পাথেয় ডেস্ক ● বিশ্ব ইজতেমায় তাবলিগ জামাতের বিশ্ব আমির ভারতের মাওলানা সাদের যোগদানকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের দ্রুত অবসান চেয়েছেন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের একাংশের নেতারা। এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তাঁরা।
রোববার দুপুরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গী অঞ্চল কার্যালয় চত্বরে বিশ্ব ইজতেমার ফলোআপ সভায় বিশ্ব ইজতেমার শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিরা এই দাবি জানিয়েছেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নান, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম বজলুল করিম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি প্রকৌশলী মেজবাহ উদ্দীন, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. রফিকুল ইসলাম, প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।
এ ছাড়া মতবিনিময় সভায় র্যাব, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বিআরটিসি, বিআরটিএ, ডেসকো, তিতাস গ্যাস, টেলিফোন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, এলজিইডি, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর জেলা পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রত্যেকে তাঁদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন।
তাবলিগ জামাতের ও বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বি সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের মাওলানা সাদ সাহেব যদি না আসেন, তবে এটা বিশ্ব ইজতেমা থাকবে না। এটা হবে আমাদের স্থানীয় ইজতেমা, পাকিস্তানি ম্যানেজড ইজতেমা। এটা হবে বাংলাদেশি ইজতেমা, এটা বিশ্ব ইজতেমা হবে না। কারণ অনেক বিদেশি ও দেশের মুসল্লিরা জানিয়েছেন, সাদ সাহেব যদি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ না নিতে পারেন তবে তারা এ ইজতেমায় অংশ নেবেন না। এটা পাকিস্তানিদের একটা চাল। এ ব্যাপারে তিনি সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। এ ছাড়া বিদেশি মুসল্লিদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসার মেয়াদ ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব ইজতেমা সরিয়ে নিতে পাকিস্তানিরা আমাদের দেশের একটি পক্ষকে ইন্ধন দিচ্ছে।
সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ইজতেমার মুরুব্বিদের দাওয়াত তো আপনারা দিয়েছেন। দাওয়াতে কে আসবে না আসবে সেটা তো আপনাদের মুরুব্বিদের ব্যাপার। এ ব্যাপারে তিনি মুরুব্বিদের সঙ্গে আলোচনা করে ফয়সালার অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে সব কিছুই ফয়সালা হয়ে যাবে। এজন্য তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন।
বৈঠকে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিাগের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়।
এ সময় গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশীদ জানান, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা এলাকায় প্রায় সাত হাজার পুলিশ সদস্য আট ভাগে ভাগ হয়ে পাঁচ স্তরে মুসল্লিদের নিরাপত্তা রক্ষা করবে। মুসল্লিদের প্রবেশপথে সন্দেহভাজনদের মেটাল ডিটেক্টর, ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার ও ৪১টি সিসি ক্যামেরা থেকে পুরো ইজতেমাস্থল পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের প্রতি খিত্তায় ছয়জন করে পুলিশ সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করবেন। এবার গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার পুলিশ সদস্য ও পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রতিও নজরদারি করা হবে।
পুলিশ সুপার জানান, বিশ্ব ইজতেমা এলাকা হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত করা হবে। এ ছাড়া রোববার থেকে ইজতেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত গাজীপুরের পুলিশ সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ইজতেমা ময়দানগামী সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের এক হাজার ৮০০ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদাভাবে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হবে। এবারের বিশ্ব ইজতেমার পুরো ময়দানকে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় থাকবে পুলিশের প্রায় সাত হাজার সদস্য এবং র্যাবের ২৫০ সদস্য।
ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক মো. গাউস আল মুনির জানান, বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে বিশেষ ট্রেন চালু হবে এবং প্রতিটি ট্রেন টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে দুই মিনিট করে যাত্রা বিরতি করবে।
বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইজতেমা এলাকায় পাঁচটি ফিডারের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল জানান, এ বছর ১৫টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের ওজু-গোসলের জন্য প্রতিদিন প্রায় চার কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া মুসল্লিদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট ও গোসলখানা স্থাপন করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নান জানান, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ইজতেমা ময়দান এলাকায় ২৬টি ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশক নিধনের ওষুধ ছিটানো হবে। এ ছাড়া ২১টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দান থেকে বর্জ অপসারণ, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও ময়দান এলাকায় প্রয়োজনী ব্লিচিং পাউডার সরবরাহ করা হবে। এখানে বিদেশি ক্যাম্পে রান্নার জন্য ১৩৬টি গ্যাসের চুলা স্থাপন করা হবে। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ৪৫টি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, ইজতেমা এলাকাসহ আশেপাশের এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, অশ্লীল পোস্টার অপসারণ এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য তুরাগ নদে সাতটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ৯ জানুয়ারি সকাল থেকে তা চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এর আগে ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর থেকে ইজতেমা ময়দানের পশ্চিমপাশের তুরাগ নদে নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে।
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বি মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, এরই মধ্যে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির প্রায় ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি দফার শেষ দিনে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকার উত্তরা ছাড়াও গাজীপুরের আটটি স্থানে মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিং করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।
১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মাঠে মুসল্লিদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে টঙ্গীতে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম বছর যারা (যে ৩২ জেলার মুসল্লি) টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন তারা পরবর্তী বছর সেখানে যাবেন না। ওই বছর এসব জেলার মুসল্লিরা নিজ নিজ জেলায় আঞ্চলিক ইজতেমায় শরিক হবেন। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার পাশাপাশি জেলায় জেলায় আঞ্চলিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।