মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমছেই

মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমছেই

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ি আরোপের পরও সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম চড়াসহ পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা শুধু জমানো সঞ্চয় নয়, সঞ্চয়পত্র ভেঙে বায় করছে। পাশাপাশি কমেছে মানুষের আয়ও। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। কিন্তু এখন বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের চার মাসের বিনিয়োগ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রে নিট বা প্রকৃত বিনিয়োগ তো হয়নি, বরং ৬৩২ কোটি টাকা কম বিনিয়োগ হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, চার মাসে মানুষের কাছ থেকে যত বিনিয়োগ এসেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন। এ পেছনে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সরকারে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণাত্মক হয়েছে। অর্থাৎ এই চার মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।

উলটো ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা সরকার তার কোষাগার থেকে শোধ করেছে। অথচ গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩২৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঐ চার মাসে গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধের পরও সরকারের কোষাগারে ৯ হাজার ৩২৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ছিল। সে কারণে ব্যাংক থেকে খুব একটা ঋণ নিতে হয়নি।

সঞ্চয় অধিদপ্তর সর্বশেষ অক্টোবর মাসের তথ্য বলছে, সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা ঋণাত্মক হয়েছে। অথচ গত বছরের অক্টোবরে ৭৬৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা ধনাত্মক ছিল। অর্থাৎ গত বছরের অক্টোবরে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধের পরও ৭৬৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা ছিল। আগের মাস সেপ্টেম্বরেও সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৭০ কোটি ৬৩ হাজার টাকা ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ ঐ টাকা সরকার তার কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ধনাত্মক ছিল।

তার আগের মাস আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।

বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎস করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।

সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকেই বিক্রি কমছে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারো বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আগে থেকেই বাজারে জিনিপত্রের দাম বেশি ছিল। এরপর যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না। সে কারণে কমে গেছে এ খাতে বিনিয়োগ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *