স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়া চীন তুরস্ককে গ্যারান্টর চায় হামাস

স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়া চীন তুরস্ককে গ্যারান্টর চায় হামাস

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে চুক্তির প্রথম সপ্তাহেই গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলি বাহিনীর পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং চুক্তির গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদাতা) হিসেবে রাশিয়া, চীন ও তুরস্ক চেয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এ দিকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ১০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আটকা পড়েছেন। অন্য দিকে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বারবার বাধা দেয়ার জেরে ইসরাইলের একটি গোষ্ঠীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।


মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষিত এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নীতিগতভাবে মেনে নিয়েও তাতে কিছু সংশোধনী দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি। হামাস তিন ধাপবিশিষ্ট যুদ্ধবিরতির একেবারে প্রথম দিকেই গাজা থেকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রত্যাহারের ওপর জোর দিচ্ছে। একইসাথে তারা যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধের সুস্পষ্ট ঘোষণা চাচ্ছে। গত মাসে বাইডেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করে হামাসকে তা মেনে নিতে বলেন। তিনি বলেন, এটি ইসরাইলি প্রস্তাব। এতে তিন ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য চুক্তিতে প্রথম ধাপের (ছয় সপ্তাহ) পরই কেবল ইসরাইলি পূর্ণ প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। ওয়াশিংটন বলেছে, হামাসের সংশোধনীগুলোর কিছু বাস্তবায়নযোগ্য নয়। হামাস মনে করছে, প্রথম ধাপের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু বন্দীকে মুক্ত করিয়ে নেবে ইসরাইলি। এরপর তারা আবার আরো ভয়াবহভাবে হামলা করবে। তা ছাড়া হামলা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত ইসরাইল দেয়নি। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ ইসরাইলি নেতারা প্রকাশ্যে হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখার কথা বলছেন। ফলে হামাস বিদ্যমান প্রস্তাবটি মেনে নিতে পারছে না।


লেবাননের আল-আখবার আউটলেটে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, হামাস যুদ্ধবিরতির প্রথম সাত দিনের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ সালাহউদ্দিন এবং আল-রশিদ মহাসড়ক, নেতজারিতের সেনাস্থাপনা, মিসর-গাজা সীমান্ত-সংলগ্ন ফিলাডেলফি রুট এবং রাফা ক্রসিং থেকে সব ইসরাইলি সৈন্য ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছে।
হামাস জানিয়েছে, ইসরাইলি যদি সাত দিনের মধ্যে গাজা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার না করে, তবে তারা বন্দিমুক্তি স্থগিত করবে। হামাসের একটি সূত্র হারেৎজ পত্রিকাকে জানিয়েছে, হামাস এ কারণে প্রথম ধাপেই ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির ওপর জোর দিচ্ছে, যাতে ইসরাইল কোনো পর্যায়েই এ দু’টি শর্ত থেকে সরে যেতে না পারে এবং বন্দীদের মুক্তির পর আবার যুদ্ধ শুরু করতে না পারে।


এ ছাড়া হামাস ইসরাইলের কারাগারে দীর্ঘ দিন ধরে আটক থাকা ১০০ ফিলিস্তিনির একটি তালিকা দিয়েছে। বন্দিবিনিময়ের আওতায় তাদেরকে মুক্তি দিতেও দাবি জানাচ্ছে হামাস। অন্য দিকে ইসরাইলি ১৫ বছরের বেশি কারাদ-প্রাপ্ত কোনো বন্দীকে মুক্তি দিতে চাচ্ছে না। আবার ইসরাইলি ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই চুক্তির গ্যারান্টর হিসেবে রাশিয়া, চীন ও তুরস্ককে মেনে নিতে রাজি হচ্ছে না।


ইসরাইলি চরমপন্থীগোষ্ঠীর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা : ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য পাঠানো মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বারবার বাধা দেয়ার জেরে ইসরাইলের একটি চরমপন্থী গোষ্ঠীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দফতর শুক্রবার এই পদক্ষেপ নেয়। জানা গেছে, জাভ নাইন নামের ওই গোষ্ঠীর সদস্যরা জর্দান থেকে গাজারসড়কগুলো রুদ্ধ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই উপত্যকায় ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে।


মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মতে, গোষ্ঠীটি ত্রাণবাহী ট্রাকগুলোর ক্ষতি সাধন করেছে এবং মানবিক সাহায্যগুলো রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি এবং গাজার মানবিক সঙ্কট এড়াতে মানবিক সহযোগিতা পাঠানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন যাতে ওই সব উগ্রবাদী ইসরাইলি বসতিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। মিলার বলেন, ১৩ মে জাভ নাইন গোষ্ঠীর সদস্যরা গাজাগামী দু’টি ট্রাক পশ্চিম তীরে লুট করে এবং পুড়িয়ে ফেলে। মিলার এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ওই সব গোষ্ঠীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে যারা গাজায় মানবিক সাহায্য সরবরাহে বাধা দেবে এবং ইসরাইলি সরকারকেও একই পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।


দক্ষিণ গাজায় আটকা ১০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি : যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ১০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আটকা পড়েছেন। তাদের কাছে এক দিকে যেমন নেই বিশুদ্ধ পানি, তেমনি নেই স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উপ-নির্বাহী পরিচালক কার্ল স্কাউ আল-জাজিরাকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তাছাড়া ইসরাইলি হামলায় গাজায় শুক্রবার অন্তত ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ জন।

ভাসমান বন্দর ফের সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : গাজার উপকূলে স্থাপন করা ভাসমান বন্দরটি ফের সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তা জানান, সমুদ্র উত্তাল হওয়ার শঙ্কা থেকে এটি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। গত মে মাসে ৩২০ মিলিয়ন ডলারের এই বন্দরটি গাজার উপকূলে স্থাপন করা হয়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে বারবার এটির কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উত্তাল ঢেউয়ের প্রভাবে কয়েকদিন আগে এটি ভেঙে যায়। এরপর মেরামতের জন্য এটি দখলদার ইসরাইলের আসোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। মেরামত শেষে গত সপ্তাহে এটি আবারও গাজায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সপ্তাহ না পেরুতেই বন্দরটি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, যতদিন সমুদ্র শান্ত না হচ্ছে ততদিন এটি আসোদ বন্দরে থাকবে। ১৭ মে থেকে এটির কার্যক্রম শুরু হয়। জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে এ বন্দরটি দিয়ে তারা মাত্র ১৩৭ ট্রাক ত্রাণ তাদের গুদামে নিয়ে গেছে। এই বন্দরটি দিয়ে গাজায় এসেছে মাত্র ৯০০ টন ত্রাণ। গত সপ্তাহে বন্দরটি সচল হলেও গতকাল শুক্রবার জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, নতুন করে এটি দিয়ে কোনো ত্রাণ তাদের কাছে আসেনি।

গত আট মাস ধরে দখলদার ইসরাইলি ও গাজাভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইলি। এতে করে গাজার বাসিন্দরা খাদ্যের অভাবে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ভাসমান বন্দর দিয়ে গাজায় তারা ত্রাণ নিয়ে যাবে। ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ এবং ৮৫ হাজারেও এরও বেশি আহত হয়েছে।

বিনা চিকিৎসায় প্রথম ফিলিস্তিনি অলিম্পিয়ানের মৃত্যু : গাজায় বিনা চিকিৎসায় প্রথম ফিলিস্তিনি অলিম্পিয়ানের মৃত্যু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই শুক্রবার এ তথ্য জানায়। নিজেদের অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম পোস্টে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, ফিলিস্তিনের প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে যিনি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন গত বুধবার নুসেইরাত শরণার্থী ক্যাম্পে বিদ্যুতের অভাবে এবং বিনা চিকিৎসায় কিডনি বিকল হয়ে মারা গেছেন।

অ্যাথলেট মাজেদ আবু মাহারেল, ৬১ বছর বয়সে মারা গেছেন, তিনি ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনের পতাকা বহন করেছিলেন। দৌড়বিদ হিসেবে তিনি ১০ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তারপর আরো ২০ ফিলিস্তিনি অলিম্পিকে ফিলিস্তিনকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ফিলিস্তিনের সাবেক এই অ্যাথলেটের ভাই স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা তাকে মিসরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দখলদার ইসরাইলি বাহিনী রাফা ক্রসিং বন্ধ করে দেয়ায় তারা আর এটি পারেননি। পরে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়।

গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় দখলদার ইসরাইলের আগ্রাসন শুরু হয়। আট মাস ধরে চলা এই হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরো প্রায় এক লাখ মানুষ। যুদ্ধ শুরুর পর পরই গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সবকিছুর সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরাইলি। এতে করে সাধারণ মানুষ খাদ্যকষ্ট ছাড়াও চিকিৎসা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
সূত্র: টাইমস অব ইসরাইল, আলজাজিরা ও ভয়েস অব অ্যামেরিকা

Related Articles