়ের কথা শুনে হা হা করে হাসলাম।

এরপর হাফিজ ভাই আমাদের সাথে আর বেশিদিন থাকেননি। মতিঝিলে তিন রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। ওখান থেকে অফিস একেবারে কাছে। বাবা মাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিলেন। দুই ভাবি হাফিজ ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন এবং মেয়েও পেয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় মেয়ের টেম্পারেচার শেষ। হাফিজ ভাই সুখী হতে পারলেন না। মেয়ের ব্লাড ক্যান্সার ছিল। সেটা তার পরিবার বিয়ের সময় গোপন করে রেখেছিল। মেয়ের পরিবার চিকিৎসা করানোর জন্য এতো টাকা খরচ করতে রাজি ছিল না। চেহারা সুরত ভালো ছিল। এই কারণে হাফিজ ভাইয়ের এতো কিছু ভাবারও সময় ছিল না। হাফিজ ভাইয়ের বউটা যেদিন মারা গেলো সেদিন মেয়েদের পরিবার নিয়ে অনেক কানাঘুঁষা হয়েছিল। হাফিজ ভাইয়ের শ্বশুর এবং শ্বাশুড়িকে ছোটলোক এবং বাটপার বলে অপমান করে। মৃত্যু মেয়ের চেহারা দেখতে দেয়া হয়নি। কবরে নামানোর সময় শ্বশুর মশাই হাফিজ ভাইয়ের পা ধরো চিৎকার শুরু করেছিল, বাজান, মাত্র একবার দেখবো মেয়েটার মুখ মাত্র একবার। হাফিজ ভাইয়ের অনুরোধে মেয়ের মুখ দেখানো হয়েছিল। এলাকাবাসী অবশ্য রাজি হয়নি। এ জন্য হাফিজ ভাইকে সবার সাথে অনেক চেঁচামেচি করতে হয়েছিল।

আমি অবশ্য এতোকিছু জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম হাফিজ ভাই যেহেতু বাইরের পৃথিবীর একজন মানুষ, সুতরাং তিনিও ঐ একই আওতায় পড়েন। হাউস টিউটরের কাছে আমার বাটন ফোনটা জমা দিয়ে রেখেছিলাম। উনি খুব অবাক হয়েছিলেন। আমি বললাম, স্যার, এই ফোনটা শুধু বাড়ির সাথে যোগাযোগ করার জন্য। মোবাইল পড়ালেখায় ক্ষতি করে এই কারণে আপনার কাছে জমা দিলাম। আমি একজন বড় মানুষ হতে চাই। স্যার কি যে খুশি হয়েছিলেন তা বলার বাহিরে। আমার কোন বন্ধু নেই। ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত পাওয়ারফুল একজন বড়ভাইকে ধর্মের ভাই ডেকে বলেছিলাম, ভাই, আমি এখানে পড়ালেখা করতে এসেছি। এর বাইরে আমি কিছু করতে চাই না। আপনি আমাকে এ দিক দিয়ে একটু হেল্প করবেন। তিনি সানন্দে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। আমার মাস্টার্স কমপ্লিট করার পরে যখন চাকরিতে ঢুকলাম। তখন সেই বড়ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনি। দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা গিয়েছিলেন। আমি সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিলাম এবং পরেরদিন তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম তার কবরে ফাতেহা পাঠ করার জন্য। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি। যাক, মূল গল্পে ফিরে যাই।

একদিন মধুর ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলাম, তখন কাকতালীয়ভাবে হাফিজ ভাইয়ের সাথে দেখা। উনি আমার সামনের টেবিলে একজন হুজুরের সাথে গল্প করছিলেন তখন আমি নিজে থেকেই যেয়ে সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দিয়েছিলাম। হাফিজ ভাই তখন যে কি খুশি হয়েছিলেন। মধুর ক্যান্টিনে খাওয়ার পরে বিল দেয়ার নিয়ম নেই তা না হলে হাফিজ ভাই-ই বিল দিয়ে দিতেন। হাফিজ ভাই খুশি হয়েছিলেন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এই সংবাদটা শুনে। হাফিজ ভাইয়ের সাথে যে হুজুরটা ছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

একই সাথে পড়াশোনা করেছেন এই কারণে দেখা করতে এসেছেন। অধ্যাপক সাহেব চলে যাওয়ার পরে হাফিজ ভাইয়ের সাথে অনেক কথা হলো, বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী ট্রাজেডি নিয়েও কথা হলো।
– আমি বললাম, আর বিয়ে করবেন না ভাই?
– বিরসমুখে হাফিজ ভাই বললেন, না, আর বিয়ে করবো না। তোর ভাবি যেদিন স্বপ্নে আরেকটা বিয়ে করতে বলবে এবং তার মতো একটা মেয়ের সন্ধান দিবে সেদিন বিয়ে করবো।
– ভাবি মানে?
– যিনি মারা গিয়েছেন।
– আমি অবাক হয়ে বললাম, তার পরিবার তো ধোঁকাবাজি করেছে আপনার সাথে।
– হাফিজ ভাই বললেন, তার পরিবার ধোঁকাবাজি করেছে কিন্তু সে তো করেনি। সে বিয়েতে রাজি ছিল না। বলেছিল, যেদিন তার ব্লাড ক্যান্সার ভালো হবে সেদিন সে বিয়ে করবে। অন্য একটা ছেলেকে কিম্বা তার পরিবারকে ঠগাতে পারবে না। তবে তার পরিবার এই কথা শুনেনি। উল্টো তার বড়ভাই রাগ হয়ে বলেছিল, আর কতদিন আমাদের ঘাড়ে বসে খাবি। নিজে কামাই করলে বুঝতি। তোর পিছনে প্রতিদিন আমাদের কত টাকা খরচ হয় সেটা কি জানিস তুই? চাপা গলায় মেয়ের মেজো ভাবি বলেছিল, বেশ্যা জানি কোনানকার। এতো বড় হয়েছে তারপরেও বিয়েতে মন নেই।

এই কথা শুনে সারারাত সে কেঁদেছিল। আত্নহত্যা করার কথা ভেবেছিলো কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ এই কারণে সাহস পায়নি। পরেরদিন বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। বাসর রাতে যখন ঢুকলাম তখন দেখি তোর ভাবি কাঁদছে। কান্নার কারন জিগ্যেস করতেই বললো, আমি বেশিদিন বাঁচবো না। আমার বড় ধরনের একটা অসুখ হয়েছে। আমার জন্য আপনার অনেক টাকা খরচ হবে। এতো টাকা কি আপনার কাছে আছে। আমি মুখ চেপে ধরলাম। কি সব অলক্ষুনে কথা বলছো? যে আল্লাহ আমারে খাওয়ায় পরায় তিনি কি তোমাকে খাওয়াতে পরাতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। সেদিন রাতটাই মাটি হয়ে গেলো। অবুঝের মতো তোর ভাবির সামনে হেঁচকি দিয়ে কান্নাকাটি করলাম। কিছুই ভালো লাগে না। বিয়ের এক মাসের মাথায় তোর ভাবিকে পিজিতে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার একপাশে ডেকে নিয়ে বললো, ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।

আমি বিচলিত হলাম না। রোগ দেয়ার মালিক আল্লাহ, আবার তিনিই রোগ নেয়ার মালিক তবে মাঝখানে আমাদের প্রচেষ্টা করতে হবে। বড় ভাবিকে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি আমাকে নগদ একলাখ টাকা দিলেন আর আমার কাছে ছিলো দুইলাখ। তিনলাখ টাকা তোর ভাবির হাতে দিয়ে বললাম, মন খারাপের কিছুই নেই। কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ। প্রত্যেকদিন কোনমতে অফিস করে ছুটতে হয় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আমার শ্বাশুড়ি একদিন আমাকে শাসনের সুরে বলে বসলেন, আমার মেয়ের চিকিৎসা কি ঠিকঠাক মতো হচ্ছে? আমি বিনয়ের সাথে বললাম, জ্বী আম্মা আল্লাহ পাকের রহমতে হচ্ছে। আমি যতটা বিনয়ী হলাম তোর ভাবি ততোটা হলো না। রেগেমেগে বললো, বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এখন বেচারাকে ধমকাও না? শাসন করো? আল্লাহ পাক তোমাদের এই জুলুমের বিচার অবশ্যই দুনিয়াতে করবেন।

আমি তোর ভাবির হাত ধরে বললাম, ছি, মাকে এসব বলতে নেই। সব তো আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। মাফ চাও প্লিজ।

তোর ভাবির প্রচন্ড অসুস্থতার সময়েও আমাকে আনন্দিত করার ব্যবস্থা সে করে রাখতো। আমাকে তোর ভাবি নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিতো। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলতো, আমারে নিয়ে এতো কষ্ট করেন ক্যা? আমি বলতাম, কই, কষ্ট হচ্ছে কে বললো? আল্লাহ পাক আমাকে অনেক সুখে রেখেছেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা তোর ভাবিকে দেখতে পিজিতে গিয়েছি তখন আমার হাতটা ধরে বললো, একটা কথা বলি রাগ করবেন না কিন্তু? বলেন, রাগ করবেন কি না?

বেচারীকে আনন্দে রাখার জন্য বললাম, না রাগ করবো না। তুমি বলো। তখন তোর ভাবি কি বললো জানিস? বললো, সুন্দর দেখে একটা মেয়েকে বিবাহ করেন। আমি আপনাকে সন্তুষ্ট দেখে পৃথিবী থেকে যেতে চাই।

আমি এমন কথা শুনে তোর ভাবির মুখ চেপে ধরলাম। বললাম, তোমার মতো সেইম একটা মেয়ে যদি খুঁজে দিতে পারো তাহলে বিয়ে করবো। দিতে পারবে? কালো হোক কিম্বা ধলা হোক তাতে সমস্যা নেই। যদি পারো তাহলে সামনে থেকে এই কথা বলবা, তা না হলে বলবে না, আমি মন খারাপ করবো কিন্তু। তোর ভাবি তখন চুপ করে যেতো। ওর সামনে যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ শুধু হাসতাম। ওকে আনন্দে রাখতে চাইতাম। এরকম হাসি ছয়মাস হাসতে পেরেছিলাম তারপর সব শেষ। আহা রে, আল্লাহ পাক এতো সুন্দর মনের একটা মেয়েকে আমার থেকে কেড়ে নিলেন। আমার মোট খরচ হয়েছিল ত্রিশ লাখ।

আমার মন কি বলে জানিস, যদি তার জন্য আরও ত্রিশ লাখ খরচ করতে পারতাম তাহলে মনকে শান্তি দিতে পারতাম। মধুর ক্যান্টিনে সেদিন আমি আর হাফিজ ভাই একসাথে কেঁদেছিলাম। এরকম কেউ কোনদিন মধুর ক্যান্টিনে কেঁদেছে বলে মনে হয় না। আমরাই প্রথম এবং আমরাই শেষ। এরকম কেউ আর না কাঁদুক সেটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু হাফিজ ভাইয়ের কারণে করা গেলো না। আমার মাস্টার্স সমাবর্তন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ বাকি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি। আমার পাহাড়সম ব্যস্ততা। এরইমধ্যে হাফিজ ভাই আমার মোবাইলে কল দিলেন। বিকালবেলা হাউস টিউটর স্যার আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, হাফিজ নামের একজন তোমাকে কল করেছিল। কি একটা ইমার্জেন্সি কথা নাকি আছে তোমার সাথে। মধুর ক্যান্টিনে আলাপের পর এক বছর ধরে কোন যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করে কেন আমাকে মনে পড়লো কে জানে। আমি প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে ফোন দিলাম। হাফিজ ভাই বললেন, আগামী সপ্তাহে আমার একজন ক্লোজ বন্ধুর বোনের বিয়ে। বর আমি খুঁজে বের করেছি। ভালো ছেলে।

আমি যেহেতু ঘটক, সুতরাং বিয়েতে আমার থাকা লাগবেই লাগবে। কোনদিন কারো বিয়েতে যাইনি। আমার সাথে তুই কি যাবি? তোর পড়ালেখায় যাতে করে ক্ষতি না হয় এই কারণে তোকে এক বছর ধরে ফোন দেইনি। আগামী সপ্তাহে তোর মাস্টার্স সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এখন তো পড়াশোনার চাপ নেই সেই কারণে তোকে ফোন দিলাম। আমি সমস্ত কিছুর খোঁজখবর রাখি। আমার সাথে যাবি ভাই? এমনভাবে আবদার করলেন, আমার চোখটা ভিজে উঠলো। আমি বললাম, অবশ্যই যাবো হাফিজ ভাই।

বিয়েতে গিয়েছি হাফিজ ভাইয়ের সাথে। যার সাথেই দেখা হয় তার কাছে আমার পরিচয়টা দিচ্ছিলেন এভাবে, আমার ছোটভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় মেধাবী ছাত্র। আমি তো লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে একজন নিপাট ভদ্রলোক। আমার বেশ পছন্দ হলো। ছেলের সামনে তার বাবা বসা। বড় বড় দাড়ি। তাকে কেন জানি শুরু থেকেই পছন্দ হয়নি। বিয়েতে দুই একজন এরকম অপছন্দের মানুষ থাকেই। এরা বিয়ে ভেঙে দিতে পাকা। রেডি হয়েই আসে।

বিয়ে হবে ইসলামি রীতিমতো। ইমাম সাহেব ছেলের সম্মতি এবং মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সম্মতি নিয়ে আরবীতে খুতবা দিলেন। খুতবা পড়া শেষ হতেই ছেলে সামনে বসা তার বাবা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, এই বিয়ে হয়নি। বিয়েতে দুই ধরনের চিৎকার আছে। একটা হলো, তরকারিতে ঝাল বেশি হয়েছে কেন সেটার জন্য চিৎকার। দ্বিতীয় চিৎকারটা হলো, বিয়ে ভেঙে দেওয়ার চিৎকার। ছেলের বাবার চিৎকার দেয়ার কারণ, মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সম্মতিতে কোন কাজ হবে না। মেয়ের নিজের থেকে সম্মতি আনতে হবে। হাফিজ ভাই বললেন, এটা তো ইসলামি রীতিমতো বিবাহ। মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সাক্ষীটাই মেইন। মেয়ের সামনে যাবেন কেন? পর্দা বলে তো কিছু আছে, তাই না?

আর যায় কোথায়। যে যেভাবে পারলো হাফিজ ভাইকে অপমান করলো। যাচ্ছে তাই অপমান। ছেলে পক্ষের একজন বললো, শালা বাইনচোদ। আরেকজন বললো, খানকির পোলা। আরেকজন ভদ্রভাবে বললো, বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য এসব উপদ্রব কোথা থেকে আসে? ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত। জামাই ছেলেটা অসহায়। হাফিজ ভাইয়ের পক্ষ নিতে গেলে যদি বাপের ধমক খাওয়া লাগে এই কারণে হাফিজ ভাইয়ের কাছে মাফ চাওয়া তো দূরের কথা। একবার ফিরেও তাকালো না। হাফিজ ভাই আজীবন চুপচাপ ছিলেন আজকেও তার ব্যত্যয় হলো না। মাথাটা নীচু করে আমাকে নিয়ে বের হয়ে আসলেন।

আমাকে বললেন, তুই কি আমার সাথে যাবি নাকি আলাদা যাবি? আলাদাই চলে যা। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার মতো অপদার্থটাকে পারলে মাফ করে দিস। আমি বললাম, এসব কি বলছেন ভাই? মাফ করার প্রসঙ্গ কেন আসছে? খারাপ ব্যবহার তো ওরাই করছে। আপনি তো ইসলামের সঠিক ম্যাসেজটাই দিয়েছেন। আল্লাহ পাক যেন ওদের প্রত্যেকেরই বিচার করেন। এর প্রভাব যেনো ওদের অনাগত বাচ্চাটার উপরেও পড়ে। হাফিজ ভাই সাথে সাথে আমার মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, ছি, ছি, তুই এমন কথা কেমনে বলতে পারলি? মানুষকে ক্ষমা করতে শিখ। মানুষকে ক্ষমা করার মধ্যেও আলাদা আনন্দ আছে। ক্ষমা করতে করতে একটা সময় তুই মহৎ মানুষ হিসেবে সমাজে সমাদর পাবি। আমি তোকে অনেক বড় একজন মহৎ মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। আমার এই চাওয়াটা কি তুই পূরণ করতে পারবি? কথা দে।

আমি চুপ—

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *