কওমি তরুণ আলিফের প্রযুক্তির কারিশমা

কওমি তরুণ আলিফের প্রযুক্তির কারিশমা

  • আদিল মাহমুদ

প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। যদি আমরা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পারি। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর এই বৈপ্লবিক উত্থান। ঘরে বসেই এখন আউটসোর্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং করে সচ্ছল হওয়া যায় এই প্রযুক্তি কল্যাণে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা ইতিমধ্যে সারাবিশ্ব থেকেই আসছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতেও শুরু করেছে বাংলাদেশ। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই তথ্যপ্রযুক্তির যোগে কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে আছেন তথ্যপ্রযুক্তিগত দক্ষতার দিয়ে। আর এজন্য তারা আউটসোর্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েবডেভলাপার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছেন না।

এটাও সত্য, তাদের পড়ালেখা, জানাশোনা, সিলেবাসে এই বিষয়গুলো নেই। কিন্তু কিছু কিছু কওমি তরুণ নিজ উদ্যোগে এসব শিখে প্রযুক্তির ব্যবহারে তাদের কারিশমা দেখাচ্ছেন বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে। এমনই একজন তরুণ ‘আফরিদুল ইসলাম আলিফ’। আজ তার প্রযুক্তিতে বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প শুনি।

আফরিদুল ইসলাম আলিফ’ এর জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায়। জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। আপনজনের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, আবার কেউ সফল ব্যবসায়ী। আলিফের আত্মীয়স্বজনের সবাই চাইতেন আলিফও জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। এতে তার ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে। সমাজের চোখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু আলিফ তার মমতায়ী মায়ের ইচ্ছায় ভর্তি হলেন মাদরাসার মক্তব। শুরু হলো শিক্ষাজীবন। হেফজ শেষ করে ভর্তি হলেন মাদরাসার জামাতখানায়।

এদিকে তার আত্মীয়স্বজন ও পড়াপড়শির কিছু লোকজন বলাবলি শুরু করে, ছেলেকে মাদরাসায় পড়াচ্ছেন, ভবিষ্যতে খাবে কি! মসজিদে ইমামতি কিংবা হুজুর হওয়া ছাড়ার তো আর কিছু করা থাকবে না। কেমন চলবে তার জীবন! বেশির থেকে বেশি মিলাদ, খতম পড়ে আরো সামান্য কিছু টাকা পেতে পারে। কিন্তু তাদের কথায় কখনোই কান দেননি আলিফের মা। তিনি লক্ষ্যে অটল অবিচল। ছেলেকে হাফেজ মাওলানা বানাবেন। অবশ্যই আলিফেরও ইচ্ছে ছিল মাদরাসায় পড়ার, মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার।

কৈশোর বয়স, বাংলাদেশের স্বনামধন্য কওমি মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে পড়ছেন আফরিদুল ইসলাম আলিফ। মাদরাসায় পড়ালেখার পাশাপাশি কৈশোর বয়স থেকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি অনেক আকর্ষণ ছিল আলিফের। তিনি সময় পেলে কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়তেন। নতুন নতুন জিনিস জানতে চেষ্টা করতেন।

বড় হচ্ছেন আফরিদুল ইসলাম আলিফ, ভাবছেন ভবিষ্যতে কি করবেন। আপনজন সবার সাথে তাল মিলিয়ে টাকাপয়সা ইনকাম করতে হবে। তাদের থেকে ছোট হওয়া যাবে না। যেতে করে তারা একথা বলতে না পারে, মাদরাসায় পড়েছি বলে আজ আমি অসহায়, আমার ইনকাম নেই। তাই তিনি ভবিষ্যৎ কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিলেন তথ্যপ্রযুক্তিকে।

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারই এখন এই প্রযুক্তি। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারও তথ্যপ্রযুক্তিতে তরুণদের এগিয়ে আসার জন্য হরেকরকম কর্মসূচি ও সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। আলিফ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাচ্ছেন। পরিশ্রম ও নিজ যোগ্যতার যুতসই ব্যবহার করে দক্ষ হয়ে ওঠছেন প্রযুক্তির বিভিন্ন সেক্টরে। এখন অনলাইনে কাজ করছেন দেশবিদেশি আইটি সেক্টর ও কোম্পানিতে।

আফরিদুল ইসলাম আলিফের সাথে কথা হলে তিনি জানান-

‘আমি প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দক্ষতার বিষয়ে সেলফ লার্নিং ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একটি দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ট্রেনিং নিয়ে কিছু কিছু বিষয়ের উপর কাজ করে আরো দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এই ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করার ইচ্ছে আছে ইনশাআল্লাহ।

আমি আইসিটিতে আমার 8 বছরেরও বেশি স্বশিক্ষার অভিজ্ঞতা আছে। যেমন- ক্লাউড কম্পিউটিং, নেটওয়ার্কিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি। বিশেষ করে ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টে। আমি অনুশীলনের উদ্দেশ্য কিছু প্রকল্পে কাজ করেছি এবং ক্লায়েন্ট খুব সন্তুষ্ট হয়েছে। এসব আমার অর্জন এবং অনুপ্রেরণা। আমার এই ছোট ছোট সাফল্যে খুশিও আপনজন, আত্মীয়স্বজন। তারা দুআ করছেন আরো এগিয়ে যাবার।

আলিফ বলেন-

‘আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন যে কোনো ধরনের আইটি সমস্যার সমাধান করতে পারি এবং পরামর্শ দিতে পারি। আমি ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্টের প্রশিক্ষণ নিয়েছি বেসিস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইটিএম) থেকে ও ডিজিটাল মার্কেটিং এর উপর ১ বছরের বেশি প্রশিক্ষণ নিয়েছি লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট থেকে। এটি একটি বাংলাদেশ সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কোর্স ছিল। ভবিষ্যতে আমার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে আছে ইনশাআল্লাহ।

কেবল তথ্যপ্রযুক্তি নয়, সর্বক্ষেত্রে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যাতে দক্ষতা অর্জন করে এবং কর্মজীবনে সেটা কাজে লাগিয়ে সফল হয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার চেষ্টা করে এই কামনা করি। আর এসব ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষক ও কওমি মাদরাসাগুলোর বোর্ডে দায়িত্বরত সবাইকে অনুরোধ জানাই। আমার জন্যও দুআ করবেন, যেন আমি একজন ভালো আলেম ও দীন ইসলামের দায়ী হতে পারি। কর্মজীবনে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পোঁছতে পারি।’

আফরিদুল ইসলাম আলিফ এখন একজন পরিচিত মুখ হয়ে উঠছেন। সফল মানুষ হওয়ার চেষ্টায় আছেন। কওমি মাদরাসায় পড়েও তিনি তার জীবন রাঙিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তার আপনজন ও সমাজকে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কওমি মাদরাসায় পড়লেই কেবল হুজুর, ইমাম সাহেব না হয়ে ভিন্নকিছু হওয়া যায়। ভবিষ্যত সুন্দরভাবে সাজানো যায়। চেষ্টা করলে বিশ্বজয় করা যায়। আলিফ এখন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রশংসনী অবস্থান দেখল করে আছেন। তাই বলি, তথ্যপ্রযুক্তি কওমি তরুণদের জন্যেও আশীর্বাদ স্বরূপ হবে। যদি আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারি।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় আইসিটি মন্ত্রণালয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে যোগ্য করে গড়ে তুলার জন্য তরুণদের নিয়ে কাজ করছে। তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিচ্ছে। কারণ একটি দেশকে উন্নত করতে হলে সে দেশের যুবসমাজের আইটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। আইটি সমৃদ্ধ যুবসমাজ চাকরির বাজারে বিশেষ সুবিধা লাভ করে থাকে।

কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া তরুণরা এই ক্ষেত্রে কেন পিছিয়ে থাকবো!? আফরিদুল ইসলাম আলিফ মত আরো অনেক কওমি তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তি ও আইটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। সমাজ ও দেশকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, কওমি তরুণরাও সবকিছু পারে। আর এতে করে নিজেদের জীবন সুন্দর হবে। সেই সাথে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *