‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু উত্তর গাজায়: জাতিসংঘ

‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু উত্তর গাজায়: জাতিসংঘ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধ শুরুর প্রায় সাত মাস পর উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে ‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

তবে খুবই স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে দুর্ভিক্ষের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক নানা হিসাব–নিকাশ। এ ছাড়া নিশ্চিত করতে হবে কত মানুষ মারা গেছেন সে বিষয়টিও।

গত রোববার এনবিসির সম্প্রচার করা এক সাক্ষাৎকারে ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন বলেন, ইসরায়েলের অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে গাজাবাসী দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এরই মধ্যে এ উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। গাজার বাসিন্দাদের চূড়ান্তভাবে একঘরে করে ফেলেছে ও এখানকার একাংশকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে এটি। দুর্ভিক্ষ এখন ছড়িয়ে পড়ছে গাজার দক্ষিণে।

ত্রাণসহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, আকাশ ও সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সরবরাহ করা ত্রাণ গাজার ২৩ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁদের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ অপুষ্টির শিকার হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। এ ছাড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের বিকাশ এবং ক্ষুধায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
ওই সাক্ষাৎকারের পর ডব্লিউএফপির একজন মুখপাত্র দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার তিনটি মানদণ্ডের একটি উত্তর গাজায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরেকটি প্রায় পূরণ হয়েছে।

বেশি সংখ্যায় স্থল ক্রসিং খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে গাজায় আরও ত্রাণ সরবরাহ পৌঁছানোর সুযোগ দিতে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছে ইসরায়েল। ত্রাণসহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, আকাশ ও সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সরবরাহ করা ত্রাণ গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁদের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ অপুষ্টির শিকার হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। এ ছাড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের বিকাশ এবং ক্ষুধায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষের প্রথম শর্ত চরম খাদ্যসংকট পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় শর্ত, শিশুদের তীব্র অপুষ্টিও ইতিমধ্যে প্রায় পূরণ হয়েছে। তবে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যার শর্ত এখনো যাচাই করা সম্ভব হয়নি। চলতি মাসে গাজার বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে গত মার্চ মাসে ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) এক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়। বৈশ্বিক এই উদ্যোগে অংশীদার হিসেবে যুক্ত রয়েছে ডব্লিউএফপি। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রায় এক–তৃতীয়াংশ মানুষ চূড়ান্ত রকম ক্ষুধার শিকার এবং আগামী জুলাই মাসের মধ্যে তা অর্ধেকে উন্নীত হতে পারে। আইপিসির পরবর্তী প্রতিবেদন জুলাইয়ে প্রকাশিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরুর যেকোনো ধরনের দাবি জোরগলায় নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল। সিন্ডি ম্যাককেইনের অনুমান সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছে দেশটির মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা। এদিকে গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়া নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতে পারে। এ আদালতে তেল আবিবের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।

আইপিসির বক্তব্য অনুযায়ী, একটি জায়গায় তিনটি বিষয় ঘটলে সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে বলা যাবে। এগুলো হলো, ২০ শতাংশ গৃহস্থালিতে চরম খাদ্যসংকট থাকবে বা বাস্তবিক অর্থে ক্ষুধার উপস্থিতি দেখা দেবে; অন্তত ৩০ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার বা শারীরিকভাবে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পতিত হবে এবং ক্ষুধা ও এ–সংক্রান্ত জটিলতায় প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক দুই ব্যক্তি বা চারটি শিশু মারা যাবে।

ডব্লিউএফপির জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র স্টিভ তারাভেলা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষের প্রথম শর্ত চরম খাদ্যসংকট পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় শর্ত, শিশুদের তীব্র অপুষ্টিও ইতিমধ্যে প্রায় পূরণ হয়েছে। তবে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যার শর্ত এখনো যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ত্রাণসহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, সাত মাস ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় উত্তর গাজার অধিকাংশ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র বা হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ। সেই সঙ্গে উপত্যকাটিতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখান থেকে মৃত্যুর সঠিক তথ্য জোগাড় করা কঠিন।

দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যা নিয়ে গত মার্চে এক নথিতে আইপিসি উল্লেখ করেছে, কোনো একটি এলাকাকে ‘যুক্তিসংগত প্রমাণসহ দুর্ভিক্ষকবলিত’ বলা যাবে, যদি সেখানে ওই তিনটি শর্তের দুটি পূরণ হয়। গাজা থেকে পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্লেষকদের ধারণা, শর্ত তিনটির প্রথম দুটি সেখানে মিটেছে। সম্ভবত তৃতীয়টিও পূরণ হয়েছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর উপত্যকাটির সঙ্গে সব সীমান্তপথ বন্ধ করে দেয় দেশটি। পরে ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ সেখানে কোনো ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দেয়নি। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, তখন থেকে গাজায় সহায়তাসামগ্রী পাঠাতে ব্যাপকভাবে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর আগে দৈনিক প্রায় ৫০০ ট্রাক ত্রাণ পৌঁছানো হতো সেখানে। ইসরায়েলি বাধার মুখে ত্রাণবাহী এ ট্রাকের সংখ্যা একেবারে কমে যায়। মার্চে ইসরায়েল এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিলে তখন থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৭১টি ট্রাক প্রবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফ্যামিন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমস নেটওয়ার্ক’–এর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সাইদ সিয়াম গাজা সিটির বাসিন্দা। ১৮ বছরের এ তরুণ বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর তিনিসহ তাঁর পরিবারের সব সদস্য অন্তত ১০ কিলোগ্রাম করে ওজন হারিয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহ জিনিসের দাম কিছুটা কমেছে। তারপরও এখন দৈনিক এক বেলা মূলত কুমড়ার স্যুপ খেয়ে বেঁচে থাকছেন তাঁরা। বাজারে ফলমূল, শাকসবজি ও মাংস নেই বললে চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *