মানুষের ভোগান্তি যেন শেষ নেই

মানুষের ভোগান্তি যেন শেষ নেই

  • লঞ্চ চলাচলও বন্ধ
  • পণ্য পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : চলমান পরিবহন ধর্মঘটে সারা দেশে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বাসের পর শনিবার ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে লঞ্চেও ধর্মঘট ডাকা হয়। ফলে ট্রেনে চাপ বাড়ে কয়েক গুণ। তবে মিলছে না ট্রেনের টিকিট। দূর গন্তব্যের সচ্ছল মানুষ বিমানেরও টিকিট পাচ্ছেন না। ঢাকায় চলা একমাত্র বিআরটিসি বাসেও আসন পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের বিষয়।

শনিবার চাকরির পরীক্ষা শেষ করে দেড় ঘণ্টা ধরে ঢাকার মহাখালীর মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমিনুল ইসলাম। এখান থেকে তাঁকে যেতে হবে বাসাবোতে। কিন্তু পকেটে অটোরিকশার ভাড়া দেওয়ার মতো অত টাকা নেই। মোটরসাইকেলও অ্যাপে যেতে রাজি না। কী করবেন? সেই উপায় খুঁজছেন পথে দাঁড়িয়ে। কিছু সময় পর বাসাবোতেই যাবেন এমন আরেকজনের খোঁজ পেলেন তিনি। পরে দুজনে মিলে অটোরিকশা ভাড়া করে করেন।

নিয়ামুল করিম সবুজ থাকেন রাজধানীর ভাসানটেকে। যশোরে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন চাকরি হয়েছে তাঁর। আজ চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা। বাস না চলায় গতকাল দুপুরে আট হাজার টাকায় গাড়ি ভাড়া করে যশোরে রওনা করেন। বিমানে গেলে তো এর চেয়ে কম খরচ হতো—এই জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করেছি, সোমবার পর্যন্ত কোনো টিকিট নেই। ট্রেনেরও কোনো টিকিট পাইনি।’

ভোগান্তি আর অতিরিক্ত টাকা খরচ হলেও জরুরি প্রয়োজনের যাত্রা থেমে নেই। এমন চিত্র আরো দেখা যায় গাবতলী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায়। কেউ যাচ্ছেন মোটরসাইকেলে, কেউ অটোরিকশা, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে। দুপুরের পর আমিনবাজার থেকে একাধিক বাস ছেড়ে যায় পাটুরিয়া ঘাটে। ধর্মঘটের প্রথম দিন পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত ভাড়া ৩০০ টাকা নেওয়া হলেও গতকাল সেই ভাড়া দাঁড়ায় ৪০০ টাকায়।

আমিনবাজারে সোলায়মান নামের একজন জানান, তিনি মাগুরা যাবেন। তাঁর চাচা মারা গেছেন। সোলায়মান বলেন, ‘দ্রুত না গেলে জানাজা না-ও পেতে পারি। এ জন্য ঘাট পর্যন্ত ৪০০ টাকায়ই যাচ্ছি।’ মিরপুর শাহ আলী মাজার থেকে বগুড়ার শান্তাহার যেতে সানাউল হক মোটরসাইকেল ভাড়া করেছেন দুই হাজার ৭০০ টাকায়। তিনিও যাচ্ছেন নিকটাত্মীয়র মৃত্যু সংবাদ শুনে।

নির্ধারিত দাবি না মানলে পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে ট্রাক শ্রমিক-মালিক ফেডারেশন। শনিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গণমাধ্যমে এ কথা জানান সংগঠনটির অতিরিক্ত মহাসচিব আব্দুল মোতালেব। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের দাবির কথা শুনেছেন এবং বলেছেন, যৌক্তিক দাবিগুলো আলোচনা করে মেনে নেওয়া হবে। মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় বসবেন। হয় তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করতে হবে, নয় তো ভাড়া বাড়াতে হবে। এর দুটির একটি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।’

অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ না চালানোর ঘোষণা দিয়েছে লঞ্চ মালিকরা। গতকাল লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের দাবি না মানায় যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে তিন টাকা ৪০ পয়সা এবং ১০০ কিলোমিটারের পর এক টাকা ৪০ পয়সার বদলে দুই টাকা ৮০ পয়সা করার প্রস্তাব করেছেন লঞ্চ মালিকরা।

শনিবার বিকেল থেকে ঢাকাগামী যাত্রীরা বরিশাল ঘাটে এসে ফিরে যায়। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জনিয়েছে, যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া বৃদ্ধি অনৈতিক কাজ। মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, ডিজেলের দাম বাড়ানোতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মালিকরা।

সন্ধ্যায় বরিশাল নৌবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, ঘাটে থাকা দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী বেশির ভাগ লঞ্চ ঘাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গতকাল বরিশাল থেকে ছয়টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা ছাড়েনি। ঘাটে তিনটি লঞ্চ নোঙর করা ছিল। বাকি তিনটি নিজস্ব ডকে নিয়ে রাখা হয়েছে।

শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকা থেকে ছেড়ে চাঁদপুরে গেছে লঞ্চ। দুপুরের পর ঢাকা থেকে চাঁদপুরে লঞ্চ না গেলেও চাঁদপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যায়।

শনিবার নগরের পথে পথে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও অবস্থানের কারণে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। অনেকের ব্যক্তিগত যান চলাচলেও শ্রমিকরা বাধা দেয়। এমন অবস্থা সরকার দল সমর্থিত পরিবহন মালিকদের একটি অংশ আজ রবিবার সকাল থেকে নগরে যানবাহন চলাচল করার ঘোষণা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘আজকে যে দৃশ্য দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে মালিক-শ্রমিকদের এই কর্মসূচিতে অন্য কোনো পক্ষ মাঠে নেমে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। তাই আমরা আজ সকাল থেকে গাড়ি চলাচলের ঘোষণা দিয়েছি।’

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব গোলাম রসুল বাবুল বলেন, ‘সড়কে বিক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ মালিক-শ্রমিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা রবিবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছি। ওই বৈঠকে গাড়ি চলাচলের সিদ্ধান্ত হলে তারপর আমরা সড়কে গাড়ি নামাব। তা না হলে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।’

বেনাপোলে আটকা পড়েছে ভারতফেরত যাত্রীরা। শুক্রবার সকাল থেকে যাত্রীরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে না পেরে ভিড় করছে পরিবহন কাউন্টারসহ হোটেলে। অনেকের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় আবাসিক হোটেলে উঠতে পারছে না। টানা ধর্মঘটে হুমকিতে পড়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও। ভারত থেকে আসা পণ্যও বেনাপোল বন্দরে আটকে আছে।

শনিবার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য নামলেও পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। বিজিএমইএর সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিজিএমইএর উদ্যোগে পুলিশি পাহারায় কনটেইনার পরিবহনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে বিজিএমইএ সদস্যদের বার্তা দিয়েছি কারো আমদানি কিংবা রপ্তানিমুখী কনটেইনার প্রস্তুত থাকলে তা জানাতে।’

ধর্মঘটের কারণে মোংলা বন্দর জেটি থেকে যেমন কোনো পণ্য বের হচ্ছে না, তেমনি ঢুকছেও না। তবে জেটির অভ্যন্তরে কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। বন্দরের ট্রাফিক বিভাগ জানায়, গত দুই দিন জেটি থেকে পরিবহন বন্ধ থাকায় ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল আটকে আছে।

মহিউদ্দিন নামের একজন বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটিতে ঢাকা থেকে কুমিল্লা নগরীর বাড়িতে এসেছিলেন। শনিবার সকালে ঢাকায় ফিরতে গিয়ে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন। শনিবার সকাল ৭টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে এসে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো গাড়ির দেখা পাননি তিনি। ঢাকায় অফিস ধরার জন্য বাধ্য হয়ে অবশেষে তাঁকে বেছে নিতে হয় মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসে জনপ্রতি ভাড়া এক হাজার টাকা। ১০ জন মিলে ১০ হাজার টাকায় রাজধানীর সায়েদাবাদ পর্যন্ত মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে উঠে পড়েন তাঁরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *