পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : জুম চাষ পাহাড়ি এলাকায় প্রচলিত এক ধরনের কৃষিপদ্ধতি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ পাহাড়িই জুম চাষী। চাসীদের ঘরে উঠছে জুমের পাকা ফসল। ফলন ভালো হয়েছে বলে হাসি ফুটেছে চাষীদের মুখে। তাদের চোখে মুখে এখন শুধু আনন্দের ছাপা দেখা যায়। পাহাড়ে এখনও জুমের পাকা ধান কাটার ধুম লেগে আছে। এছাড়া ঘরে তোলার অপেক্ষায় তিল, তুলা, যব, ভুট্টাসহ আরও নানা ফসল। যার কারণে চাঙ্গাভাব এসেছে পাহাড়ের অর্থনীতিতে। পাহাড়ে খাদ্য চাহিদার অনেকটায় মেটায় জুম চাষ। আদিকালে জুমিয়ারা শুধু নিজেদের সারা বছরের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য পাহাড়ে জুম চাষ করত। কিন্তু বর্তমানে জুমে উৎপাদিত ফসল-সবজি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হচ্ছে পাহাড়িরা।
রাঙ্গামাটির চাষীরা জানান, পাহাড়ে এখন জুমের পাকা ফসল ঘরে তোলার ভরা মৌসুম চলছে। পাকা ধান ঘরে তোলা হচ্ছে। এর আগে মরিচ, মারফা, চিনার, ঢেঁড়স, ধুন্দুল ইত্যাদি ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। ধান কাটা শেষ হওয়ার পরপরই ঘরে তুলে বাজারে বিক্রি হবে তিল, যব, তুলাসহ আরও কিছু ফসল। উপযুক্ত আবহাওয়া ও মাটির উর্বরাশক্তির কারণে এ বছরও জুমে ভালো ফলন হয়েছে। এই জন্যে আমরা খুব আনন্দিত।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহায়তায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগসহ চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় জুমের ফলন ভালো হয়েছে বলে জানান চাষীরা। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক পবন কান্তি চাকমা বলেন, আমরা জরিপ করে দেখেছি এ বছর রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় জুম চাষে খুব ভালো ফলন হয়েছে। ফলে জুমচাষীদের পারিবারিক অর্থনীতিতে এসেছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
জুমে ধান ছাড়াও স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে। স্বল্প মেয়াদি ফসল ধান ও শাকসবজির পাশাপাশি কলা, আনারস, পেঁপে, কমলা, পেয়ারা, আম ইত্যাদি ফলমূলের চাষ হচ্ছে। আমরা উন্নত ফলনে জন্যে জুম চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দিচ্ছি। জুম চাষীরা পৌষ ও মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল সাফ করেন। রোদে শুকিয়ে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে প্রস্তুত করেন জুমেক্ষেত। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে পোড়ানো জুমের মাটিতে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধান, তুলা, কাউন, ভুট্টা, ফুটি, চিনার, শিম, যব ইত্যাদি বীজ বপন করেন। জুমজুড়ে ছিটানো হয় তিল, মরিচ, ধনেপাতাসহ ইত্যাদি বীজ। প্রায় ৮-৯ মাস পরিশ্রম শেষে ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ঘরে ওঠে পাকা ধান। তার আগে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসেই জুমের ফসল তোলা শুরু হয়।
রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ বান্দরবন জেলার সাত উপজেলায় জুমের ফসল ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চাষীরা। পরিবারের সবাই জুমের ধান কাটতে নেমেছে পাহাড়ের জুম ক্ষেতে। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের আয়োজনও।
কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছর জেলায় প্রায় ৮ হাজার ৯৮৮ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। গত বছর ২০১৭ সালে জুম চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ১২ হাজার ৭৩৫ টনের বেশি ফসল উৎপাদন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ভবতোষ চক্রবর্তী জানান, জেলায় প্রতি বছর জুমের চাষ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ বছর জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে। পাহাড়ের জুম চাষ থেকে জুমিয়ারা সারা বছরের খাদ্য সংরক্ষণ করে। জেলায় বসবাসরত ম্রো, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, লুসাই, চাকমা, পাংখো, বম, চাক’সহ ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশরাই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ পাহাড়ি এখনও জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রো সম্প্রদায় আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের জীবিকা সংগ্রহ করে। জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন লাগান।
আর মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করেন। প্রায় ৩/৪ মাস পরিচর্যার পর বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু করে জুমিয়ারা। চিম্বুক সড়কের ম্রোলং পাড়ার জুমচাষী মেনুলু ম্রো, রিংরাং ম্রো বলেন, এ বছর জুমের ভালো ফসল হয়েছে। পাহাড়ে প্রায় পাঁচ-সাত একর জমিতে জুম চাষ করে ধান’সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি লাগিয়েছি। জুমের পাকা ধান কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বান্দরবানের উপ-পরিচালক মো. আলতাফ হোসেন জানান, জুমে উৎপাদিত ফসল এ অঞ্চলের খাদ্য চাহিদার অনেকাংশই পূরণ করে। এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা অনেকটায় সচল রাখছে জুম চাষ। পাহাড়ের অর্থনীতিতে জুম চাষের বিকল্প নেই।