কীভাবে জানবো জিহাদ সম্পর্কে

কীভাবে জানবো জিহাদ সম্পর্কে

জিহাদকে কলুষিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। পবিত্র এই শব্দটির অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদকে হালাল করার সবধরনের চেষ্টা তদবির তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
জিহাদের আয়াত ও হাদিসগুলোর সঠিক মর্ম অনুধাবন না করেই এর উগ্রবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে বিপদগ্রস্ত দলটি। তাদের ভ্রান্তিসমূহের উল্লেখযোগ্য একটি হলো, তারা মনে করে ‘অমুসলিম হলেই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে’ এই ধারণা সম্পূর্ণই ভ্রান্ত অমূলক ও কুরআন সুন্নাহ বিবর্জিত। এই ধারণাকে খণ্ডণ করে এবং জিহাদের আসল ক্ষেত্র কারা তা চিহ্নিত করে ‘আল জিহাদ ফিল ইসলাম; কাইফা নাফহামুহু ওয়া কাইফা নুমারিসুহু’ (জিহাদ; সঠিকভাবে কীভাবে বুঝবো ও চর্চা করবো?) নামে কালজয়ী এক গ্রন্থ রচনা করেছেন সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম ও গবেষক সাঈদ রমাদান আল বুতী। উক্ত গ্রন্থ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবে পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম।

জিহাদ অমুসলিমদেরকে প্রতিহত করার জন্য আসেনি, ইসলাম বিরোধিচক্রান্তকে প্রতিহত করার জন্য জিহাদ এসেছে।

জমহুর তথা হানাফী মালেকী ও হাম্বলী আলেমগণ বলেন, জিহাদ এসেছে ইসলাম বিরোধিচক্রান্তকে প্রতিহত করার জন্য, অমুসলিমদেরকে প্রতিহত করার জন্য জিহাদ আসেনি।
আর ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর দুটি অভিমতের স্পষ্টতম মতটি হচ্ছে ‘অমুসলিমদেরকে প্রতিহত করার জন্য জিহাদের আগমন’। ইবনে হাযম জাহিরীও উক্ত মতের প্রবক্তা।

জমহুর আলেমগণ কুরআনুল কারীমের একাধিক আয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একাধিক হাদিস দিয়ে এটি প্রমাণ করেছেন যে, জিহাদের ইল্লত বা অনুঘটক হলো ‘ইসলাম বিরোধী চক্রান্ত’। স্রেফ অমুসলিম বলেই কারো সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। কাজেই যারা ইসলাম বিরোধী চক্রান্ত করবে না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

জমহুর যে আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন তা হলো,
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ
আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। [সুরা বাকারা ২:১৯০]
أَلاَ تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نَّكَثُواْ أَيْمَانَهُمْ وَهَمُّواْ بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُم بَدَؤُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ إِن كُنتُم مُّؤُمِنِينَ
তোমরা কি সেই দলের সাথে যুদ্ধ করবে না; যারা ভঙ্গ করেছে নিজেদের শপথ এবং সঙ্কল্প নিয়েছে রসূলকে বহিষ্কারের? আর এরাই প্রথম তোমাদের সাথে বিবাদের সূত্রপাত করেছে। তোমরা কি তাদের ভয় কর? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও। [সুরা তাওবা ৯:১৩]
لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
‌ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। [সুরা মুমতাহিনা ৬০:৮]
إِنَّمَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ قَاتَلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَأَخْرَجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ وَظَاهَرُوا عَلَى إِخْرَاجِكُمْ أَن تَوَلَّوْهُمْ وَمَن يَتَوَلَّهُمْ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেছে এবং বহিষ্কারকার্যে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তারাই জালেম। [সুরা মুমতাহিনা ৬০:৯]
وَقَاتِلُواْ الْمُشْرِكِينَ كَآفَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَآفَّةً وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, কারণ, তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। [ সুরা তাওবা ৯:৩৬ ]

স্পষ্ট যে, আয়াতে ‘كما’এর মধ্যকার ‘ك’ বর্ণটি ইল্লত বা ‘কারণ’ বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ, তোমরা সদলবলে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ কর কেননা তারাও তোমাদের সাথে সদলবলে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। (তাফসীরে কুরতুবী খণ্ড ৮ পৃষ্ঠা ১৩৬)

এই আয়াতগুলো স্পষ্ট প্রমাণ বহন করছে যে, অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধের অনুঘটক হলো তাদের ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র।

আয়াতগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাদানী জিন্দেগীতে অবর্তীর্ণ হয়েছে, এবং এর মাঝে কিছু আয়াত আছে যা তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও অবতীর্ণ হয়েছে কাজেই এই আপত্তি তোলার কোন অবকাশ নেই যে উক্ত আয়াতগুলো মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে কিনা?

এ বিষয়ের হাদীসগুলো উল্লেখ করা যাক।
عَنْ حَنْظَلَةَ الْكَاتِبِ، قَالَ غَزَوْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَرَرْنَا عَلَى امْرَأَةٍ مَقْتُولَةٍ قَدِ اجْتَمَعَ عَلَيْهَا النَّاسُ فَأَفْرَجُوا لَهُ فَقَالَ ‏(‏مَا كَانَتْ هَذِهِ تُقَاتِلُ فِيمَنْ يُقَاتِلُ‏)‏ ‏.‏ ثُمَّ قَالَ لِرَجُلٍ ‏(‏انْطَلِقْ إِلَى خَالِدِ بْنِ الْوَلِيدِ فَقُلْ لَهُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْمُرُكَ يَقُولُ لاَ تَقْتُلَنَّ ذُرِّيَّةً وَلاَ عَسِيفًا‏)‏‏.
কাতেবে ওহী হানজালা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে ইমাম ইবনে মাযাহ, আবু দাউদ ও আহমদ বিন হাম্বল রাহিমাহুমুল্লাহ বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে যুদ্ধ করে যুদ্ধ নিহত এক নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তার লাশকে ঘিরে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সবাই জায়গা করে দিল। মহিলার লাশ দেখে তিনি বল্লেন, ‘সে তো আর যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেনি’ এরপর কাউকে বললেন, খালিদের কাছে যাও, বলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি তোমাকে এই ঘোষণা দিতে বলেছেন যে, ‘নারী আর চাকর বাকরদের কোনভাবেই হত্যা করো না।

(ইবনে মাজাহ,হাদীস নং-২৮৪২) (আবু দাঊদ,হাদীস নং-২৬৬৯)
عن أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : ” انْطَلِقُوا بِاسْمِ اللَّهِ ، وَبِاللَّهِ وَعَلَى مِلَّةِ رَسُولِ اللَّهِ ، لا تَقْتُلُوا شَيْخًا فَانِيًا ، وَلا طِفْلا ، وَلا صَغِيرًا ، وَلا امْرَأَةً ، وَلا تَغُلُّوا ، وَضُمُّوا غَنَائِمَكُمْ ، وَأَصْلِحُوا وَأَحْسِنُوا ، إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ “.
ইমাদ আবু দাঊদ হযরত আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নামে চলো, অতিশয় বৃদ্ধ, ছোট বাচ্চা আর নারীকে হত্যা করো না। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আত্মসাৎ করো না বরং তা একত্র করো। সংশোধন কর। আর অনুগ্রহ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনুগ্রহশীলদের পছন্দ করেন‌।( আবূ দাঊদ, হাদীস নং-২৬১৪)

হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার খেলাফতের সর্বপ্রথম যুদ্ধাভিযান প্রেরণকালে সকালবেলা হযরত উসামা বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং তার যুদ্ধ সঙ্গীদেরকে বিদায় জানানোর সময় ওছিয়ত করেছিলেন যে,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ … لا تَخُونُوا ، وَلا تَغِلُّوا ، وَلا تَغْدِرُوا ، وَلا تُمَثِّلُوا ، وَلا تَقْتُلُوا طِفْلا صَغِيرًا ، وَلا شَيْخًا كَبِيرًا ، وَلا امْرَأَةً ….، وَسَوْفَ تَمُرُّونَ بِأَقْوَامٍ قَدْ فَرَّغُوا أَنْفُسَهُمْ فِي الصَّوَامِعِ ، فَدَعُوهُمْ وَمَا فَرَّغُوا أَنْفُسَهُمْ لَهُ.
হে লোক, খেয়ানত করো না, গাদ্দারী করো না, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আত্মসাৎ করো না, শিশুদেরকে হত্যা করো না অতি বৃদ্ধকে হত্যা করো না, নারীকে হত্যা কর না,.. গির্জায় যে লোকগুলো আত্মনিমগ্ন আছে তাদেরকে তাদের মত থাকতে দাও।

(তারীখে তাবারী খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ২২৬,২২৭)

প্রতিটি হাদীস এই প্রমাণ দিচ্ছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সকল লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে বারণ করছেন, যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তে লিপ্ত হয় না, চাই তারা কাফের হোক না কেন।

হয়ত লক্ষ করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যে নারীটির নিথর দেহ পড়েছিল তার ব্যাপারে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কী বললেন?

‘এই মহিলা তো যুদ্ধ করতে আসেনি’!

তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হলো?

‘যারা যুদ্ধ করবে না তাদের সাথে যুদ্ধ নয়’ এটি হাজার বছরের যুদ্ধরীতি বা নীতি। মুসলমানরা খুব গুরুত্বের সাথে এই রীতিনীতিগুলো মেনে যুদ্ধ করতেন, যার স্বাক্ষী ইতিহাস ও মাগাযী এর গ্রন্থসমূহ।

(চলমান)


মূল গ্রন্থ : আল জিহাদ ফিল ইসলাম; কাইফা নাফহামুহু ওয়া কাইফা নুমারিসুহু

মূল লেখক : সাঈদ রমাদান আল বুতী [সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম ও গবেষক]

অনুবাদ: আব্দুস সালাম
শিক্ষক, আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ।

সম্পাদনা : মাসউদু কাদির

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *