গাজায় শান্তি স্থাপনে বাইডেনের প্রস্তাব

গাজায় শান্তি স্থাপনে বাইডেনের প্রস্তাব

  • রয়টার্স ও আলজাজিরা

গাজা উপত্যকায় শান্তি স্থাপনের জন্য এই প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে একটি পরিকল্পনার প্রস্তাব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুক্রবার রাজধানী ওয়াশিংটনে দেয়া এক ভাষণে এই প্রস্তাব পেশ করেছেন তিনি। এই প্রস্তাবে হামাস ইতিবাচক সাড়া দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল।

বাইডেনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় ৩টি স্তর বা পর্যায় রয়েছে। প্রথম স্তরে গাজায় ৬ সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হবে। এই পর্বে রাফাসহ গাজার অন্যান্য জনবহুল এলাকাগুলো থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে এবং ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী কয়েক শ’ ফিলিস্তিনির মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের কব্জায় থাকা কয়েকজন বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস। এই দফায় যেসব বন্দীকে মুক্তি ওেয়া হবে, তাদের মধ্যে বয়স্ক এবং নারীরা প্রাধান্য পাবে।

সেই সঙ্গে এ ছয় সপ্তাহের প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করবে অন্তত ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক। হামাস এবং ইসরাইলের মন্ত্রিসভা ও প্রতিরক্ষাবাহিনী এই পর্যায়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাবে। যদি এই আলোচনা ৬ সপ্তাহ সময়সীমার মধ্যে শেষ না হয়, তাহলে পরিকল্পনার প্রথম পর্ব বা যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আরও বাড়বে।

স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য হামাস এবং ইসরাইল- দু’পক্ষের ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে শেষ হবে গাজায় শান্তি পরিকল্পনার প্রথম স্তর বা পর্যায় এবং তারপর শুরু হবে পরিকল্পনা ২য় পর্ব। এই পর্বে নিজেদের কব্জায় থাকা বন্দীদের সবাইকে মুক্তি দেবে হামাস এবং তার বিনিময়ে গাজার বাসিন্দারা পাবে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। পরিকল্পনার তৃতীয় পর্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ভবন-রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

বাইডেন বলেন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এবং রাজনীতিবিদদের একাংশ যে এখনই গাজা যুদ্ধের অবসান চায় না- সে সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। তিনি আরও বলেছেন, এই মহলটির নির্দেশনা অনুযায়ী চললে সামনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। ‘তারা গাজা দখল করতে চায়। এ কারণেই তারা সেখানে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী এবং বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারেও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি জানি, যে পরিকল্পনা আমি প্রস্তাব করছি, তাতে ইসরাইলি নেতৃত্বের একটি অংশ ব্যাপকভাবে আপত্তি জানাবে; কিন্তু তারপরও আমি ইসরাইলের নেতৃত্বকে এই পরিকল্পনা সমর্থনের উদাত্ত আহ্বান জানাব।’

বাইডেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি যুদ্ধের সময়ে ইসরাইল সফরে গিয়েছি। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের সুযোগে ইরান যখন লোহিত ও পারস্য সাগরে জাহাজগুলোর ওপর হামলা চালানো শুরু করল, তখন আমি সেখানে মার্কিন বাহিনী পাঠিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট এর আগে এমন পদক্ষেপ নেননি।’ ‘তাই ইসরাইলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আমার আহ্বান, এখন বিরতি দিন এবং একবার চিন্তুা করুন, এখন একটি বিশেষ সময়ে আমরা রয়েছি সবাই। যদি অবহেলায় এই সময় পেরিয়ে যায়, তাহলে কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’

মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে এক অভূতপূর্ব দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইসরাইলের দৃঢ় সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলপন্থী কমিউনিটির কাছে বেশ জনপ্রিয়, অন্য দিকে তার রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একটি বড় অংশে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য তাকে দায়ী করছেন। গাজা ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে যে দিন দিন তার প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে, তার আঁচ ভালোভাবেই পাচ্ছেন বাইডেন।

এ দিকে, আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে যুক্তরাষ্ট্রে। সেই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হচ্ছেন জো বাইডেন; আর গত নির্বাচনের মতো এবারও তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী এবং বাইডেনের পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, গাজা ইস্যুতে এই মুহূর্তে যদি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়, তাহলে নির্বাচনে তার সুফল ভোগ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাইডেনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ইসরাইলের : বাইডেনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে ‘ইতিবাচকভাবে’ নিচ্ছিল হামাস। বিশ্বের নেতারাও প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক বলে স্বাগত জানাচ্ছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন দখলদার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। গতকাল শনিবার নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, হামাসের সামরিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হবে। তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ইসরাইলের যে শর্ত রয়েছে সেটি পরিবর্তিত হয়নি: হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস করা, সব বন্দীকে মুক্ত করা এবং নিশ্চিত করা গাজা আবারও ইসরাইলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসরাইল তার শর্তে অটল থাকবে। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার আগে ইসরাইল স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে এমন ধারণা বাস্তব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’ এ দিকে বাইডেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হামাস বলেছে, তারা এতে ‘ইতিবাচক’। এ ছাড়া ইসরাইলের বিরোধী দলগুলোও এতে সমর্থন জানিয়েছেন। হামাসের হাতে যেসব বন্দী রয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরাও এই শর্ত কার্যকর করার জন্য দাবি জানাচ্ছেন।

গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে ইচ্ছুক ইন্দোনেশিয়া : গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে প্রয়োজনে শান্তিরক্ষী সেনা পাঠাতে ইচ্ছুক ইন্দোনেশিয়া। গতকাল শনিবার এই কথা বলেছেন দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো। এশিয়ার প্রধান নিরাপত্তা সম্মেলনে শাংগ্রি-লা ডায়ালগে বক্তৃতা করার সময় এ কথা বলেন তিনি। এ সময় প্রাবোও আরও বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তিন ধাপের প্রস্তাব একটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল।

প্রাবোও বলেছেন, ‘যখন প্রয়োজন হবে এবং জাতিসঙ্ঘের অনুরোধ আসবে তখনই আমরা সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা ও তা পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি সব দল ও সব পক্ষকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদানের জন্য উল্লেখযোগ্য শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে প্রস্তুত আছি।’ অক্টোবরে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব গ্রহণ করছেন ৭২ বছর বয়সী প্রাবো। এর আগে তিনি দেশটির স্পেশাল ফোর্সের জেনারেল ছিলেন। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রাবোও বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো তাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, ইন্দোনেশিয়াও গাজা থেকে ‘এক হাজার রোগীকে সরিয়ে নিতে এবং চিকিৎসা সেবা দিতে প্রস্তুত।’ যুদ্ধের মধ্যে নভেম্বরে গাজার ইন্দোনেশিয়া হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এটি ইন্দোনেশিয়ার একটি এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। বক্তৃতা করার সময় প্রাবোও আরও বলেন, গাজার রাফাহ এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে একটি তদন্তের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পরিস্থিতির ‘ন্যায্য সমাধান’ প্রয়োজন। এ কথাটির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘এর অর্থ শুধু ইসরাইলের অস্তিত্বের অধিকার নয়, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব মাতৃভূমি, নিজস্ব রাষ্ট্র এবং শান্তিতে বসবাস করার অধিকারও।’

Related Articles