হুমায়ুন আহমেদ: প্রতিহিংসার ধর্মে ‘নাস্তিক’ খেতাবপ্রাপ্ত একজন লেখক

হুমায়ুন আহমেদ: প্রতিহিংসার ধর্মে ‘নাস্তিক’ খেতাবপ্রাপ্ত একজন লেখক

  •  তামীম আব্দুল্লাহ  

হুমায়ুন আহমেদ। বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তার জীবদ্দশায় মানুষের চিরায়ত জীবন নিয়ে লিখেছেন হাত খুলে। মানুষের এই জীবনের এত বৈচিত্রতা তার লেখায় পাঠকেরা পেয়েছে তাদের নিজেকে। এবং তার লেখাকে যেন নিয়েছে আপন করে। তার মৃত্যুর আজ এতো বছর পরেও তিনি যেন আছেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনেরই আশেপাশে। অনেকে তাকে রহস্য মানবও বলেন। তার একটা কারণ এমন উল্লেখ করা হয় যে, তিনি লেখেন সামাজিক জীবনযাপন নিয়ে কিন্তু একরাশ আক্ষেপ রেখে শেষ করেন সে জীবনের কথা। পাঠকের আবেগঘন মনকে যেন কোনো কুর্নিশ করেন না। তার কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই চরিত্র যেন এক মক্ষম উদাহরণ। ততকালীন প্রধানমন্ত্রীকেও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার রচিত মৃত্যুদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত বাকের ভাই চরিত্রকে ফাঁসির কাঠগড়ায় তোলার জন্য। এমন অনেক বিভিন্ন কেচ্ছায় ভরা তার বণাঢ্য জীবন। তাঁকে একটা লম্বা সময় পর্যন্ত মানুষ প্রথম কথাতেই লেখক হুমায়ূন আজাদের সাথে গুলিয়ে ফেলতেন। সময়ের পরিক্রমায় তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে মানুষের আগ্রহ যেন ক্রমশই বেড়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে জানার আগ্রহ। তাকে বোঝার আগ্রহ।

সেই আগ্রহের জায়গা থেকেই বাদে এক তীক্ষ্ণ সমস্যা। তার ধর্ম মতবাদ নিয়েও জাগে মানুষের মনে জাগে প্রবল আগ্রহ। আর লেখকের সেই মতবাদও এক শ্রেণীর পাঠকেরা খুঁজেছেন তার বইয়ে বইয়ে। তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ের প্রথম দিককার সময়ে অনেক পাঠকেরা তাকে নাস্তিক আখ্যায়ও পরিচয় করাতেন। অবশ্য হুমায়ূন আজাদের ক্ষেত্রে নাস্তিকতার বিষয়টা পরিস্কার। তিনি এক বাক্যে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। এবং এরদ্বারা মৌলবাদীদের হাতে খুন হতে হয় বলেই সবাই জানে৷ কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যে নাস্তিক, এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ নিজে কখনো বলেন নি তিনি নাস্তিক। বরং তার আত্মজীবনীমূলক লেখায় তাকে বারংবার ইসলাম ধর্মের সাথে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এখানে অনেকেই মনে করে— লেখক তার ডজনখানেক উপন্যাসে ধর্মকে ছোট করা কিবা ধর্মবিদ্বেষ ও ধর্মবিশ্বাসীদের তুচ্ছ করে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তাকে কোনো ধর্ম বা ইসলামের মতো সার্বজনীন এক ধর্মের সাথে সম্পৃক্ততার কথা বলা নিতান্তই বোকামি। আর লেখকেরা তাদের লেখার মাধ্যমেই তার নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। তার চিন্তা-ভাবনার ও চেতনার ফলই লেখা। একজন লেখককে তার লেখা বইয়ের মাধ্যমে জাস্টিফাই-ই যদি না করা যায় তাহলে তাকে জনপ্রিয় বা সার্বজনীন লেখক হিসেবে কিভাবে পরিচয় দেয়া হয়?

এখানে কিছু আলোচনা করে এ ব্যাপারে কিছু সুরাহা করা যায়। কিন্তু আগে একটা বিষয় ভেঙে বলা দরকার। প্রথমত, একজন লেখক তার লেখার মাধ্যমেই সমাজের বুকে দাগ আঁকেন। তবে লেখকের সব লেখায় যে সমাজ শুধু উন্নতির মুখ দেখবে ব্যাপারটা এমন নয়। বইকে নানানভাবে নানান ক্যটাগরীতে বিভক্ত আছে। এক বই থেকে পুরো দুনিয়াকে শুদ্ধ করার ক্ষমতা বা জানার উপায় মনে করা ঠিক নয়৷ সে হিসেবে একজন কথাসাহিত্যিকের থেকে তার সব লেখায় সমাজের বিস্তর উন্নতি কামনাও ঠিক। প্রত্যেক পাঁচ বছরে সরকারের পালাবদলেও তো একটা দেশকে উন্নত করা যায় না। অনেক দেশে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে একক সরকারের অধীনে উন্নতির নামে যে নিরব ধাপ্পাবাজি চলে আসছে সেখানেও তো উন্নতি বা ব্যাপক সংস্কারের মুখ দেখা কষ্টকর। সে হিসেবে একজন লেখক থেকে তার এক লেখা থেকেই সমাজের চতুর্মুখী কামনা বোকামী অথবা অগ্রহণযোগ্য পাঠক বলতে দ্বিধা নেই।

প্রশ্নটি ছিল: ‘এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ হুমায়ূন আহমেদের সাবলীল উত্তর: “আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে যাঁরা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার না। এরা কেন জানি ইসলাম ধর্মকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

দ্বিতীয়ত, একজন লেখকের মতাদর্শের পূর্ণ প্রভাব পাওয়া সম্ভব তার আত্মজীবনীমূলক বইয়ে। অথবা তার ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে। তার রচিত উপন্যাস বা গল্পে লেখকের পূর্ণ মতাদর্শ বোঝ সম্ভবপর নয়। সেখানে একেকটা চরিত্রের জন্যে লেখক নানান বিষয়, প্রেক্ষাপট তুলে এনে তাকে নানানরূপে সাজানোর ক্ষমতা রাখেন। লেখক নিজেই স্থান-কাল, পাত্র ভেদে একেক চরিত্রের মধ্যে হাজার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছেন। সেখানে আবার লেখকের মতাদর্শ খোঁজা যেন সাগরে সুঁই খোঁজার সমান। সেই হিসেব মোতাবেক লেখককে জানতে বা তার জীবন, দর্শনকে বুঝতে তাঁর আত্মজীবনীকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। বর্তমান সময়ে যেহেতু এই ধরণীতে লেখকের অবস্থান নেই। তাই তার আত্মজীবনী ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই তার দর্শনকে বোঝার সহজ উপায়। আর আমাদের আলোচনায় তার ধর্ম মতকে বোঝার সহজ উপায়।

লেখকের নিজের আত্মজীবনী লেখা থেকে—

‘আমি এসেছি অতি কঠিন গোড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি ‘মৌলবিবাড়ি’ নামে এখনো পরিচিত। [ফাউন্টেনপেন: ১৯]’

দাদার কাছে লেখা হুমায়ুন আহমেদের মায়ের একটি চিঠির অংশ- ‘…বাচ্চুর (হুমায়ুন আহমেদের ডাকনাম) পরীক্ষা মে মাসে। সে আপনার কথা শুনে। তাকে বুঝায়ে পত্র দেন। যাতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেয়। আর যাতে নামাজ পড়ে সে জন্য উপদেশ দেন। [আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলি: ৩৯৪]

’হুমায়ুন লিখেন, ‘ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, শাহজালাল (রহঃ)–এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মাখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। [ফাউন্টেনপেন: ২২]’

তিনি মাজারে যেতেন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে। ধর্মের নামে বেদাত তাঁর অপছন্দ ছিল। এটা তাঁর দাদারও নিষেধ ছিল। ইমদাদুল হক মিলনের ‘মৃত ব্যক্তির অলৌকিক শক্তিতে তিনি বিশ্বাসী কি না?’ এরকম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়। [স্বপ্নপূরণ, মাসিক পত্রিকা]

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান অন্য যেকোনো ধর্মের প্রায় সব উৎসবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেন, বক্তৃতা করেন, বাণী দেন- কিন্তু ইসলামি কোনো জলসায় কেউ উপস্থিত থেকেছেন বলে শোনা যায় না। তাদের মতে, ইসলামি জলসায় কেউ উপস্থিত থাকা মানে তার বুদ্ধিবৃত্তিও নিম্নমানের। সে একজন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক লোক। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অর্থ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, প্রগতির চর্চা করা, সংস্কারমুক্ত হওয়া ইত্যাদি। প্রফেসর সালাম ঢাকায় এসে যখন বক্তৃতার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বললেন, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা হকচকিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে প্রগতিশীল হওয়া, বুদ্ধিজীবী হওয়া, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানেই ইসলামবিরোধী হতে হবে। তাদের কাছে রামকৃষ্ণের বাণী, যিশুর বাণী সবই গ্রহণীয়। এসব তারা উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করেন; কিন্তু হজরত মোহাম্মদের বাণী কখনো তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না। তাদের কাছে হজরত মোহাম্মদের বাণী গ্রহণযোগ্য নয়।

আমার মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঔপন্যাসিক যাঁর কোটের পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তার নাম দস্তয়ভস্কি। আরেকজন আছেন মহামতি টলস্টয়। এক রেলস্টেশনে যখন টলস্টয় মারা গেলেন, তখন তাঁর ওভারকোটের পকেটে একটি বই পাওয়া গেছে, তার নাম Sayings of Prophet। বইটি ছিল টলস্টয়ের খুব প্রিয়। সব সময় সঙ্গে রাখতেন। সময় পেলেই পড়তেন। বইটিতে হজরত মোহাম্মদ সা:-এর বিভিন্ন সময়ে বলা ইন্টারেস্টিং কথাগুলো গ্রন্থিত। আমি বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাইছি, আপনাদের ক’জন বইটি পড়েছেন? টলস্টয় যে বইটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেই বই আমাদের প্রত্যেকের একবার কি পড়া উচিত নয়? আমার মতে, প্রতিটি শিক্ষিত ছেলেমেয়ের বইটি পড়া উচিত।[১২ নভেম্বর ২০১৫, দৈনিক নয়াদিগন্ত ]’

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর বিভিন্ন লেখায় মাঝেমাঝে কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে দ্বিধা করেননি। যা বলতে চেয়াছেন তা স্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে আলোচনার পর তিনি লিখেন, ‘আমি কোন ভুল করেছি এরকম মনে হয় না, তারপরেও এই বিষয়ে জ্ঞানী আলেমদের বক্তব্য আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনব। [ফাউন্টেনপেন: ৭২]’

‘আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরণসঙ্গীত’- ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি। শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছে- ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ ‘নক্ষত্রের রাত’ নামের ধারাবাহিক নাটকের শুটিং ফ্লোরে আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এবং একজনকে দায়িত্ব দিলাম গানটি বিশেষ সময়ে গাইতে। সে রাজি হলো। উৎসর্গপত্রের মাধ্যমে তাকে ঘটনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা সময় এসে গেছে।

মেহের আফরোজ শাওন’ [চলে যায় বসন্তের দিন, হুমায়ূন আহমেদ, ২০০২, উৎসর্গপত্র]

এই উৎসর্গপত্রের সাথে আমাদের আলোচনার কোনো মিল নেই। তবে তিনি যে সংগীতের কথা বলছেন সেই সংগীতে সুফিয়ানা আছে। আর সুফিয়ানা মনোভাব আমাদের ইসলাম ধর্মেরই সুরের এক অংশ। জালালুদ্দিন রুমি। তিনিও সুফি ঘরানার মানুষ ছিলেন।

হুমায়ূন-শাওনের শেষ আনন্দময় গানের আসরটি বসেছিল মেরীল্যান্ডের এক বাসায়। শ্রোতা ছিলেন প্রবাসী লেখক মুনিয়া মাহমুদ ও তাঁর স্বামী নুরুদ্দিন মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার বন্ধু ফানসু মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না ভাবি, গৃহকর্তা নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া, প্রবাসী পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পছন্দের গানগুলোর ইতিহাস বলছেন এবং পরক্ষণেই তাঁর টেপরেকর্ডার, আমি, সেই গানটি গেয়ে শোনাচ্ছি। ১৯০৫ সালে রেকর্ডকৃত প্রথম গান নিধুবাবুর টপ্পা, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান এবং হুমায়ূন সঙ্গীত হলো। আমাদের প্রায় সব গানের আসর মৃত্যুসংগীত দিয়ে শেষ হলেও হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই বিশেষ গানটি আমি গাইতে চাইতাম না।

‘পাঠকের যেমন মৃত্যু হয়, শ্রোতারও মৃত্যু হয়। অতি প্রিয় গান একসময় আর প্রিয় থাকে না। তবে কিছু গান আছে কখনও তার আবেদন হারায় না। আমার কাছে মরমি কবি গিয়াসউদ্দিনের একটি গান সে রকম। ওল্ড ফুলস ক্লাবের প্রতিটি আসরে একসময় এই গান গীত হতো। শাওনের প্রবল আপত্তির কারণে এই গান এখন আর গীত হয় না। গানটির শুরুর পঙ্ক্তি-

মরিলে কান্দিস না আমার দায়
ও জাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ [নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, হুমায়ূন আহমেদ, পৃষ্ঠা-৫৯]

এবং লেখকের কিছু সাক্ষাৎকার আর শেষ কিছু বিষয় এমন ছিলো—

একজন সাংবাদিক তাঁকে একটি প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নটি ছিল: ‘এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ হুমায়ূন আহমেদের সাবলীল উত্তর: “আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে যাঁরা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার না। এরা কেন জানি ইসলাম ধর্মকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে চিকিৎসা করাতে এসে নিয়মিত নামাজ পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়ায় উৎসাহিত করেন তার ভায়রা (গুলতেকিনের ফুপাতো বোনের স্বামী) জামাল আবেদীন খোকা। জামাল আবেদীন হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়ার জন্য একটি জায়নামাজ এবং তসবি কিনে উপহার দিয়েছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনাবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ নামাজ আদায় করতে শুরু করেন এবং এক সময় নিয়মিত (৫ ওয়াক্ত) নামাজ আদায় করতেন। এ কথা জানিয়েছেন জামাল আবেদীন খোকা।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার তেমন পছন্দের কোনো জীবনী নেই। জীবনীগুলোর মধ্যে ভক্তি চূড়ান্তভাবে বেশি। আমার ‘নবীজী’ লেখার মধ্যেও ভক্তি থাকবে। কিন্তু একটু অন্যভাবে থাকবে এবং আরো কিছু ব্যাপার থাকবে। [২১ শে অক্টোবর, ২০১১; শিলালিপি]  

মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কে হুমায়ুন আহমেদের সেই শেষ গানের (মরিলে কান্দিস না আমার দায়) আসরটির ভিডিও পাওয়া যায় ইউটিউবে। সেখানে দেখা যায়, হুমায়ুন শাওনের দিকে ইঙ্গিত করে দর্শক-শ্রোতাদের বলছেন, ‘এই গানটা সে কখনই গাইতে চাই না। আজকে তাকে রিকুয়েস্ট করব গানটা গাওয়ার জন্য। It is true for each and every one of us. এটা হচ্ছে- আমরা বড় বড় মানুষের কথা শুনলাম, নজরুলের কথা শুনলাম, রবীন্দ্রনাথের কথা শুনলাম, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষরাও যে অসাধারণ গান লিখতে পারেন, অসাধারণ সুর দিতে পারেন এটা কিন্তু- It is a fact…। হুমায়ুন শাওনকে বললেন, Particularly তুমি গানটা শুনায় দাও। শাওন বললেন, এটা লাস্ট বার, হ্যাঁ? হুমায়ুন বললেন, হু। শাওন গাইতে শুরু করলেন- মরিলে কান্দিস না আমার দায়…ও জাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়…। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, হুমায়ুনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। তিনি হাত দিয়ে অশ্রু মুছছেন। গানের শেষেও তিনি টিস্যু দিয়ে অশ্রু মুছে ফেলতে দেখা যায়। একজন বলল, আঙ্কেলের জন্য সবাই নামজ পড়ে দুয়া করবেন, যাতে তিনি আরও ৫০ বছর বেঁচে থাকেন। হুমায়ুন আহমেদ অপারেশনের আগে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপের একটি কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি ডাক্তারকে বললাম, Am I going to die? তারপর তিনি বললেন, Yes. You are going to die আমার তো কলিজা-টলিজা জ্বলছে। তিনি বললেন, Listen, We all are going to die, this why I said, You are going to die. But I will not let you die so so.হুমায়ুন বললেন, এটা ডাক্তারের কথা। মৃত্যু নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই যখন সময় আসবে তখন…। একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক বললেন, (فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ )। হুমায়ুন বললেন, মানে? বৃদ্ধ লোকটি বললেন, শুধু মাত্র যখন সময় আসবে তখনই মৃত্যু হবে এক মুহূর্ত আগেও না, এক মুহূর্ত পরেও না। হুমায়ুন: হ্যাঁ, হ্যাঁ। সূরা বনি ইসরাইলের আরেকটা আয়াত আছে। আমার খুব পছন্দ। সূরা বনি ইসরাইলের আয়তটা হচ্ছে- ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।’ (আয়াতটি দুইবার বললেন তিনি) কাজেই আমাদের ভাগ্যে কী আছে না আছে সবই তো উপরওয়ালা ঠিক করে রেখেছেন। খামোকা আমরা ঝামেলা বাধাইতেছি কেন। শাওন একটি প্রশ্ন করলেন, রিজিক আল্লাহর হাতে, তাহলে আমরা ঘরে বসে থাকি? হুমায়ুন বললেন, মানুষের রিজিক আল্লাহর হাতে ঠিকই, কিন্তু আমাদেরকে রিজিক অর্জন করতে হবে।

হুমায়ুন আহমেদের অসমাপ্ত লেখা ‘নবীজী’ নিয়ে কিছু আলাপ যোগ করতে ইমদাদুল হক মিলনের নেয়া একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এ আলোচনায় থাকতে পারে।

প্রশ্ন : আপনি অনেক দিন ধরে বলছেন যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী আপনি লিখতে চান। সেই লেখার প্রস্তুতিটা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতির কথা বলব, কিন্তু এখানেও কিছু সমস্যা আছে। সমস্যা হলো দুই ধরনের। প্রথম সমস্যা হলো, আমার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষি আছে তো…আমি যখন সব কিছু ঠিকঠাক করলাম, তখন একটা ঘটনা ঘটে। শুরু থেকেই বলি। বাংলাবাজারে অন্যপ্রকাশের একটি স্টল আছে। স্টলটি উদ্বোধনের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক দিন পরে আমি বাংলাবাজারে গেলাম। স্টলের ফিটাটিতা কাটলাম। এক মাওলানা সাহেব প্রার্থনা করলেন। আমি খুবই অবাক হয়ে তাঁর প্রার্থনা শুনলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটি বইপত্র সম্পর্কিত খুবই ভালো ও ভাবুক ধরনের প্রার্থনা। একজন মাওলানা এত সুন্দর করে প্রার্থনা করতে পারেন যে আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। মাওলানা সাহেবকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার প্রার্থনাটা শুনে আমার ভালো লেগেছে।’ মাওলানা সাহেব বললেন, ‘স্যার, আমার জীবনের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হবে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।’ আমি তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হলাম। আমি বললাম, ‘এই আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কেন?’ মাওলানা সাহেব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই কারণ আমি ঠিক করেছি, দেখা হলেই আপনাকে আমি একটা অনুরোধ করব।’

‘কী অনুরোধ শুনি?’

‘আপনার লেখা স্যার এত লোকজন আগ্রহ নিয়ে পড়ে, আপনি যদি আমাদের নবী করিমের জীবনীটা লিখতেন, তাহলে বহু লোক এই লেখাটি আগ্রহ করে পাঠ করত। আপনি খুব সুন্দর করে তাঁর জীবনী লিখতে পারতেন।’

মাওলানা সাহেব কথাগুলো এত সুন্দর করে বললেন যে আমার মাথার ভেতর একটা ঘোর তৈরি হলো। আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই, আপনার কথাটা আমার খুবই মনে লেগেছে। আমি নবী করিমের জীবনী লিখব।’ এই হলো ফার্স্ট পার্ট। চট করে তো জীবনী লেখা যায় না। এটা একটা জটিল ব্যাপার, কাজটা বড় সেনসেটিভ। এতে কোথাও একটু উনিশ-বিশ হতে দেওয়া যাবে না। লিখতে গিয়ে কোথাও যদি আমি ভুল তথ্য দিয়ে দিই, এটি হবে খুবই বড় অপরাধ। এটা আমাকে লেখা শুরু করতে বাধা দিল।

প্রশ্ন : আপনি কি মহানবীর জীবনী লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, আমি লেখার কাজ শুরু করিনি। আমি অন্যদিন-এর মাসুমকে বললাম, ‘তুমি একটা সুন্দর কাভার তৈরি করে দাও তো। কাভারটা চোখের সামনে থাকুক। তাহলে আমার শুরু করার আগ্রহটা বাড়বে।’ মাসুম খুব চমৎকার একটা কাভার তৈরি করে দিল। বইটার নামও দিলাম_’নবীজী’। তখন একটা ছেলেমানুষি ঢুকে গেল মাথার মধ্যে। ছেলেমানুষিটা হলো, আমি শুনেছি বহু লোক নাকি আমাদের নবীজীকে স্বপ্নে দেখেছেন। কিন্তু আমি তো কখনো তাঁকে স্বপ্নে দেখিনি। আমি ঠিক করলাম, যেদিন নবীজীকে স্বপ্নে দেখব, তার পরদিন থেকে লেখাটা শুরু করব। স্বপ্নে এখন পর্যন্ত তাঁকে দেখিনি। যেহেতু এক ধরনের ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞার ভেতর আছি, সে কারণে লেখাটা শুরু করতে পারিনি। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবু আমি স্বপ্নের অপেক্ষায় আছি।

প্রশ্ন : আপনার প্রস্তুতি কী? মানে পড়াশোনা আর অন্যান্য…।

হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতি ভালো। পড়াশোনা ভালোই করেছি। বইপত্র জোগাড় করতে পেরেছি। বন্ধুরাও বইপত্র সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছেন। কাজেই এখন আমি বলতে পারি যে নবীর জীবনী লেখার জন্য আমার প্রস্তুতি যথেষ্ট হয়েছে।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যেসব জীবনী লেখা হয়েছে, এর মধ্যে আপনার পছন্দের কোনটা?

হুমায়ূন আহমেদ : সত্যি কথা বলতে কি, আমার তেমন পছন্দের কোনো জীবনী নেই। জীবনীগুলোর মধ্যে ভক্তি চূড়ান্তভাবে বেশি। আমার লেখার মধ্যেও ভক্তি থাকবে। কিন্তু একটু অন্যভাবে থাকবে এবং আরো কিছু ব্যাপার থাকবে। [২১ শে অক্টোবর, ২০১১; শিলালিপি]

‘নবীজী’ বইটি লেখার ব্যাপার যে মৌলভী সাহেব আলোচনায় এনেছিলেন তিনি ‘মাসিক মদিনা’র সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ. ছিলেন বলে জানা যায়। বই হিসেবে লেখাটি প্রকাশ না পেলেও আংশিক গল্প হিসেবে ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ বইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

তিনি কি কখনোই আর নবীজীকে দেখেছিলেন কি না আমরা কেউই জানি না। তবে তার ভালো কাজটুকুর প্রতিদান আল্লাহ বৃদ্ধি করুন। আর আমরা তার ধর্ম মত, ধর্মদর্শন কিংবা তার ইসলামী চিন্তাধারাকে এখন কিভাবে দেখবো আর তাকে নাস্তিক হিসেবে কতটুকু জানলাম সেটা পাঠকের বিবেকের কাছেই প্রকাশ করার ইচ্ছা রাখলাম।

 

লেখক,সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *