রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম : হালনাগাদ অগ্রগতি

রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম : হালনাগাদ অগ্রগতি

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান : বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মৌল মানবিক সহায়তা প্রদান বিশেষত শিশুদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে । প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরকে রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের তালিকা তৈরি এবং তাদের কল্যাণে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দয়িত্ব প্রদান করা হয়। সমাজসেবা অধিদফতর রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের তালিকা তৈরি করেছে এবং তাদের কল্যাণ ও সুরক্ষায় যথোপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম চলমান আছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর কার্যক্রমটি ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাস্তবায়ন শুরু করে। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ গতবছরের ৩০ নভেম্বর সম্পন্ন হয়। মোট ৩৯,৮41 জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বালক 19,058 জন (47.83%) বালিকা 20,783 জন (52.17%)। এর মধ্যে মাতা-পিতাহীন এতিম শিশু 8,391 জন (21.06%), পিতৃহীন এতিম শিশু 29,315 জন (73.58%), মাতা-পিতা হতে পৃথক শিশু 865 জন (2.17%) এবং অন্যান্য 1,270 জন (৩.১৮%)।

এসব শিশুর সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনক্রমে ইউনিসেফ, বাংলাদেশ এর সাথে সমাজসেবা অধিদফতর এর ১৭ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী অতিমাত্রায় ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের মাসিক ২০০০ টাকা হারে ৬ মাসের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান, ক্যাম্পভিত্তিক ৯০টি শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন, ১০০টি শিশু ক্লাব গঠন এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য ৬টি চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস (সিএফএস) পরিচালনা করা হবে, চুক্তির মেয়াদ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত। মেয়াদ নবায়নের সুযোগ রয়েছে।

ইউনিসেফ এর সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি অনুসারে ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ সুরক্ষায় এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। যার বাস্তবায়ন অগ্রগতি ইতিবাচক।

১ মার্চ ২০১৮ থেকে মাঠ পর্যায়ে ৫০ জন সমাজকর্মী কাজ শুরু করে। বর্তমানে ৬২ জন সমাজকর্মী, দুজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও দুজন গার্ড/ ক্লিনার এবং পাঁচজন সিএফএস ম্যানেজার মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।

মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী কর্মচারীগণের কেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে তিনটি এবং এসেসমেন্ট টুল বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করা হয়েছে। তালিকাবদ্ধ ৩৯,৮৪১ জন রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে ২০,৮৫০ জন শিশুর তথ্য যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। নতুন করে অন্তর্ভুক্ত ঝুঁকিতে থাকা শিশুর সংখ্যা ২,২১৫ জন। মোট ২১,৫৭২ জন শিশুর ঝুঁকির মাত্রা নিরূপণ করা হয়েছে এবং পূর্বের তালিকাবদ্ধ শিশুদের মধ্যে ১,৪৯৩ জনের পিতা জীবিত কিংবা বয়স ১৮ বছরের বেশি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, মোট যাচাইকৃতের সংখ্যা ২৩,০৬৫ জন। ঝুঁকি যাচাইয়ের তথ্য অনুসারে 5,৯১৮ জন শিশু অতি মাত্রায়, 5,৫৭৮ জন মধ্যম মাত্রায়, 2,৫৮৭ জন নিম্ন মাত্রায় এবং 7,৪৮৯ জন শিশু ঝুঁকিতে নেই বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অতি ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের মধ্যে 12৫ জন সঙ্গীহীন শিশু, 6৬৫ জন বিচ্ছিন্ন শিশু, 5৯৩ জন শিশু প্রধান পরিবারের শিশু এবং মাতা-পিতা উভয়েই মৃত এইরূপ শিশুর সংখ্যা ৩,৩৬৪ জন। এই ৪টি ক্যাটাগরিতে মোট শিশুর সংখ্যা 4,৭৪৭ জন।

৪টি ক্যাটাগরির 4,৭৪৭ জন শিশুর মধ্যে ৪,৫৮৪ জন শিশুর ফস্টার কেয়ারগিভার যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ক্যাম্প ইনচার্জ অফিসারের মাধ্যমে তালিকা অনুমোদিত হয়েছে। মোট ১৭০০ জন শিশু ও ফস্টার কেয়ারগিভারের সাথে এগ্রিমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে। ইউনিসেফ থেকে এ পh©ন্ত ১,86,৮৮,২০০ টাকা ছাড় করা হয়েছে, এর মধ্যে জুন মাসে প্রথম বারের মতো ৫০ জন শিশুর ফস্টার কেয়ারগিভারকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম উদ্বোধন হয়। আগস্ট মাসে নতুন ১,৫৫৫ জনসহ মোট ১,৬০৫ জন শিশুর জন্য ১,৬০৫টি কেয়ার গিভার পরিবারের মধ্যে জনপ্রতি ২,০০০ টাকা হারে মোট ৩২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। কর্মসূচি অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে নতুন ২,৯৭৯ জনসহ মোট ৪,৫৮৪ জন শিশুর ফস্টার কেয়ারগিভারকে ৯১ লক্ষ, ৬৪ হাজার টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

প্রতিটি ক্যাম্প’এ সিআইসি’এর সভাপতিত্বে কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে বাংলাদেশের হোস্ট কমিউনিটির জন্য ৫টি (তিনটি উখিয়া এবং দুটি টেকনাফ উপজেলায়) সিএফএস প্রতিষ্ঠা করা হবে, সিএফএস এর জন্য স্থান নির্বাচনের কাজ চলমান রয়েছে।

সিএফএস পরিচালনার জন্য ২৫ জন আউটরীচ ওয়ার্কার এবং ১০ জন গার্ড/ ক্লিনার নিয়োগ করা হবে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সভাপতিত্বে ০৫ জুন রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম বিষয়ে পর্যালোচনাসভা হয়েছে। সমাজকল্যাণ সচিব ১০ জুন টেকনাফ উপজেলার শ্যামলাপুর (বাহারছড়া) ক্যাম্প’এর ৫০ জন ফস্টার কেয়ারগিভারকে অর্থ সহায়তা প্রদান করে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন।
কার্যক্রমের আওতায় যেসব কাজ অতিদ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অবশিষ্ট শিশুদের মধ্যে ১৬,৭৭৬ জনের তথ্য যাচাই, ৮,৫০০ জন শিশুর ফস্টার কেয়ারগিভারকে অর্থ সহায়তা প্রদান, হোস্ট কমিউনিটির জন্য ৫টি সিএফএস এবং মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, অতি ঝুঁকিতে থাকা শিশুদেরকে কেস ম্যানেজমেন্ট’এর আওতায় এনে সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে শিশুভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া নতুন কর্মীদের শিশু সুরক্ষায় ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষার লক্ষ্যে ইউনিসেফ কক্সবাজারে জনবলসহ কার্যালয় স্থাপন করেছে। ইউনিসেফ কর্তৃপক্ষ সমাজসেবা অধিদফতরের কার্যক্রম বাস্তবায়নের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। পাশাপাশি কার্যক্রম বাস্তবায়ন মনিটরিং করছে। আর এভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় বিশ্বের সকল শিশুর মতো রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কাh©ক্রম এগিয়ে চলছে।

লেখক, কলামিস্ট

২৫.১০.২০১৮

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *