পণ্য নয় আপনাদের ব্যবহার নিতে এসেছি

পণ্য নয় আপনাদের ব্যবহার নিতে এসেছি

মুহাম্মাদ আইয়ুব :: বাজার ঘাট করতে গেলে আগে বাড়িতে ফোন দিয়ে নিই কি কি লাগবে? পরামর্শ ছাড়া বাজার সদাই করারঅভ্যেস নেই বললেই চলে। দিন দুয়েক আগের কথা, বাজারে গেলাম আম কিনতে। দুই কেজি আম কিনে টাকা দিতে যাব এমনসময় বাড়িতে থেকে ফোন এল, আম কেনার দরকার নেই আফফানের কাকা আম নিয়ে এসেছে।

আমি দোকানদার ভাইকে বললাম, ভাই! দয়া করে মনে কষ্ট নিবেন না প্লিজ! মেহেরবানি করে আমগুলো রেখে দিন। বড় ভাইয়াবাড়িতে আম নিয়ে এসেছে তো তাই এখন আর দরকার নেই দরকার হলে আপনার এখান থেকেই নিব ইনশাআল্লাহ।

কথাগুলো বলতে দেরি, আমার সামনেই আমার জাত উদ্ধার করতে দেরি হলো না ব্যাটার।হুজুররাই সব ঝামেলার মূল! এরাইদেশ নষ্ট করেছে! যত দুই নাম্বরি এদের কাছে! মাল নিবেন না তো মাপাইলেন ক্যান! আপনাগো কাছে মাল বেচা ঠিক না! ইত্যাদি ইত্যাদি!!’

আমি কালক্ষেপণ না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।মনের অজান্তেই কখন যে চোখ দিয়ে পানি টপকে পড়ল টেরই পেলাম না।মনে মনে ভাবলাম আর কোনদিন নিজে বাজার করব না প্রয়োজনে না খেয়ে থাকব! আমাদের সমাজের প্রায় দোকানদারেরই তোআচার আচরণ এমনই, আহ! ক্ষোভ আর কষ্টে নীরব মনে ভাবছি করোনা আমাদের সমূলে কেন গিলে না? কেন আজ বন্যারপানি আমাদের চুবিয়ে মারছেন না? গর্ব করার বা বেঁচে থাকার কি অধিকার আমাদের আছে?! মুসলমান?  নবীজীর উম্মত? আল্লাহর বান্দা? ওয়াক থু!

বাড়ি যাচ্ছি আর এসব হাবিজাবি কথা ভাবছি। আচ্ছা লেনদেন, মুআমালা, উঠা বসা তো আমরা বাঙালীরা একা করিনা অন্যদেশ, অন্য জাতি, অন্য ধর্মের মানুষও তো করে। আমার কাছে তাদের লেনদেন আচার আচরণ আমাদের বাঙালী মুসলমানথেকে অনেক ভাল মনে হয়েছে, এক্ষেত্রে তারা আমাদের থেকে হাজার গুণ ভাল বলে আমি স্বীকার করি। বাস্তব জীবনের দুটিঘটনা এখানে উল্লেখ না করে পারছিনা।

এক.

২০১৬ সালের কথা। পড়তে গিয়েছি দারুল উলূম দেওবন্দে। দেওবন্দে যেয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি, সালমান ভাই আর ইমরানদেওবন্দের বাজারে গেলাম কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে। কৌতূহল বশতঃ আমরা একটি ঘড়ির দোকানে ঢুকলাম। নানানরঙের ঘড়ি দেখছি, এটা নামাতে বলছি ওটা নামাতে বলছি।

যখন দোকানদার পাঁচ সাতটা ঘড়ি আমাদের দেখাল তখন আমরা অন্য ঘড়ি দেখতে কিছুটা ইতঃস্তত বোধ  করতে লাগলাম।দোকানদার আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে যা বলল তা শুনে আমরা হা করে রইলাম! বিক্রেতা বলল, ‘তোমরা ক্রেতা আমিবিক্রেতা, তোমাদের কাজ হল দেখা আর আমার কাজ দেখানো, পছন্দ হলে নিবে, না হয় না নিবে, তাই বলে আমি তো আরআমার দেখানোর কাজ বন্ধ করতে পারিনা! যদি তোমরা সন্ধ্যা  পর্যন্ত দেখতে চাও আমি দেখাতে বাধ্য এটাই যে আমার কাজ!’

আমরা তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম। তার কথাগুলো আমাদের এত ভাল লেগেছে যে, আমরা তিনজনই সেদিনতিনটি ঘড়ি কিনে ফিরলাম। আর পরস্পর বলাবলি করতে লাগলাম যে, বিদেশ না আসলে তো কোনদিনই আমরা কূপ থেকেবের হতে পারতাম না, আমাদের দেওবন্দ আসা স্বার্থক!

দুই.

দেওবন্দে একটি বড় কাপড়ের দোকান আছেমহেশ চান্দ অজয় কুমার জৈননামে। বাংলাদেশের প্রায় সকল ছাত্ররাই সেইদোকান থেকে কাপড় কিনে। বাঙালি ছাত্রদের কাছেমহেশ চান্দঅনেকটা প্রবাদের মতো। দেওবন্দেমহেশ চান্দ’ ‘মহেশ চান্দনাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা একবার আমরা তিনজন মিলে গেলাম মহেশ চান্দ দেখতে। দেওবন্দ এলাকায় যদিওমহেশ চান্দেরকাপড়ের দোকান খুব প্রসিদ্ধ কিন্তু বাহির থেকে দেখে এর প্রসিদ্ধী বুঝার কোন উপায় নেই কারণ বাহিরের চাকচিক্যনয় বরং পণ্যের পাশাপাশি তার নামডাক যে অন্যখানে!

আমরা মহেশ চান্দের দোকানে গিয়ে রংবেরঙের কাপড় দেখতে লাগলাম। খানিকবাদে ঘড়ির দোকানের সেই ইতস্ততা আমাদেরঘাড়ে ভর করল কারণ আমরা যে বাংলাদেশের দোকানপাটে ঘুরে ঘুরে এই রোগ বাধিয়ে বসেছি! ব্যবসায়ী মহোদয় আমাদেরকেঅভয় দিয়ে বললেন, ‘যত মন চায় দেখ কিনতে হবে না, আমরা তোমাদের সেবক।

প্রিয় পাঠক! পিলে চমকে যাবার মতো কথা না?! আসলে সেদিন আমাদেরও পিলে চমকে উঠেছিল আরে দাদা বলে কি? সেদিনথেকে অন্যদের মতো আমরাও মহেশ চান্দের ভক্ত হয়ে গিয়েছি তার ব্যবহারে। হিন্দু হলে কি হবে এর ব্যবহারটা যে পুরোইসাহাবীদের মত। ওদের ব্যবহার দেখে আমরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, কেউ কাপড় কিনতে চাইলেইমহেশ চান্দ, মহেশ চান্দদেওবন্দে থাকাকালীন অনেক বারই মহেশের দোকানে যাওয়া হয়েছে, তিন জন মিলে হাজার হাজার টাকার কাপড় কেনা হয়েছে!

একবারের ঘটনা, আমি কয়েকজনকে নিয়ে মহেশে গেলাম কাপড় কিনতে। এবার অন্যরা কিনলেও আমি  আর কিনলাম না। তোবয়ষ্ক একজন বলল, মুলি সাব! (মৌলভী সাহেব) তুমি আজ কিছু কিনবে না? মুচকি হেসে বললাম, বাড়িতে চলে যাব তো তাই, আজ পণ্য নয় আপনাদের ব্যবহার নিতে এসেছি।

লেখক: শিক্ষক প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *