৫০ বছর বিনা পারিশ্রমিকে খুঁড়েছেন ৫০০ কবর

৫০ বছর বিনা পারিশ্রমিকে খুঁড়েছেন ৫০০ কবর

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : রাত-দিনের যেকোনো সময় মানুষের মৃত্যুর সংবাদ শুনলে ছুটে যান তিনি। চলে যান মরদেহের মাপ নিতে, এরপর খোঁড়া শুরু করেন কবর। তবে এজন্য নেন না কোনো পারিশ্রমিক। কবর খোঁড়াই যেন তার নেশা হয়ে গেছে। প্রায় ৫০ বছর এভাবেই বিনা পারিশ্রমিকে এলাকার মৃত মানুষদের জন্য কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। এখন পর্যন্ত এভাবে পাঁচশ কবর খুঁড়ছেন।

তিনি হলেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের ভাটিয়ালপুর গ্রামের আলী হোসেন ঢালী (৭০)। তিনি মৃত সুলতান ঢালীর ছেলে। তার তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। দুই স্ত্রীর কবর নিজের হাতেই করেছেন। যখন যে কাজ পান, সেই কাজ করেই সংসার চালান এই বৃদ্ধর। কখনও কৃষি কাজ আবার রাজ-জুগালী, কখনও রাস্তায় মাটিকাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবুও কবর খুঁড়ে কারো থেকে কোনো টাকা নেনন না তিনি।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আলী হোসেন বাড়িতে একটি ছোট ঘরে বসবাস করেন। ঘরটির টিনে মরিচরায় জং ধরেছে অনেক আগেই। ঘরের ভেতরে জায়গা না থাকায় এক ছেলে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। মাত্র তিন শতক জায়গায় অন্য ছেলেদের নিয়ে জোড়া তালি দেওয়া ঘরটিতে দিন কাটে তার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর সদরের দাসাদী গ্রাম, ফরিদগঞ্জ উপজেলার চাঁদপুর গ্রাম, ভটিয়ালপুর, প্রত্যাশী, চিরকা গ্রাম, ধানুয়া, চির কুমরিয়া, চর দু:খিয়া, গাব্দের গাঁও, নয়ার হাট, চর ভাগল গ্রামসহ জেলার বিভিন্নস্থানে মৃত ব্যক্তির কবর করেছেন। স্থানীয়দের দাবি যেহেতু তিনি অসহায়-গরিব তাকে বয়স্ক ভাতাসহ সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার।

আলী হোসেন বলেন, আমার বাবা কবর খোঁড়ার কাজ করতেন। তার মৃত্যুর পর আমি কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করি। তখন ১৫-১৭ বছরের যুবক ছিলাম। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ মৃত মানুষের কবর করেছি। বাবার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমি এই কাজ করি। করোনাকালে সবাই ভয়ে মরদেহ থেকে দূরে চলে যেত। তখন আমি ১ থেকে দেড়শ করোনা আক্রান্তসহ নানা রোগে মৃতদের কবর দিয়েছি। আমার টাকা-পায়সার কোনো লোভ নেই। করব করে কারো কাছ থেকে হাদিয়া বা টাকা পয়সা নেই না। এমন কী অনুষ্ঠানেও খেতে যাই না। মৃত ব্যক্তির কবর করা নেশা হয়ে গেছে। আমি গরিব মানুষ। শুধুমাত্র ঘরের ভিটা আছে। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। দুই স্ত্রীর কবর করেছি। আল্লাহ যদি দেয় আখিরাতে কিছু পাব।

তিনি আরও বলেন, কোনো কবর তৈরি করতে গিয়ে পুরান কঙ্কাল পেলে ওই কবরে জায়গা করে গুঁজে রাখি। আমি সরকারি কোনো অনুদান পাই না।

আলী হোসেনের পুত্রবধূ আমেনা বেগম জানান, আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১২ বছর। এ পর্যন্ত দেখে আসছি, তিনি মৃত ব্যক্তির কবর কারার কাজে নিয়োজিত আছেন। আমার বাবা বাড়িতে গিয়ে দাদা, খালুসহ অনেক আত্মীয়-স্বজনের কবর তৈরি করেছেন। কবরের কাজের সুবাদে এক গ্লাস পানিও খাননি। কারো কাছে থেকে কোনোদিন টাকা পয়সা নেননি।

আলীর চাচাতো ভাই বৃদ্ধ লোকমান ঢালি (৭২) জানান, আমার চাচা আগে কবর করতেন। তার মৃত্যুর পর চাচাতো ভাই কবর করার কাজ করেন। সে কারো কাছ থেকে এক টাকাও নেয় না। মৃত ব্যক্তির পরিবারের থেকে এক গ্লাস পানিও খায় না।

স্থানীয় মিলন জানান, তিনি আমার বাবা কবর করেছেন। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, সে কবর তৈরি করেন। কবর তৈরি করার কাজে কোনো হাদিয়া নেন না। মানুষ মারা গেলে কবর তৈরি করেন। তাকে সরকারি বয়স্ক ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে এভাবে বৃদ্ধ বয়সে মানুষের সেবা করতে পারবে।

ভাটিয়ালপুর চৌরাস্তা বাজারের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি সম্পর্কে আমাদের এলাকার দাদা। এক সময় তিনি সিলেট রাস্তার কাজ করতেন। সেখানে থেকে জানতে পেরে আমাদের এলাকার এক লোক মারা গেছেন। তখন তিনি ওই মৃত ব্যক্তির কবর তৈরি জন্য চলে আসেন।এছাড়াও একদিন তার ভাইয়ের মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। ওই দিন এক ব্যক্তি মারা গেছে, খবরটি শুনার সাথে সাথে চলে তিনি আসেন। মৃত বক্তির কবর তৈরি করেন।

কবর তৈরি বিনিময় টাকা নেয়া তো দূরের কথা, এক কাপ চাও খাই না। রাত দুই-তিনটাও কেউ যদি তাকে খবর দেয়। কবর তৈরি করতে খন্তা, কোদাল, তেরপাল, বালতি, বেলচা, দা, করাত নিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়ীতে হাজির হন। মৃত ব্যক্তির দেহ মাপ দিয়ে শুরু করেন কবর তৈরি কাজ। করোনাকালীন কেউ যখন করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য আসতো না। তিনি ওই সময় কবর তৈরি করছেন। এছাড়া পচা, কাটা মরদেহের কবর তৈরি করেছেন। এখন পর্যন্ত ৫০০ মানুষের বিনা পয়সায় কবর তৈরি করে দিয়েছেন। তবে কারো কাছ থেকে পারিশ্রমিক নেননি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, আলী হোসেন কবর খোঁড়ে। আমার স্বামীর কবর করেছেন। এখন প্রায় ৫০০ কবর তৈরি করেছেন। বিনিময়ে কারও থেকে কিছু নেন না। এক বেলা ভাতও খায় না। তিনি খুব ভালো মানুষ। তার তুলনা হয় না। কবর তৈরির কারণে এলাকার অনেকে তাকে চেনে। তাকে সরকারি বয়স্ক ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে সে বৃদ্ধ বয়সেও মানুষের সেবা করতে পারবে।

উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের ফজল হক গাজী জানান, তিনি ৫০ বছর ধরে কবর তৈরি কাজে নিয়োজিত। এখন প্রায় ৫০০ কবর তৈরি করেছেন। আমার আত্মীয়-স্বজনে কবর তৈরি করেছেন। কারও কাছ থেকে টাকা পয়সা নেন না। মৃত্যু উপলক্ষ্যে খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলেও যান না।

ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৯নং কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন টিটু জানান, আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি আলী অনেক মানুষের কবর খুঁড়ে দেন। তিনি সাধারণ এক কৃষক-শ্রমিক। বিনিময়ে কোনো টাকা নেয় না। এরকম মানুষ সমাজে খুব কম পাওয়া যায়। একজন দিনমজুর হয়েও পরোপকারী মানুষ হিসেবে ভূমিকা রাখছেন।

ঢাকা পোস্টের এক প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর বলেন, হতদরিদ্র, পরোপকারী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। তিনি আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেননি। তিনি যোগাযোগ করলে তাকে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তসলিম বেপারী জানান, আলী হোসেনকে প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে চিনি। তখন থেকে আমি দেখেছি, মানুষ মারা গেলে কাজ রেখে কবর তৈরির জন্য চলে যেতেন। মানুষের মৃত্যু খবর শুনলেই সঙ্গে সঙ্গে কবর দিতে চলে যান। বিনা অর্থে কবর তৈরি করেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি কবর তৈরি করেছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *