অমনোযোগী পাঠকের অনুভূতি

অমনোযোগী পাঠকের অনুভূতি

মাহবুবুর রহমান : আমার বন্ধু মহলে যারা একটু-আধটু সাহিত্য চর্চা করে, তারা প্রত্যেকেই এমন যে একেকজন ৫০০-১০০০ বা তারচেও বেশি বই পড়ে ফেলেছে। কিন্ত তাতেও তারা তৃপ্ত নয়। আমার এক বন্ধু দরসের ফাঁকে ফাঁকে এক সপ্তাহে ২১ টি বই অনায়েসেই শেষ করতে পারত। আসলে সে পারত আরো অনেক বেশি। কিন্ত সে যে গ্রন্থাগারের সদস্য ছিল সেখান থেকে তাকে দুইটির বেশি বই দেয়া হত না। তবুও সে জোর করে একটা বই বেশি নিয়ে আসত (পরিচিত হওয়ার কারণে)।

আমি কিছু বই পড়তে চাই। কোন ধরণের বই পড়ে আমি বেশি উপকৃত হতে পারি? এ কথা ওদের জানালে ওরা আমাকে কিছু বইয়ের নাম বলে দিত। এগুলো ছাড়াও আমার ভাবনায় অন্য কিছু বইয়ের তালিকা ছিল। এই ছক বেয়েই একটু একটু করে সম্মুখপানে এগিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালাই তাওফিক দাতা।

সেই ধারাবাহিকতায় এবারের ছুটিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে এক নিঃশ্বাসে কিছু বই পড়ে ফেললাম। আহমদ ছফার দুটি বই, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ এবং যদ্যপি আমার গুরু। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াব নামা। হাসান আজিজুল হকের স্বনির্বাচিত গল্প। বিভূতিভূষণ গল্প সমগ্র(২), জোসনা ও জননীর গল্প এবং শীর্ষেন্দুর কিশোর সমগ্র।

আহমদ ছফা
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি নয় ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’ নামক ছোট্ট বইটি স্বাতন্ত্রে ও নিজস্ব স্বকিয়তায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলা সাহিত্যে এটিকে অদ্বিতীয় গ্রন্থ বলা চলে। আমি বইটি পড়েই এ কথা বলছি। চলুন না! বইয়ের ভেতরে একবার নযর বুলানো যাক। আহমদ ছফা একটা জায়গায় বাংলার চির সবুজ প্রকৃতিকে কি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,……..এই চারাগাছ গুলোর কোমল শরীরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তানের মতো একে একে সবুজ প্রাণ হিল্লোলিত হয়ে ওঠে…… আমার সমগ্র সত্ত্বা চারা গাছের রঙে সবুজ হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। আমি অনুভব করি বুকের মধ্যে এই সবুজ প্রাণের নীরব ঝংকার।

আরো লিখেছেন, “মিষ্টি কুমোড়ের বাচ্চা ভূমিতে শয়ন করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে….ঈশ্বরের এই প্রাচুর্যের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে”।

”যদ্যপি আমার গুরূ” এই বইটি শেষ করতে মাত্র তিন ঘন্টা সময় লেগেছ অামার। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে একজন লেখক কতোটা শক্তিমান হতে পারে! আমার এ অনুভূতি কেন হয়েছে আমার জানা নেই। এ বইটিতে লেখকের জীবন ঘনিষ্ট অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে। আহমদ ছফা তার লেখায় লুকো- ছাপার কিছু রাখেন না। অত্যন্ত জটিল বিষয় গুলোকে সাবলীল ভাবে বলে যাওয়াই তার অনন্য বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তিনি আধা অর্থনীতিবিদ আধা সাহিত্যিক। তবে আমার কাছে মনে হয়, লেখার জগৎটাতে মৌলবি ছফা নিজেই নিজের উপমা। তার জগতে অন্য উপমা মেলা ভার। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের তার ”বসন্ত বিলাপে”(প্রথমা প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত) অনেক বিলাপ করেছেন ‘ছফা ভাই ছফা ভাই’ বলে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
যিনি ওপার বাংলার কাকা-বাবুদের দাম্ভিকতার প্রতিবাদে, বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন ”আমরা তোমাদের কাছে ঠেকা নই। আমরা নিজ পায়ে দাঁড়াতে জানি। সাহিত্য কাকে বলে আমরা তোমাদের চোখে আঙুল দিয় দেখিয়ে দেব”। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যকে হিমালয়ের চুড়াতে নিতে। বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন স্বল্পপ্রজ বিখ্যাত লেখক অাছেন, ইলিয়াস তাদের অন্যতম। খুব অল্প লিখে সাহিত্য ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল নাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। চিলে কোঠার সেপাহি ও খোয়াবনামা বাংলা সাহিত্যে তার অসামান্য অবদান। এই ছুটিতেই ৩৫২ পৃষ্ঠার খোয়াবনামা শেষ করলাম। এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা শব্দের গাঁথুনি আর বাক্যশৈলীর নিপুণতায় বাঙময় হয়ে অাছে। আমার বিশ্বাস বাংলার মানুষ তাকে ভুলে যেতে পারবেনা। কখখনোই না।

হাসান আজিজুল হক
তার রচিত ৩৮২পৃষ্ঠার একটি বই ”স্বনির্বাচিত গল্প” গোগ্রাসে গিললাম। মূলত বিভিন্ন সময় এই লেখকের পূর্বে প্রকাশিত বই গুলোকে এক মলাটে নিয়ে আসার একটা অনন্য প্রয়াস এটি। ”সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য”, ”আত্মজা ও একটি করবি গাছ”, ”জীবন ঘষে আগুন”, ”নামহীন গোত্রহীন”, ”পাতালে হাসপাতালে”, ”রোদে যাবো”। এমন উল্লেখযোগ্য ৬টি বইয়ের এক অনবদ্য সংকলন এটি। তার লেখা গল্প গুলো কেমন সেটা আর বাড়িয়ে বলার দরকার নেই। কারণ তিনি তো দুই বাংলাতেই ছোট গল্পের রাজপুত্র।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *