নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে এক দশক ধরে বোরো ধানের হেক্টরপ্রতি ফলন চার টনের নিচে থাকলেও এবার তা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক শূন্য ২৫ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ফলন হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৫ টন, যা এর আগে কখনো হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, চলতি বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯০ লাখ ৪১ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। আবাদ লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়েছে। কাটা হয়েছে দেশের প্রায় ৮৭ শতাংশ জমির বোরো ধান। হাওড় অঞ্চলের সাত জেলায় প্রায় শতভাগ ধান কাটা হলেও উত্তরের দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায় সব জমির ধান কাটা এখনো বাকি আছে।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক হিসাবে কর্তনকৃত এলাকায় হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক শূন্য ৫ টন ফলন পাওয়া গেছে। যেসব এলাকায় এখনো ধান কাটা হয়নি, সেখানেও ৪ দশমিক ১ টনের বেশি ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেননা প্রতিবার এসব এলাকায় হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
অনুকূল আবহাওয়া, বড় প্র্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া এবং আবাদের ক্ষেত্রে ধানের জাতের বৈচিত্র্য থাকার কারণে এবার বোরো ধানের হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে বলে জানান ডিএইর মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন। তিনি বলেন, প্রায় সারা দেশে হেক্টরপ্রতি রেকর্ড ফলন হয়েছে। সম্প্রসারণকর্মীদের তৎপরতা ও কৃষকের আগ্রহের পাশাপাশি কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ও সময়মতো উপকরণ দেয়ার প্রভাবেই ফলন ভালো হচ্ছে। সামনের দিনে অনুকূল আবহাওয়া থাকলে ফলন আরো বেশি হতে পারে। আগামী সপ্তাহে সারা দেশের মোট উৎপাদন ও ফলনের চূড়ান্ত হিসাব করা হবে বলেও জানান তিনি।
দেশের কৃষকরা এবার মৌসুমে কেবল প্রথাগত পাঁচ-সাতটি জাতের ওপর নির্ভর না করে ১২-১৪টি জাতের ধান আবাদ করেছেন। বিশেষ করে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ জাতের পরিবর্তে হেক্টরপ্রতি বেশি ফলন দেয়, এমন দুটি পরিপূরক জাতের আবাদ হয়েছে বেশি। এজন্যই এবার বোরো ধানের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এবার রেকর্ড ফলনের পাশাপাশি চাল উৎপাদনেও রেকর্ড হবে। গতবারের তুলনায় চলতি মৌসুমে ১২-১৩ শতাংশ বেশি বোরো চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রসারণকর্মীরা সারা দেশে বোরো আবাদের ক্ষেত্রে জাতের বহুমুখিতা আনতে কাজ করেছেন। এছাড়া ব্রি অঞ্চল ও আবহাওয়া উপযোগী জাত উদ্ভাবনে সচেষ্ট রয়েছে।
দেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বোরো চালের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ব্লাস্টের কারণে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ১ কোটি ৮০ লাখ টনে নেমে আসে। এবার ফলন ও উৎপাদন বেশি হলেও গতবারের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। গত বোরো মৌসুমে মাড়াইয়ের শুরুর দিকে প্রতি মণ ধানের ৭৫০-৮০০ টাকা দাম পেয়েছিলেন কৃষক। কিন্তু এবার দাম পাচ্ছেন ৫০০-৬০০ টাকা। যদিও এবার প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ৯৬০ টাকা। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২৪ ও চাল উৎপাদনে ৩৬ টাকা খরচ হয়েছে কৃষকের। গত বছর ধানের উৎপাদন খরচ ছিল কেজিপ্রতি ২২ ও চালের ৩১ টাকা। কিন্তু ধানের যে দাম তারা পাচ্ছেন, তাতে লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচও উঠবে না।
জানা গেছে, মোকামগুলোয় ক্রেতা না থাকায় ধানের দাম এখনো নিম্নমুখী। ব্যবসায়ীদের কাছে আমদানি চালের সরবরাহ থাকায় তারা বাজার থেকে ধান কেনায় গুরুত্ব কম দিচ্ছেন। আবার সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ কার্যক্রমেও এখনো গতি আসেনি। ফলে কৃষক ভালো দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না।
চলতি বোরো মৌসুমে দেড় লাখ টন ধান এবং আট লাখ টন সেদ্ধ ও এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরের। এজন্য ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযান চালানোর কথা। যদিও চলতি মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত কোনো ধান সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। ১৯ মে পর্যন্ত সরকার চাল সংগ্রহ করেছে মাত্র ৪৭ হাজার ৭৪ টন। ২ মে সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও মিলারদের সঙ্গে চুক্তির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ মে পর্যন্ত। ২৪ মে পর্যন্ত ৭ লাখ ৯২ হাজার ৮৮২ টন সেদ্ধ চাল ও ৫১ হাজার ৯২২ টন আতপ চাল সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ ম-ল বলেন, সাময়িক সংকটে চাল আমদানির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চলতি বোরো মৌসুমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল আমদানি করা হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের কাছে বাজার থেকে ধানের চাহিদা কমে গেছে। এজন্য বাজারে ধানের দাম উঠছে না। আবার ধানের দাম কমলেও বাজারে চালের দাম কমছে না। এর অর্থ হলো, বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই অথবা মিলারদের চক্র শক্তিশালীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন তারা কম দামে ধান কিনে বেশি দামে সরকারের কাছে চাল বিক্রি করবে। এতে কৃষক ও সরকার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
_____________
patheo24,/105/sl