হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস শিশুদের জন্য বিপজ্জনক

হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস শিশুদের জন্য বিপজ্জনক

হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস শিশুদের জন্য বিপজ্জনক

মিজানুর রহমান পলাশ :: গত দুই বছর আগে রোহান লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর সময় রোহানের বয়স হয়েছিল ৮ বছর। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হবার বিষয়টি নিশ্চিত হতে রোহানের বাবা-মাকে বেশকিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। যখন রোগটি ধরা পড়ে তখন আর কিছুই করার ছিল না। রোহানের চিকিৎসক জানান, জন্মের পর পরই যদি শিশুটিকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভ্যাকসিন দেওয়া যেতো তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি এ রোগে রোহানের মৃত্যু হতো না।

পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ অর্থাৎ ২০০ কোটির বেশি লোক হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ৩৫ কোটি লোক দীর্ঘ মেয়াদী হেপাটাইটিস ‘বি’ রোগে ভুগছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ লোক এ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লিভার রোগের জটিলতা যেমন- লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

হেপাটাইটিস ‘বি’ একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। রক্ত ও রক্তজাত পদার্থই মূলত এই ভাইরাসের বাহক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগির কোন লক্ষণ দেখা যায় না, অথচ এদের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যৌন সম্পর্ক, রক্ত, লালা, বুকের দুধ ইত্যাদি এক দেহ থেকে অন্য দেহে এই ভাইরাস বিস্তারে সহায়তা করে। আক্রান্ত মায়ের সন্তান, আক্রান্ত পরিবারের অন্য সদস্য, বহুবার রক্তগ্রহণকারী রোগি, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি, স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, নার্স, ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, দন্তরোগের চিকিৎসকগণ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছেন। এছাড়া নাক ও কান ফুড়ানো, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, সূঁচ, দন্ত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, নাপিতের ক্ষুর, হাসপাতালে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করলে হোপাটাইটিস ‘বি’ ছড়ায়। এইচআইভি এইডস্ ভাইরাসের মতই হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসও যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। সমকামী এবং পতিতাদের মাধ্যমে এ ভাইরাস সমাজে দ্রুত বিস্তৃত হয়।

বিশ্বব্যাপী হোপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, অভ্যাস, সামাজিক প্রথা, পরিবেশ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি দ্বারাও প্রভাবিত হয় এ ভাইরাসের বিস্তৃতি। এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বকে মোট তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। যেমন উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আক্রান্ত এলাকা। বাংলাদেশকে মধ্যম আক্রান্ত এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের অপর নাম জন্ডিস। একজন ব্যক্তি কোন বয়সে হোপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তার উপর এ রোগের প্রকৃতি নির্ভর করে। গর্ভাবস্থায় মা যদি হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস বহনকারী হয়, তাহলে পরবর্তীতে জন্মগ্রহণকারী শিশুর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস বিস্তার লাভ করে। প্রসবকালীন এবং স্তন্যদানকালীন সময়েও এই ভাইরাসের বিস্তার লাভ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যদি শিশু বয়সে কেউ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যার চুড়ান্ত পরিণতি অকাল মৃত্যু। এখনও পর্যন্ত হেপাটাইটিস ‘বি’ সম্পূর্ণরূপে নিরাময়ের কোনো কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় এ রোগ হতে রক্ষা পেতে হলে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভ্যাকসিন গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

নবজাতক এবং শিশুরা জীবনের শুরুতেই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদের মধ্যে এ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণসমূহ প্রতিফলিত হয় না। পরবর্তীতে এ সকল শিশু দীর্ঘ মেয়াদী এ ভাইরাসের বাহক হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের হলুদ রং, পেটে ব্যাথা ও সেই সাথে জ্বর, ক্ষুধামান্দ্য এবং বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, মাংসপেশী এবং হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যাথা হওয়া, সব সময় এক ধরনের অস্বস্তি অনুভত হওয়া ইত্যাতি লক্ষণগুলি দেখা যায়।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ধীরে ধীরে লিভারকে ধ্বংস করে দেয় যা আগে থেকে বোঝা যায়না। তাই এটি একটি নীরব ঘাতক। এশিয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাপান, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইতোমধ্যে বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনসহ সার্বজনীন হোপাটাইটিস ‘বি’ টিকা প্রচলন করেছে যার মাধ্যমে ঐসব দেশে হোপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস বহুলাংশে কমে এসেছে।

হোপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমিত রোগসমূহের বিস্তার ও চুড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সার্বজনীন প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার অভাব এবং হোপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকার উচ্চমূল্য হোপাটাইটিস ‘বি’ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। এসব রোগের চিকিৎসার ওষুধ আমাদের দেশে সবসময়ই পাওয়া যায়, তবে এগুলোর মূল্য অনেক বেশি। সুতরাং প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়।
বাংলাদেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি একটি বিরাট সফলতা।

পোলিও রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে এর ফলে। আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধের জন্য এর টিকাকে ইপিআই কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করেছে। রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে হেপাটাইটিস ‘বি’ এর উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় হতে ব্লাড ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছে।

টিস ‘বি’ ভাইরাস প্রতিরোধে শিশু জন্মের প্রথম বছরেই হেপাটাইটিস ‘বি’ টিকা সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া ইলেক্ট্রোনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্যে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং হেপাটাইটিস ‘বি’ টিকাদান কর্মসূচিকে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ প্রাণঘাতি রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
লেখক : কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *