আকাবিরের পদচিহ্নের খোঁজে—৯
নবাবের শহর, কাবাবের শহর
—মুফতী আবদুস সালাম
‘সাত আট ছয়’ দিয়ে সংক্ষেপে বিসমিল্লাহ লেখা যেমন বায়বীয় ব্যাপার, লাখনৌর মত এই বিরাট শহর মাত্র একদিনে ঘুরে দেখা তেমনই একটি ব্যাপার। ভুলভুলাইয়া, রুমি গেইট, লাখনৌ চিড়িয়াখানা, ফিরিঙ্গি মহলের কথা না হয় বাদই দিলাম এক আম্বেদকর পার্ক ঘুরতেই তো আধাদিনের বেশী লেগে যায়। তাই বেছে বেছে বিশেষ কয়েকটি জায়গায়ই গেলাম। তার মধ্যে ছিলো আম্বেদকর পার্ক।
আম্বেদকর পার্কটির বয়স মাত্র এক বছর। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী ১০৮ একর জমির উপর সাতশো কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করেছেন চোখ ধাঁধাঁনো সুন্দর এক পাথুরে রাজ্য ৷ যারা এক বছর আগে লাখনৌ এসেছেন এই নজরকাড়া অপরূপ জায়গাটিতে বসে গোমতি নদীর হাওয়ায় গা জুড়ানোর সৌভাগ্য তাদের হয়নি৷
পড়ন্ত বিকেলে আমরা বেরিয়ে গেলাম আম্বেদকর পার্ক দেখতে। উবার টেক্সি বিশ মিনিটে আমাদেরকে নিয়ে এলো পার্কের সামনে। ইমরান কাজী চারটা টিকিট কেটে নিয়ে এলো। হাবিবুল্লাহ পুরো ইন্ডিয়া চষে বেড়িয়েছে কিন্তু ইউপির রাজধানী এই লাখনৌতে সে এবারই প্রথম, তাই তার চোখেমুখে শুধুই বিস্ময়। আমাদের এই কাফেলার নেতা হচ্ছেন সাইদ আহমাদ নদবী। ভগ্নিপতীকে নিয়ে প্রমদ ভ্রমণে বেরিয়ে বেচারাকে ভালই গচ্চা দিতে হয়েছে।
আম্বেদকর পার্কের ভেতরে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার যোগাড়। সুবিস্তীর্ণ আঙিনায় রেড বেল্ড স্টোনের তৈরি এ যেন শহরের ভেতর আরেক শহর। আগ্রার তাজমহল, দিল্লীর কুতুব মিনার, দামেস্কের মসজিদে উমাবী, আরবের খেজুর বীথিকা কি নেই এখানে?
এখানকার সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর জায়গা আম্বেতকার স্তূপা। সুবিশাল রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট আছেন ভীমরাও রামজি আম্বেতকার। ওয়াশিংটনে নির্মিত আবরাহাম লিঙ্কনের স্ট্যাচুর অনুকরণে বানানো হয়েছে এই ব্রঞ্জ স্ট্যাচু। স্ট্যাচুর ফলকে খোদাই করে লেখা আছে-
‘My struggle of life is my only message.”
ভারতের অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে পরিগণিত ‘মহর’ পরিবারে জন্ম নিয়ে এক সময় শ্রেষ্ঠ ভারতীয় উপাধি পেতে এই মানুষটিকে কি পরিমাণ স্ট্রাগল করতে হয়েছে তা ভাবনার বিষয়। আম্বেদকরের জীবনী বলে আমি লেখা ভারী করবো না। কারো জানতে ইচ্ছে হলে একটু কষ্ট করে ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিন।
আম্বেতকরের স্ট্যাচুর সামনের ইয়ার্রডটির নাম ‘প্রতিবিম্ব স্থল’ ফ্লোরের শ্বেত পাথরে আয়নার মত আপনার ঝকঝকে ছবি প্রতিবিম্ব হবে। তাই এর নাম ‘প্রতিবিম্ব স্থল’। ইয়ার্ডে পাশাপাশি রাখা আছে সিমেন্টের তৈরি সুবিশাল হস্তি বাহিনী। ইমরান কাজী গুণে দেখলো মোট বাষট্টিটি হাতি আছে।
এখানে আছে আম্বেদকর জাদুঘর। জাদুঘরে আম্বেদকরের জীবনীকে চিত্রিত করা হয় তার নানান স্ট্যাচুর মাধ্যমে। চার দিকে চারটি দরজা। বা্ইর থেকে ভবনটিকে মনে হবে যেন চার পাপড়ি বিশিষ্ট একটি ফুল। মাত্র একবার দেখে এই পার্কের নাড়ি নক্ষত্রের বর্ণনা দেওয়া কঠিন। তারপরও চেষ্টা করেছি পাঠকের সামনে এর ন্যুনতম একটি চিত্র অঙ্কিত করতে৷ লাখনৌ ভ্রমণে গেলে অবশ্যই আপনি এই আম্বেতকার পার্কটি ঘুরে আসবেন। অবশেষে অফুরন্ত মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধ্যা নামার আগে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।
নিখাদ নবাবী এই শহরে নাকি ছত্রিশ’শ পার্ক আছে। আমি এসেই শ’খানেক পার্ক দেখেছি। প্রতিটিতেই রয়েছে বাহারি ফুলের রঙিন সমাহার। সকাল সন্ধ্যা বেশ পরিচর্যা চলে গাছগাছালির। এতো দৃষ্টিনন্দন পার্কের দুর্বাঘাস পেতে বসতে না পারার আক্ষেপ এখনো বোধ করি আমি।
লাখনৌজুড়ে নবাবদের স্থাপত্যশৈলীর সমারোহ। আমরা যাচ্ছি আসিফুদ্দৌলার নিদর্শন দেখতে। আসিফুদ্দৌলা ছিলেন আওধের নবাব। পৈতৃক সূত্রে নবাবী লাভ করেই ফিরোজাবাদ থেকে রাজধানী লাখনৌতে স্থানান্তরিত করেই শহরটির চেহারা পালটে দিয়েছিলেন। তার তিনটি স্থাপনা চারশ বছর পর আজও আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।
আসিফি মসজিদ তার অনন্য সৃষ্টি। তিনটি গম্বুজ আর দুটি মিনার নিয়ে গঠিত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি। সময় কম থাকাতে মসজিদের ভেতরে আমরা যেতে পারিনি। পাশেই ১৮৭৪ সালে আসিফুদ্দৌলা নির্মাণ করেছেন বড় ইমাম বাড়া। শিয়াদের তীর্থস্থান এটি৷ চারপাশে বাহারি রকমের ফুল গাছে ঘেরা, সামনে সবুজ দুর্বাঘাসের বিস্তৃত মাঠ। বড় ইমাম বাড়ার ভেতরেই রয়েছে আসিফুদ্দৌলার সমাধি। এখানে আসতে আসতে রাত হয়ে গিয়েছিলো তাই ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এখানকার সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস ভুলভুলাইয়া গোলকধাঁধার ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। তৎকালীন আসিফ উদ দৌলা ১৭৮৫ সালে আজব এই গোলক ধাঁধাটি নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলে, ১৮ শতকের শেষভাগে অযোধ্যায় দুর্ভিক্ষ আর বেকারত্ব সমস্যা দেখা দিলে সাময়িক সমাধান হিসেবে বড় ইমামবাড়া এবং ভুল ভুলাইয়া নির্মাণের কাজ হাতে নেন নবাব। উদ্দেশ্য শ্রমিকদের কাজের সংস্থান করা।
এই গোলকধাঁধাঁটিতে পথ রয়েছে এক হাজার চব্বিশটি। কিন্তু বের হওয়ার পথ কিন্তু মাত্র একটি। ফলে এর ভেতরে ঢুকে পথ চিনে আসাটা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার! যদি না পথ চেনা থাকে। পর্যটকেরা তাই গাইড ছাড়া সেখানে প্রবেশের কথা কল্পনাও করেন না।ভুলভুলাইয়ার ভেতরে প্রবেশ করতে না পারায় মনে আক্ষেপ থেকে গেলো৷
ঘোরাঘুরি শেষে এবার নদওয়াত ফেরার পালা। ইমাম বাড়া থেকে নদওয়ায় যেতে হলে রুমি গেইটের নীচ দিয়ে যেতে হয়। রুমি গেইট আসিফুদ্দৌলার অমর কীর্তি।
৬০ ফুট উঁচু এই রুমি দরজা ইস্তাম্বুলের বাব-ই-হুমায়ুনের আদলে নির্মিত হয়েছিল।
আসিফুদ্দৌলা আপাদমস্তক একজন শিয়া ছিলেন। কাজী ইমরান আমাকে জিজ্ঞেস করলো তাহলে কি নবাব সিরাজুদ্দৌলা কি শিয়া ছিলো? ফোড়ন কেটে বললাম, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না তবে জিন্নাহ যে শিয়া এব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ইমরানের মুখ পাংশু হয়ে গেলো। জিন্নাহর বিরুদ্ধে কোন কিছু শুনলে সে খুব কষ্ট পায়৷ কাজী ইমরানের জীবনটা বড় বিচিত্রময়। কৈশোরের শুরুতে বাড়ি থেকে পালিয়ে কাশ্মীর চলে আসা সেই সুজন কুমার আজকের ইমরান কাজী।
বাড়ি ফেনি জেলায়৷ কাশ্মীর এসে জনৈক নদবীর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইণ্ডিয়া এসেছে তের বছর।এই তের বছরে বাংলা প্রায় ভুলতে বসেছে। তবে তার উর্দু অসাধারণ। ইমরানের ইচ্ছে ছিলো সে এমন একটি দেশে যাবে যেখানে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের লোক নেই। আর সেই দেশটি হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানকে সে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। আর এজন্যই সে জিন্নাহর দোষের কথা শুনলে কষ্ট পায়।
লাখনৌ আসবো আর ফিরিঙ্গি মহলে একবার ঢুঁ মেরে যাবো না, তা হতে পারে না? ইসলামী শিক্ষার প্রসার, উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য ফিরিঙ্গিমহল নামে বিশাল এস্টেট ওয়াকফ করে গিয়েছিলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। এখান থেকেই গোড়াপত্তন হয় আমাদের প্রিয় দরসে নিজামীর। ফিরিঙ্গি মহলে এসে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো৷ প্রথিতযশা আলেম উলামার জননী এই পুণ্যভূমির ভবনগুলো আজ শূন্য পড়ে আছে, কোনটিতে বাসাবাড়ি, দুয়েকটি আবার মেস হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে৷ ফিরিঙ্গি মহলে কিছুক্ষণ থেকে ফিরে এলাম নদওয়ায়।
লেখক : শিক্ষক ও পরিভ্রাজক