প্রিয় উস্তাদের দীর্ঘস্থায়ী শোকসভায় | আমিন আশরাফ

প্রিয় উস্তাদের দীর্ঘস্থায়ী শোকসভায় | আমিন আশরাফ

প্রিয় উস্তাদের দীর্ঘস্থায়ী শোকসভায় | আমিন আশরাফ

বাড়িতে ঢুকবার আগেই পুকুর পাড়টাতে দাঁড়িয়ে কবরস্থানের সে পাশটাতে তাকালাম। যেখানটাতে খুব নীরবে শুয়ে আছেন সেই তিনি; যার দরাজ কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হতো শহীদী মসজিদের মিহরাবে, আত্মাশুদ্ধির মঞ্চে। শীত মৌসুমে দূর-বহুদূর থেকে ভেসে আসতো কুরআন তেলাওয়াতের সুমিষ্ট আওয়াজ। মনে হতো মহান আল্লাহ কাউকে দায়িত্ব দিয়েছেন এতো মধুর করে কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য। সেই তিনি দায়িত্বটা সুচারুপে পালন করে যাচ্ছেন।

রাত বারোটার কাছাকাছি সময়। আরেকটু এগিয়ে তাঁকে দেখে যাবার ইচ্ছে জেগেছিল। কারণ সারাদিন তাঁর কাছে যেতে পারেনি। আজ তাঁর হাতে গড়া প্রতিটি ইমারতকে বিষন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে, তাঁকে দেখতে যেতে পারছে না বলে। ওদের কান্না দেখে মাগরিবের নামাজে আমিও কাঁদলাম। অনেক কাঁদলাম।

বাসায় ফেরার আগে খুব নীরব নিস্তব্দ কবরের পাশাটাতে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি। আপনি কেমন আছেন? ভয় পাচ্ছেন না তো! না-না একদম ভয় পাবেন না। পাশে আপনার মা আছেন, আছেন ছোট ভাইও। এখন থেকে দয়াময় প্রতিপালকই আপনার সমস্ত দেখভাল করবেন। একা ঘরে আপনি ভয় পেলেও এখানে ভয় পাবার কিছু নেই। মহান আল্লাহ ঠিক তেমন করে আপনার দেখভাল করবেন যেমন করে তিনি আপনার মায়ের পেটে পালন করেছিলেন। আপনার জন্য আমাদের কান্না থামছে না। প্রতিটি মুহূর্ত হু-হু করে ওঠছে হৃদয়ের অলিন্দ। প্রতিটি মানুষের মনের বিষণ্নতার অন্ত নেই। মাঠে ময়দানে আপনার বয়ানের ভিডিওগুলো আমার ভেতরে কাঁপন তোলে যাচ্ছে। আমি সহ্য করতে না পেরে তাড়াতাড়ি ভিডিওগুলো বন্ধ করে ফেলি।
আজও আপনার কবরের ওপর হাই ভোল্টেজের লাইট দুটো জ্বলছে। পায়ের দিকে একটা বড়ই গাছে মৃদু বাতাস দুলছে। বড়ই গাছের বড়ইগুলোও আস্তে আস্তে আপনাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। বলছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মহান আল্লাহর ফেরেশতারা আপনাকে সাদর সম্ভাষণ দিয়েছেন। আপনার জন্য আসমানে ঘোষণা হয়েছে চির মুক্তির। আমাদের কান্নার প্রতিটি অশ্রু ফোটা আপনার উঁচু মাকাম প্রাপ্তির জন্য হাহাকার করছে। মসজিদে খানকাহে প্রতিটি হৃদয় কান্নায় ভেঙে পড়ছে। জানেন কী আপনাকে আমরা কতোটা ভালোবাসি। মনে হলেই আপনার জন্য পড়ে যাচ্ছি, সুরা ফাতিহা, ইখলাস ও ইয়াসিন।
হৃদয়হীন মানুষও আপনার জন্য অশ্রু ঝরাতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না।

তিরতির কাঁপন তোলে বাতাস বইছে। দূর থেকে লাইটের আলোতে আপনার কবরের উপর নীল আলো আছড়ে পড়ছে। দৃশ্যটা মনে হচ্ছে, অন্যলোকের। অন্য জগতের।

আজও কি আপনার প্রিয়তমা মিনুর কথা মনে হচ্ছে! মিনুকে চেনেন না। মিনারা চৌধুরীর কথা। তাঁকে নিয়ে আপনার সে কী তুমুল প্রশংসা। সে কি নির্মোহ আবেগ! সেই মিনারা চৌধুরির কথা না হয় আরেকদিন বলি।

আজ আপনার কথাই হোক। আপনি বলতে পারবেন না; শুনতে পারবে না কী না তাও জানি না। তবু বলে যাই। পাশের কবরগুলো নীরব হয়ে শুনে যাক আপনার কীর্তির কথা। আপনার সাহসের গল্পগুলো। আপনার দীনপ্রেমের কথা। আপনার আল্লাহপ্রেমের বন্দনা। রাসুলের প্রতি বিরহ ব্যথার কথা।

এই তো বছর খানেক আগের কথা। ডিসেম্বরের শেষের দিকে আপনি বলছেন আপনি ইদানিং আপনার বাবাকে আতহার আলী রহ. কে খুব বেশি স্বপ্ন দেখছেন। কথাটা শুনে বেশ চমকে উঠেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আপনি কেন ঘনঘন বাবাকে স্বপ্ন দেখতেন।

আপনার চলে যাবার কথা কী বুঝতে পেরেছিলেন? বুঝতে পেরেছিলেন বলেই কী ব্যাংকক যাবার আগে এতো করুণভাবে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন?

আপনি একা ঘরে থাকতে পারতেন না। সেটা আমরা জানি। ঘটনাটা আপনার আম্মা আপনাকে বলেছিলেন। তখন আপনার বয়স ৬ মাস। শহীদী মসজিদের নির্মাণ কাজ চলছে। তখন মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানি রহ. কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন। শ্রমিকরা নির্মাণ কাজ করার সময় বড় একটা সিমেন্টের স্লেপ অসতর্কতাবশত উপর নিচে ফেলে দিয়েছিল। বিকট শব্দ হয়েছিল। সে শব্দে আপনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন। অনেক ভয়! সেই থেকে শুরু আপনার ভয় পাওয়া। অবাক করা ব্যাপার হলো, এরপর থেকে আপনি কখনো একা রুমে থাকতে পারতেন না। জিন পরীর ভয় না। এমনিতে একা রুমে থাকতে আপনার ভয় লাগতো। সে ভয় আপনার শেষ বয়স পর্যন্ত গড়ালো।

মহান আল্লাহ খুব কমই আপনাকে একা থাকতে দিয়েছেন।এখনও আপনাকে তিনি একা রাখবেন না। চারপাশে তিনিই আপনার পাশে থাকবেন। আমাদের প্রতিনিয়তের নীরব কান্না আপনার উঁচু মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য নিবেদিত হতে থাকবে।

রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
লেখক : কবি ও গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *