স্বীকৃতি মিললেও থামেনি কওমিপন্থীদের দ্বন্দ্ব : সরগরম গণমাধ্যম

স্বীকৃতি মিললেও থামেনি কওমিপন্থীদের দ্বন্দ্ব : সরগরম গণমাধ্যম

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কওমী শিক্ষাসনদ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ বেফাকের বিরুদ্ধে অনিয়মের কথা তুলে ধরার পর থেকে গণমাধ্যমে শুরু হয়েছে কওমী শিক্ষানদের স্বীকৃতি নিয়ে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ।
গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে কওমিপন্থীদের বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের। গত বছর সনদের সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর নতুন করে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির জন্য ৬ বোর্ডের সমন্বয়ে একটি সংস্থা গঠিত হলেও আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নিয়ন্ত্রণাধীন বেফাকের আধিপত্য নিয়ে ক্ষোভ বাকি ৫ বোর্ডের। সব বোর্ডের মধ্যে সমন্বয় ও সমতা না এলে এই কার্যক্রম বাধার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। ৬ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই বছর ১৩ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি এর সমমান ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। প্রকাশিত ওই গেজেটে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি ও হেফাজতের আমির আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি মান বাস্তবায়ন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কওমি মাদ্রাসার সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটির প্রথম বৈঠক কমিটির চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে পরীক্ষা ও সনদের জন্য ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে একটি সংস্থা “আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ” নাম নির্ধারণ করা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত বোর্ডগুলো হচ্ছে, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা, ইত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া চট্টগ্রাম, আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ড সিলেট, তানযীমুল মাদারিসিল কওমিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ। এ সংস্থার জন্য মতিঝিলে একটি অফিসও নেওয়া হয়েছে।
এই সংস্থার চেয়ারম্যান বেফাক সভাপতি শাহ আহমদ শফী, কো-চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বেফাকের সিনিয়র সহ সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী। সংস্থাটির ৩২ সদস্যের মধ্যে ২২ জনই বেফাকের সদস্য। বাকি ১০ জন সদস্য রয়েছেন বেফাক ছাড়া ৫ বোর্ড থেকে।

গত ৩১ মার্চ রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে করে কওমি শিক্ষা সনদ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদ। সেখানে সংগঠনের সদস্য সচিব মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ বলেন, ‘হাইআতুলউলয়ায় বেফাক আধিপত্য বিস্তার করছে। বেফাকে ছাড়া অন্য ৫টি বোর্ড সমান মর্যাদা পাচ্ছে না। একই সঙ্গে তিনি বেফাক ছাড়াও অন্যান্য বোর্ড থেকে দুই জন কো-চেয়ারম্যান নেওয়াসহ ৫টি দাবি জানান।’

জানা গেছে, ২০১৭ সালে দেশের প্রায় ৭৩৭টি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে স্বীকৃতির জন্য দাওরায়ে হাদিসের প্রথম পরীক্ষা হয় ১৫ মে। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা সারাদেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছরেও পরীক্ষায় অংশ নেবে ৬ বোর্ডের শিক্ষার্থীরা।

৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে “আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ” গঠিত হলেও বেফাক ছাড়া অন্য বোর্ডগুলো সমান মর্যাদা পাচ্ছে না বলে একমত পোষণ করেন আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মুফতি আব্দুল হালিম বুখারী। তিনি বলেন, ‘কওমি সনদের স্বীকৃতির আগেও বেফাক চায়নি সব কওমি বোর্ডের স্বীকৃতির আওতায় আসুক। তারা চেয়েছিল বেফাক এককভাবে স্বীকৃতি পাক। এখন সরকার সব বোর্ডকে এক করে স্বীকৃতি দিয়েছে। আল-হাইআতুল উলয়া ৬টি বোর্ড নিয়ে গঠিত হলেও এখানে ৬টি বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়, সমতা নেই।’

সেখানে বেফাকের আধিপত্য বেশি অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সংস্থায় ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ২২ জন বেফাকের। আল-হাইআতুল উলয়ার যে কোনও মিটিংয়ে ১১ জন উপস্থিত থাকলে কোরাম পূর্ণ হবে। এক্ষেত্রে সব বোর্ড আছে কিনা সেটি বিবেচনা করা হয় না। ফলে আল-হাইআতুল উলয়া বেফাকের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকছে। ঐক্যের জন্য এই সংস্থার সৃষ্টি কিন্তু এসব বিষয়ে সমাধান না হলে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকবে কিনা এটা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কওমি আলেম বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্মানিত ব্যক্তি। একই সঙ্গে আশরাফ আলীও কওমি অঙ্গনে সম্মানিত। কিন্তু তারা দুজনই বয়োবৃদ্ধ, তাদের নাম ব্যবহার করে অনেকই নানা সমস্যার সৃষ্টি করছেন। আল-হাইআতুল উলয়া অন্যান্য বোর্ডকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, ফলে সামনে এই সংস্থা ঠিক থাকবে কিনা এটিও শঙ্কার বিষয়।’
জাতীয় দ্বিনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ও কওমি শিক্ষাসনদ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব ইয়াহইয়া মাহমুদ বলেন, ‘ছয় বোর্ডকে সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তাকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তিনি (প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব) পরামর্শ দিয়েছিলেন পাঁচ বোর্ডের পক্ষ থেকে একজনকে কো-চেয়ারম্যান নেওয়ার জন্য। কিন্তু বেফাক এখনও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য আমাদের দাবি মিটিংয়ের কোরাম পূরণে অন্যান্য বোর্ডের সদস্যদের আবশ্যকীয় হিসেবে ঘোষণা করা।’

ইয়াহইয়া মাহমুদ আরও বলেন, বেফাক ছাড়া ৫ বোর্ড এরইমধ্যে একাধিকবার বৈঠক করেছে। বেফাককে মৌখিকভাবে এ বিষয় নিয়ে জানানো হয়েছে। আমরা ঠিক করেছি আল-হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান আহমদ শফীর কাছে লিখিতভাবে এ বিষয়ে জানাবো।
তবে অভিযোগ নাকচ করেছেন বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘সব বোর্ড মিলিয়ে আল-হাইআতুল উলয়া গঠন করা হয়েছে। কারও অভিযোগ থাকলে হাইআতুল উলয়ার মিটিংয়ে উপস্থাপন করতে পারেন। মিটিংয়ে না এসে বাইরে থেকে কথা বললে কোনও সমাধান মিলবে না।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *