পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিকাশে মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক
শেখ নাইমুল ইসলাম : অনেকেই বলেন ‘পলিটিক্স ইজ এ গেম’ বা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এর সবথেকে বড় উদাহরণ বোধহয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মত এত বৈচিত্র্যময় নির্বাচন বাংলাদেশে এর আগে অনুষ্ঠিত হয়নি। বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যখন কুল কিনারা না পেয়ে নৌকায় করে বৈতরণী পার হন, আবার কেউ যখন সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কপচিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার মসনদে বসাতে উদোম গায়ে মাঠে নামে, তখন যে রাজনীতির খেলাটা জমে ওঠে তা হতাশার এবং শঙ্কার সৃষ্টি করে৷
এ তো গেল যারা রাজনীতি করেন ক্ষমতা চর্চা করার জন্য তাদের অবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বরং বলা ভালো ‘পরজীবি রাজনীতি’ করেন, এবারের নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা চোখে পড়েছে বেশি। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন যাদের ভেল্কিবাজী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সিলেট ৫ আসন থেকে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষে নির্বাচন করেছেন কওমী অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় পরিচিত মুখ হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক। আশির দশকে কওমী মাদরাসার বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন লাজনাতুত্তালাবার মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করে পরে জমিয়তের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। জামায়াতে ইসলামী তথা মওদুদীর ইসলাম বিকৃতি, নবী-রাসূল ও সাহাবা বিদ্বেষী দর্শনের যারা শক্ত সমালোচনা করেন তিনিও তাদের মাঝে একজন ছিলেন।
যে কারণে কওমী মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে তিনি আলাদা একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের সাথে এক মিটিংয়ে তিনি সবার সামনে কওমী মাদরাসা তথা সঠিক ইসলামের যে দর্শন ও বিশ্বাসকে তিনি জীবনভর প্রচার করেছেন, তা জলাঞ্জলি দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর দ্বীন বিকৃতির দর্শনের সাফাই গাইলেন এবং জামাতবিরোধী সব লেখা ও বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। যেন একজন নওমুসলিম তার পূর্ববর্তী ধর্ম বিশ্বাসকে ত্যাগ করে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাচ্ছে, ‘মওদুদীবাদী তওবা’ করে তার আসল পরিচয়ে ফিরে আসছে।
কওমী মাদরাসার ইতিহাসে কোন নেতৃস্থানীয় আলেমের ক্ষমতার মসনদে বসার লোভে প্রকাশ্য নবী-রাসূল ও সাহাবা বিদ্বেষী, মানবতাবিরোধী অপশক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়ার, তাদের সাথে আঁতাত করার ঘৃণিত লজ্জাজনক এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি আর নেই।
দুঃখের বিষয়, এত কিছুর পরেও তার এমপি হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। অনেকেই বলছেন সিলেটের কানাইঘাট-জকিগঞ্জে বিএনপি জামায়াত কিছুটা শক্তিশালী হলেও প্রথম জীবনে হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুকের আদম ব্যবসার মাধ্যমে অনেক সাধারণ মানুষ প্রতারিত হওয়ায় এবং ব্যক্তিজীবনে তিনি ত্যাজ্যপুত্র হওয়ায় নিজ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ইমেজ রয়েছে তার। ফলে জামায়াতের কাছে সাধু হয়ে উঠলেও জনগণের কাছে অসাধুই রয়ে গেছেন। নির্বাচনেও তাই এর প্রভাব পড়েছে।
যদি এই কারণগুলো বাদও দেওয়া হয় তবুও হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক জিততে পারতেন কি না সন্দেহ। কারণ ইমামতি আর মাদরাসায় পড়ানো ব্যতীত কোন আলেম যোগ্য জনপ্রতিনিধি হতে পারেন এই বিশ্বাসযোগ্যতা আম জনসাধারণের মাঝে আলেম সমাজ তৈরি করতে এখনও সক্ষম হননি। এতদসত্ত্বেও ইতোপূর্বে একবার জনগণ পরীক্ষামূলক সু্যোগ জনাকয়েক আলেমকে দিয়েছিলো, কিন্তু জনগণের আস্থার প্রতিদান দিতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। সেই সাথে ভবিষ্যতে কারো সুযোগ পাওয়ার দরজাও নিজেদের ব্যর্থতায় বন্ধ করে দিতে ‘সফল’ হয়েছেন।
হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক সাহেবের জন্য একরাশ করুণা। এতদিনের পুঞ্জিভূত আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে মওদুদী জামায়াতের সাথে আঁতাত করে কি পেলেন হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক তা তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু হারিয়েছেন অনেক কিছু। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। পদ্মা মেঘনা যমুনা যতদিন বইবে ততদিন হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক নামটি আদর্শচ্যুতির চরম উদাহরণ হিসেবে থাকবে। এমন মাওলানা ও দেখতে হয়েছে এই বাংলাদেশ কে।
মনে প্রশ্ন জাগে, যে লোক ক্ষমতার জন্য আদর্শ বিচ্যুত হয়, ঈমানের সাথে আপোস করে, ইসলামের বিকৃতকারীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়, সে ক্ষমতায় গিয়ে কোন ইসলাম কায়েম করবে?
এতদিন ধরে ছাত্রদের যে আপ্তবাক্য তোতা পাখির মত মুখস্থ করিয়েছেন আর এখন যা করলেন, এর কোনটি সঠিক কোনটি মিথ্যা? দেওবন্দী আকিদা-বিশ্বাস সত্য না মওদুদীবাদ? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কি হক-বাতিলে ভাই ভাই হয়ে যায়? যেই মাদানী রহ.কে বিক্রি করে তিনি বা তার দল রাজনীতি করেন সেই মাদানী রহ. সত্য না কি মওদুদী?
খুবই অবাক হতে হয় এ সব রাজনৈতিক উলামায়ে কেরাম আবার কওমী মাদরাসার মত এমন আদর্শভিত্তিক, সঠিক ইসলামের ধারক বাহক একটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক তাদের নেতৃত্ব আনন্দ চিত্তে মেনেও নিচ্ছেন । শুধু মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক নন, ধর্মীয় রাজনীতির সাথে জড়িত প্রায় সব ব্যক্তিদের চরিত্রই কমবেশি এমনই। সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন দুইটা দল ছাড়া বাকি সব ধর্মীয় দল জনবিচ্ছিন্ন, গণমানুষের সাথে কোন সম্পৃত্ততা নেই। এই নেতাদের সবথেকে বড় হাতিয়ার হলো মাদরাসার ছাত্র এবং ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট। ২০০১ সালে সেই সেন্টিমেন্ট পূঁজি করে উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে কওমী ছাত্রদের লাশের উপর ভর করে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। ২০১৩ সালেও সেই সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে সরকার পতনের একটি নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিলো। কিন্তু বিধি বাম, জনগণের সমর্থন না থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি।
সাতচল্লিশে ধর্মকে ব্যবহার করে কোটি মানুষের রক্তের উপর দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম। যে মরলো আর যে মারলো কেউই জানে না কেন তারা মারলো আর মারা পড়লো। ঠিক তার তেইশ বছর পর নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়েছে ধর্মের নামে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাতচল্লিশ বছর পর এখনো রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার চলছে ধর্মকে বিক্রি করে। ইসলাম এখানে বড় অসহায়। এখানে খুনি ধর্ষক হয় ধর্মীয় বিপ্লবের নায়ক। এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় মাদরাসার কোমলমতি ছাত্রদের, তাদের রক্তমাখা লাশের উপর দিয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে বড় বড় পীরমাশায়েখ, শায়খুল হাদীসগণ। এখানে অস্ত্রের মুখে ছাত্রদের ফেলে রেখে পকেটে লন্ডনের টিকেট নিয়ে ইসলামের হেফাজত করে জিন্দা শহীদ। এখানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছাত্রদের উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে একটি সিট পাকাপোক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস-বাড়ি করতে করতে স্যান্ডেলের শুকতলা ক্ষয় করে ইসলাম রক্ষার টেন্ডারবাজরা।
আমাদের আকাবিরগণ বলেছিলেন, ভারতে মুসলমান বিপদে থাকতে পারে কিন্তু পাকিস্তানে স্বয়ং ইসলাম বিপদে থাকবে। সেদিনের পাকিস্তানের অংশ আর আজকের স্বাধীন বাংলায় এই ধর্মব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে ইসলাম যে আর কতকাল ‘খাতরে মে’ থাকবে, তা উপরওয়ালাই ভালো জানেন। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার কি আদৌ থামবে? দম দেয়া পুতুলের মত আর কতকাল কওমী মাদরাসার ছাত্ররা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে? মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুকের মত উলামায়ে কেরাম আর কতকাল ধর্মের কল নাড়বেন?
লেখক : তরুণ আলেম ও রাজনীতি বিশ্লেষক