ভাগ্যান্বেষণে নারী শ্রমিকদের বিদেশ গমন

ভাগ্যান্বেষণে নারী শ্রমিকদের বিদেশ গমন

শ্রম চিন্তা। অনন্যা রানী মন্ডল

ভাগ্যান্বেষণে নারী শ্রমিকদের বিদেশ গমন

কুমিল্লার জেলার মুরাদনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রাম। এই গ্রামের মেয়ে দুলারী জাহান দুলু। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হননা। অথচ এমন একটা সময় ছিলো ঘরের বাইরে সারা দিন নানা কাজে দিন কাটতো তার। অত্যন্ত কর্মঠ, উদ্দীপনাময় এক সদাহাস্য তরুণী ছিলো। সামাজিক কর্মযজ্ঞে ছিলো সবার আগে। মাত্র প্রাইমারি অবধি পড়াশোনা করেছে দুলু। মাতৃহারা দিনমজুর পিতার একমাত্র কন্যা দুলুর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় সেই শুরুতেই। এরইমধ্যে পিতা দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হলে তীব্র অভাব সংসার নামক আশ্রয়স্থলটিকে তছনছ করে দেয় নিমিষেই। উপায়ন্তর না দেখে কিশোরী বয়সে কর্মক্ষেত্রে নেমে পড়ে সে। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করে সংসার চলছিল, এর পাশাপাশি সেলাই প্রশিক্ষণ নিতে থাকে দুলু।
এরইমধ্যে পরিচয় ঘটে আবুল বাশার নামে রিক্রুটিং এজেন্টের দালালের সাথে।

সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে মাধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে গিয়ে মাসে প্রচুর টাকা উপার্জন করার লোভনীয় প্রস্তাব দেয় আবুল বাশার। ভাবনায় পড়ে যায় দুলু, জন্ম থেকেই অভাব আর দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে তাকে। এভাবে আর কতকাল, ভাবে দুলু। তাছাড়া টাকার ব্যবস্থা হলে পিতার উন্নত চিকিৎসা হবে। এতসব ভেবে সে একটা সিন্ধান্ত নেয়। আবুল বাশারের প্রস্তাবে রাজি হয় এবং ভিটেবাড়ি সত্তর হাজার টাকায় বন্ধক রেখে মাত্র তিনসপ্তাহের মাথায় দুলু পাড়ি জমায় সৌদিতে। সৌদিতে গিয়ে এক ফলব্যবসায়ী ও তার চার স্ত্রীর সংসারে গৃহপরিচারিকার কাজে। প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিলো সময়। উনিশ বছর বয়সী যুবতী দুলু সব কাজ একাই সামাল দিতো।

প্রাণপণ প্রচেষ্টা ছিলো মালিককে খুশী করার। ভাষার ক্ষেত্রে অসুবিধা হলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। তাছাড়া ফল দোকানের একজন কর্মচারী ছিলো ভারতীয়, সেও যথেষ্ট সহযোগিতা করতো। কিন্তু ছয় মাস না পেরুতেই শুরু হয়ে যায় নানা অজুহাতে নির্যাতন। মাঝে মাঝে যৌন নির্যাতনও করতো বাড়ির মালিক। শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও কাজ করতে হতো তার। একদিন মালিকের ফলদোকানের কর্মচারী আশোকের সহযোগিতায় পালায় দুলু।

পালিয়ে মক্কায় চলে আসে এক বাঙালী পরিবারের কাছে। তাদের চেষ্টায় দুলু ফিরে আসে নিজ দেশে নিজ গ্রামে। লজ্জা, ঘৃণায় গৃহবন্দি হয়ে হয়ে থাকে।

দুলুর মতো বাংলাদেশের অনেক নারী বিদেশে চাকুরিতে গিয়ে নানভাবে অপদস্থ হচ্ছেন। গৃহকর্তা-কর্ত্রীদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও মুজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রবাসী নারী শ্রমিকরা। এশিয়াসহ মাধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশসমূহ থেকে সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে দেশে ফিরতে হয়েছে। যার মধ্যে সৌদি আরব, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ওমান, জর্দান ও কাতারে নানাপ্রকারের দুভোর্গ ও দুর্দশার শিকার হচ্ছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, বিদেশ থেকে কোনো নারী যখন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসেন তখন সে সমাজের চোখে অপরাধী হয়ে যায়। প্রত্যেককেই এমনভাবে দৃষ্টিভঙ্গি দেখায় যেনো সে ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ এ অবস্থার জন্য তার কোনো ভূমিকা নেই। সমাজের উচিত বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো।

বিদেশে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়তে থাকায় পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রবাসী নারী কর্মীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে নানা হয়রানি আর নির্যাতনের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই ফিরে আসতে বাধ্য হন অনেক কর্মী। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানবন্দরে তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের ফিরে আসার কারণ খতিয়ে দেখে দায়ী এজেন্সি এবং নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

বিদেশে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা স্বপ্ন পূরণে পাড়ি জমাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। সরকারি হিসেব মতে, প্রবাসী বাংলাদেশী নারীকর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭লাখে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় এক লাখ আশি হাজার সৌদি আরবে, আরব আমিরাত ও জর্ডানে এক লাখ ২৫ হাজার করে, লেবাননে এক লাখ তিন হাজার এবং ওমানে গেছেন প্রায় ৬২ হাজার কর্মী। হয়রানি, নির্যাতন কমানে গেলে আরো বেশি নারীকর্মী বিদেশে প্রেরণ করা সম্ভব হবে।

প্রকৃতপক্ষে নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত না করে কেনো দেশেই নারী শ্রমিক পাঠানো ঠিক নয় যদিও নারীদের কাজের পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে সরকারের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও এখন আগের তুলনায় কঠোর। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সরকার বরং গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশে না পাঠিয়ে নতুন বাজারগুলোতে দক্ষ নারী শ্রমিক কীভাবে পাঠানো যায় সেদিকে গভীর দৃষ্টিপাত করছে। তাছাড়া নির্যাতনের সংবাদ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে নারীদের দেশে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নির্যাতনসহ নানা কারণে এবছর ফিরে আসা ২৬০ জন নারী শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন সেজন্য তদারকি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে প্রায় সাত লাখ নারী কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসে অবস্থানকালে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা যে কোনো প্রয়োজনে সরাসরি প্রবাস বন্ধু কল সেন্টারে (+৮৮ ০১৭৮৪৩৩৩৩৩৩, +৮৮ ০১৭৯৪৩৩৩৩৩৩, +৮৮ ০২-৯৩৩৪৮৮৮) ডায়াল করে তাদের অভিযোগের কথা জানাতে পারেন। এটি টোল ফ্রি কল সেন্টার। প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাদের সার্বিক সহযোগিতা করবে।

বিদেশে গৃহকর্মীর সাথে প্রতারণা, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করতে বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহের শ্রম কল্যাণ উইং নিয়মিতভাবে সে দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পুলিশ, ইমিগ্রেশন, আইনসেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ, নিয়োগকর্তাসহ ক্ষেত্র বিশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে নিয়মিত মনিটরিং করে। এছাড়া নির্যাতিত নারী কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের জন্যে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি, জেদ্দায় দুটি এবং ওমানে একটি সেইফ হোম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেইফ হোমে তাদের খাবার, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেওয়া হয়। দেশে পাঠানোর জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ে ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নারী গৃহকর্মীদের সাথে প্রতারণা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা , আর্থিক জরিমানা ও প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিল করা হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থসমাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সূচকে নারীরা সমানতালে ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট পেশা থেকে শুরু করে কৃষি, নির্মাণ শিল্প, পোশাক শিল্পে নারীর সচেতন কর্মযোগ সামগ্রিক সমৃদ্ধির নিয়ামক। তবে এখনো নারীর চলার পথ নিরাপদ, নির্বিঘ্ন হয়নি পুরোপুরি। দরিদ্র, নিম্ন বিত্ত পরিবারের নারীদের অধিকাংশই বাস্তুভিটা বিক্রি করে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে উন্নত জীবনের স্বপ্ন পূরণের আশায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হযে যখন নিজ বাসভূমে ফিরে আসে তখন তারা আপনজনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ,ঘৃণা, অপবাদের শিকার হওয়ার পাশাপাশি নিজের পরিবার থেকে পর্যন্ত বিতাড়িত হয়। যা অত্যন্ত অমানবিক। এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা দরকার।

দেশে নারী প্রধান পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীর শিক্ষার প্রসার ঘটছে, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে, একই সাথে নারীর জন্য তৈরি হয়েছে দেশে বিদেশে কর্মক্ষেত্র। দেশের প্রতিটি সেক্টরে এখন নারীদের সফল পদচারণা। শিক্ষিত নারীদের পাশাপাশি অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারীরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলন্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ফলে সমাজে এর প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে। তারা উপার্জনক্ষম হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন।

শ্রমবাজার প্রসারিত করার কোনো বিকল্প নেই। শ্রমবাজার আরো প্রসারিত করতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে ইউরোপের দেশগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন। সে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে, সেসব দেশের চুক্তিগুলো আরো স্পষ্ট ও জোরালো করা জরুরি। বিদেশে নারীকর্মীদের নির্যাতনের থেকে সফলতার হার অনেক বেশি। তারা বিদেশ থেকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে পরিবারে সচ্ছলতা অনছে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। সেসব নারীশ্রমিকদের গল্পগুলো বেশি প্রচার হওয়া দরকার। মিডিয়া এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *