২০শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ২৭শে শাবান, ১৪৪৪ হিজরি

হৃদয়ের মণিকোঠায় মাদানী পরিবার

ফাইল ছবি

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

মাদানী পরিবারের প্রতি দুর্বলতা ছোটবেলা থেকে। ঢাকার বাইরে যখন ইবতেদায়ী জামাতগুলো পড়েছি, তখন থেকে উস্তাদদের মুখে শুনতাম শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর নাম। অবশ্য সে সময়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বোঝার জ্ঞান ছিল না। শুধু উস্তাদদের মুখে শুনেই হযরত মাদানীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে ছিল। এরপর ঢাকায় এসে যখন জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে ভর্তি হলাম, তখন শাইখুল ইসলাম মাদানী এর নাম বেশী শোনা যেত। বিশেষ করে আল্লামা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) এর কাছে মাদানী পরিবারের কথা বেশী শোনা হত। কেননা তিনি ছিলেন শাইখুল ইসলামের প্রিয়তম শাগরেদ। যে কারণে কাজি সাহেব যখনই কোনো বয়ান-বক্তৃতা করতেন তখনই চলে আসত শাইখুল ইসলাম মাদানীর কথা। অত্যন্ত দরদ, ভক্তি, শ্রদ্ধার সাথে তিনি প্রিয় উস্তাদের নাম উল্লেখ করতেন। আমি কাজি সাহেব হুজুরের মতো এত মাদানীভক্ত মানুষ আর দেখিনি। প্রিয় উস্তাদের প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন প্রেম-ভালোবাসা।

অনেক বছর কাজি সাহেব হুজুরের সোহবতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর অতি নিকটে গিয়েছি। মাঝে মাঝে একান্তে কথা বলার সুযোগও হয়েছে। আবার একবার তো তাঁর সাথে হজের সফর করার সুযোগ হয়েছিল। তো তাঁর সাথে নানান সময়ে সোহবতে থাকার দরুন অনেক কথা শুনেছি। দারুল উলুম দেওবন্দ, দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম এবং শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী এর অনেক কথা তাঁর মোবারক জবান থেকে উঠে এসেছে। মোটকথা হযরত মাদানী এবং ওলামায়ে দেওবন্দের ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর কাছ থেকে শুনে মাদানি পরিবারের প্রতি অসম্ভব ভক্তি-ভালোবাসা জন্মে ছিল।

আমার ছাত্র জীবনে বহুবার ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.) কে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর সেই নুরানী চেহারা এখনো স্মৃতিপটে আঁকা আছে। আমাকে বেশী আকৃষ্ট করেছিল তাঁর বয়ান-বক্তৃতা। উর্দু-হিন্দি মিশ্রিত কথাগুলো হৃদয়ে আঘাত করত। বারবার শুনতে ইচ্ছে করত তাঁর কথাগুলো। একবার জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের মসজিদের দ্বিতল ভবনে খৃষ্টান মিশনারীর মোকাবেলায় স্কুল প্রতিষ্টার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন। সাধারণ শিক্ষিতদের মাঝে দ্বীনের আলো ছড়ানোর এই কৌশলটা আমাকে অভিভূত করেছিল। অবাক হয়ে ছিলাম তাঁর দুর্দশিতা দেখে, অথচ স্কুল খোলার ব্যাপারে আমাদের দেশের আলেমগণের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সে দিন তাঁর এই রাজনৈতিক কলা-কৌশল আমাকে আকৃষ্ট করে ছিল। সে দিন অনেকখানি আন্দাজ করলাম মাদানি পরিবারের রাজনীতি কত সুদুরপ্রসারী।

দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হওয়ার পর মাদানি পরিবারের প্রতি আরো বেশী দুর্বলতা বাড়ল। তাঁদের কর্মযজ্ঞ মানুষকে আকৃষ্ট করবে। তাঁরা হিন্দুস্তানে মানুষের জন্য বিরাম-বিশ্রামহীন কাজ করে যাচ্ছে। ‘মুসলিম ফান্ড’ (ব্যাংক) বিনা সুদে লোন দেওয়া হয়। যেখানে হিন্দু-মুসলিম সকলের জন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। মুসলিম ফান্ডের বহু শাখা খোলা হয়েছে। যারা অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। এমনিভাবে দেওবন্দেই রয়েছে মাদানি আই হসপিটাল, মাদানি টেকনিক্যাল কলেজ, মাদানি মুসাফিরখানা এরকম বিভিন্ন সেবামুলক প্রতিষ্টান তাঁদের রয়েছে।

দেওবন্দ গিয়ে প্রায়ই মাদানি মসজিদে নামাজ পড়তাম। সেটা ছিল মনের টান। খুব ভালো লাগত। আবার ফেদায়ে মিল্লাতের খানকায় যাওয়া পড়ত। তবে মাকবারায়ে কাসেমীতে গেলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তাম। প্রতিদিন বাদ ফজর রুটিন ছিল আমার মাকাবারায়ে কাসেমী জিয়ারতের। সেখানে গিয়ে শাইখুল হিন্দ (রহ.) এবং শাইখুল ইসলাম মাদানী (রহ.) এর শিয়রে গিয়ে দাঁড়াতাম। মনের আবেগে দুআ-দুরুদ পাঠ করতাম। মনে হত বুজুর্গদের ফয়েজে সিক্ত হচ্ছি। এভাবে আরো বেশী দরদ-ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল মাদানি পরিবারের প্রতি।

সাইয়্যেদ মাহমুদ আসআদ মাদানি তখন নওজোয়ান আলেম। তবে পিতা এবং পিতামহের যোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে প্রতীয়মান। তখন থেকেই আন্দাজ করতাম তিনি ফেদায়ে মিল্লাতের জানশীন হবেন। পিতার সাথে মুসলিম মিল্লাতের খেদমতে পুরোপুরি নিয়োজিত দেখেছি তাঁকে। সে সময়ে তিনি ইলেকশন করে ছিলেন। তাছাড়া রাতদিন জনতার সেবায় সময় পার করতেন। পিতার সোহবতে নিজেকে বাপ-দাদার যোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে তৈরী করতে সক্ষম হন।

ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী ২০০৬ সনে ইন্তেকাল করেন। সেই থেকে তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত। ফেদায়ে মিল্লাতের লক্ষ লক্ষ ভুক্তকুল তাঁকেই জানশীন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর মাহমুদ মাদানিও পুরোপুরি পিতার নকশেকদমে পা রেখে চলেছেন। এ যেন অবিকল পিতা এবং পিতামহের ফটোকপির ভুমিকায়। মুসলিম মিল্লাতের খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি এখন মাহমুদ আসআদ মাদানি। পুরো ভারতজুড়ে জমিয়ত মানুষের পাশে। যে কোনো সমস্যায় ছুটে যান সেখানে। এমনকি বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের পাশেও তাঁকে দেখা গেছে। অসহায় রোহিঙ্গাদের খেদমত করে গেছেন তিনি। ভারতে মুসলিমদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার সবসময়। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে বড় অবদান রেখে চলেছেন।

দেশ ও দশের খেদমত করা মাদানি পরিবারের ঐতিহ্য। সেই ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন থেকে এ ধারা অব্যহত রয়েছে। সেসময়ে যেমন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানি জালিম ব্রিটিশের নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করেছিলেন। তাঁর জীবনটাই বাজি রেখেছিলেন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে। আর সে আন্দোলনে তিনি ছিলেন সফল।

শাইখুল ইসলাম মাদানির অবর্তমানে ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী পিতার জানশীন হন। তিনিও পিতার মতো বিশ্ব ইসলামী রেনেঁসার অগ্রদুতের ভুমিকায় ছিলেন। ফেদায়ে মিল্লাতের ইন্তেকালের পর এখন সে স্থান অলংকৃত করে আছেন মাহমুদ আসআদ মাদানী। তিনি হুবহু তাদের অনুগামী। তাঁর প্রতিটি কদম পুর্বসূরীদের মতো ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং পূর্বসূরী মনীষীদের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়।

মাহমুদ মাদানীর হাজারো কর্মযজ্ঞ। যেটা জ্বল জ্বল করছে। তাঁর এসব অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। তবে বড় খুশির খবর এখন। বিশ্বের ১৫ তম প্রভাবশালী ইসলামিক ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। জর্ডান ভিত্তিক রয়্যাল ইসলামিক স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা যথার্থ। তাঁর কর্মের স্বীকৃতি এটা। তাছাড়া বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের কাতারে তিনি উঠে গেলেন। আরো বেড়ে গেল মাদানি পরিবারের ভক্তি-ভালোবাসা। এ যেন মোর হৃদয়ে বেঁধে রাখি। আল্লাহ তাঁদের আরো ইজ্জতওয়ালা বানিয়ে দেন। আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ১৯৮৬ - ২০২২ মাসিক পাথেয় (রেজিঃ ডি.এ. ৬৭৫) | patheo24.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com