জামায়াত আর ঐক্যফ্রন্টের একই রকম দাবি

জামায়াত আর ঐক্যফ্রন্টের একই রকম দাবি

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ঐক্যফ্রন্টের মত একই রকম দাবী করেছে জামায়াতে ইসলামী। ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর যে সাত দফা দাবি জানিয়েছে তা জামায়াতের মোট দাবি আটটির মধ্যে সাতটিতেই রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর মোট দাবি আটটি, যার মধ্যে ফ্রন্টের সাতটি দাবিই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ঐক্যফ্রন্ট জোটবদ্ধ হওয়ার আগে ‘জামায়াত’ ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে ব্যাপক। জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকলে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য নয়, এমন ঘোষণা ভুলে গিয়ে তাদের সঙ্গে জোট করেছেন ড. কামাল। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হলো জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আলাদাভাবে জোটবদ্ধ, কাজেই ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও তাদের শরিক বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ প্রকাশ্যেই। আর এই দাবি জানানোর সময় এই যোগাযোগও কাজে লেগেছে-সেটি বলেছে জামায়াতই।

এই অবস্থায় ঐক্যফ্রন্ট আর জামায়াতের একই দাবি তোলা নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। জামায়াতের সঙ্গে ফ্রন্টের সম্পর্ক নিয়ে করা সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। নানা নাটকীয়তা শেষে গত ১৩ অক্টোবর ৭ দফা ও ১১টি লক্ষ্যে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্যসহ বেশকিছু দল নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

জানা যায়, বিএনপি একই সঙ্গে দুটি জোট চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলছেন, তাদের জোট জামায়াতের সঙ্গে নয়। গত ১৩ অক্টোবর ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দেয়ার পর বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ মোট সাত দফা দাবি জানায়। আর ১২ দিন পর অজ্ঞাত স্থান থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান তুলে ধরেন আট দফা দাবি। তবে এই আট দফায় ঐক্যফ্রন্টের সাত দাবির চেয়ে আলাদা কিছু নেই। ফ্রন্টের সাত দাবিই জামায়াত আটটি হিসেবে তুলে ধরেছে বলে জানা যায়।

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জামায়াতের ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। ধারণা করা হচ্ছিল, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি দেবে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। তবে এখন পর্যন্ত ফ্রন্টের কর্মসূচিতে জামায়াতের প্রকাশ্য অংশগ্রহণ দেখা যায়নি, যদিও ফ্রন্টের আইনজীবী শাখা ‘আইনজীবী ঐক্যফ্রন্টে’ জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা যোগ দিয়েছেন।

‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা আর জামায়াতের ৮ দফার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কীভাবে এটা সম্ভব হলো’ জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘দেশকে বাঁচাতে হলে, জনগণকে বাঁচাতে হলে, জনগণের ভোটাধিকারকে ব্যবহার করতে হলে এ দাবিগুলো আদায় করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ দাবিগুলো এখন জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আমরাও করেছি।’

আগে থেকেই এ দাবিগুলো করে আসা হচ্ছে। ২০ দলীয় জোট, জামায়াত এবং বিএনপির পক্ষ থেকেও পৃথকভাবে এ দাবিগুলো করা হয়েছে। বাস্তবতা যখন এক থাকে। তখন সবাইতো পানিকে পানিই দেখবে। একজন পানি দেখবে, আরেকজন অন্য কিছু দেখবে, তা না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী মনে করেন, ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, আমার ধারণা, ড. কামাল হোসেন সম্ভবত জামায়াতসহ বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করার একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। উনার কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। উনি বিএনপিকে বলতে পারতেন, ২০ দল ছাড়ো। বিএনপিকে দিয়ে বলাতে পারতেন, তোমরা বলো যে, আমরা জামায়াতের সঙ্গে আর নাই। তিনি সেটা করেননি। এর ফলে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জামায়াত যেভাবে বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি ফুটিয়েছে, একইভাবে এখন কামাল সাহেবদের ঘাড়েও ফুটাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এর দায়-দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবে তাদের ঘাড়েই পড়বে।

ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে এই জামায়াত নেতা বলেন, যোগাযোগ তো সবার সাথেই থাকবে। রাজনীতি করলে, দেশের স্বার্থে সবার সাথে যোগাযোগ থাকে। তবে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগর কথা অস্বীকার করেছেন। ফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্রন্টে জামায়াত নেই। কিন্তু বিএনপি’র সঙ্গেতো জামায়াত আছে’- এ বিষয়টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? এমন জিজ্ঞাসায় মান্না বলেন, থাক না। সে বিতর্ক করে তো লাভ নেই। এটা তাদের (বিএনপি) ব্যাপার। আমরা জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করিনি। এটা বহুবার বলেছি।

যা আছে ঐক্যফ্রন্টের সাত দাবিতে-

১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

২. গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

৩. বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।

৪. কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব ‘কালো আইন’ বাতিল করতে হবে।

৫. নির্বাচনের ১০ দিন পূর্ব থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।

৬. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ভোটকেন্দ্র, পুলিং বুথ, ভোট গণনাস্থল ও কন্ট্রোল রুমে তাদের প্রবেশের ওপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা। নির্বাচনকালীন গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।

৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা। প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

আট দফায় যেসব দাবি তুলেছে জামায়াত, সেই সব দাবিগুলো হলো-

১. অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ ও কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে।

২. অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা চালুর ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

৩. সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের সব নেতাকর্মীকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি প্রদান ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৪. এখন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখতে হবে, নতুন করে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেয়া বন্ধ এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করতে হবে।

৫. বিচার বিভাগের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।

৬. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দাবি অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং তাদের ওপর হামলার ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৭. রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম হওয়া নাগরিকদের অবিলম্বে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে এবং গুম-খুনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে।

৮. আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *